জেলা পরিষদ নির্বাচন ৬১ জেলায় আ.লীগের প্রার্থিতা চান ৭০০ জন

ক্রাইমবার্তা রিপোট:আসন্ন জেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় সমর্থন পেলেই জয় নিশ্চিত বলে ভাবছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। এ কারণে প্রার্থী হতে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। ৬১ জেলায় চেয়ারম্যান পদে দলের সমর্থন পেতে আবেদন করেছেন ৭০০ জন। এই বিপুলসংখ্যক নেতা আগ্রহ দেখানোয় গত ইউপি নির্বাচনের মতো আবার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের শঙ্কা আছে দলটিতে।.

আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্য নির্বাচনের মতো জেলা পরিষদ নির্বাচনে দলের প্রার্থীদের কার কী অবস্থান তা জানতে একাধিক সমীক্ষা চালিয়েছেন। এসব সমীক্ষার প্রতিবেদন তাঁর হাতে আছে। দলের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের গত শুক্রবারের সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, আবেদনকারীদের মধ্য থেকে জনমত জরিপে যিনি এগিয়ে থাকবেন, তাঁকেই দলের সমর্থন দেওয়া হবে।

জেলা পরিষদের প্রার্থী বাছাইয়ের প্রস্তুতি নেওয়ার লক্ষ্যে গতকাল রোববার আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি কার্যালয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে অংশ নেওয়া একাধিক নেতা বলেন, সাংগঠনিক সম্পাদকদের কাছে নিজ নিজ বিভাগের আগ্রহী প্রার্থীদের তালিকা দেওয়া হয়েছে। তাঁরা যাচাই-বাছাই করে মতামত দেবেন। শিগগিরই দলের সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ১৯ সদস্যের স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রার্থী মনোনয়ন বোর্ডের বৈঠকে প্রতিটি জেলার জন্য একজন করে প্রার্থী ঠিক করা হবে। এর বাইরে দল থেকে আর কেউ যাতে প্রার্থী না হতে পারেন, তা নিশ্চিত করার জন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের চেষ্টা থাকবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, জেলা পরিষদ নির্বাচন নির্দলীয় এবং এতে দল থেকে কাউকে মনোনয়ন দেওয়া হবে না। তবে দল একজন করে প্রার্থীকে সমর্থন দেবে। আগ্রহী প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা, যোগ্যতা ও দলের প্রতি অঙ্গীকার খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তাঁর মতে, যোগ্য লোককে সমর্থন দেওয়া হলে অন্য আগ্রহী প্রার্থীরা মেনে নেবেন।

এবারই প্রথম জেলা পরিষদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। সংসদ, সিটি করপোরেশন, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা থাকলেও জেলা পরিষদে প্রত্যক্ষ ভোটের বিধান নেই। পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবেন পরোক্ষ ভোটে। ভোট দেবেন ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা ও সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। তাঁদের ভোটে ১ জন চেয়ারম্যান, ১৫ জন সদস্য ও সংরক্ষিত ৫ জন নারী সদস্য নির্বাচিত হবেন। গতকাল জেলা পরিষদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। এতে আগামী ২৮ ডিসেম্বর ভোট গ্রহণ হবে।

আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছে চেয়ারম্যান পদটি আকর্ষণীয় হওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, জেলা পরিষদের প্রচুর সম্পদ। চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের ১২২ কোটি টাকার নিজস্ব সম্পদ আছে। রংপুর জেলা পরিষদের ৪০০ একর জমি রয়েছে। জেলা পরিষদের নিজস্ব ভবন আছে। স্টাফ আছে প্রায় ৪০ জন। এত সম্পদ ও সুযোগ থাকার কারণে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।

একই রকম মত দিয়েছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেনও। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এর চেয়ে কম ক্ষমতার জন্য যেখানে হানাহানি হয়, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নিয়ে তো হুড়োহুড়ি পড়ারই কথা।

আওয়ামী লীগের দুজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বাস্তবতা হচ্ছে, দলের সমর্থন মানেই জয় নিশ্চিত। এ জন্যই জেলা পর্যায়ের নেতারা দলীয় সমর্থন পেতে বেশ তোড়জোড় শুরু করেছেন। এ জন্য কিছু বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাঁরা বলেন, বিদ্রোহী প্রার্থী বেশি হলে টাকার ছড়াছড়ি হওয়ারও সম্ভাবনা থেকে যায়। আছে হানাহানির আশঙ্কা, যা গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলকে বেশ বেকায়দায় ফেলে দেয়। এ কারণে একক প্রার্থী দেওয়ার বিষয়ে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হবে।

ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের বেশির ভাগ প্রতিনিধিই এখন সরকারি দলের। এই বাস্তবতায় বিএনপি জেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ সরকারের আমলে প্রথম জেলা পরিষদ আইন হয়েছিল। গতকাল এক অনুষ্ঠানে এরশাদ বলেছেন, তাঁর দল জেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেবে না। তিনি বলেন, ‘এই নির্বাচন অর্থহীন। ফলাফল কী হবে তা আমরা জানি।’

এর আগে উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে জোটগতভাবে অংশ নেওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছিল সরকারের শরিক ১৪ দল। কিন্তু আওয়ামী লীগ এতে সাড়া দেয়নি। বরং ইউপি নির্বাচনে ১৪ দলের শরিকদের প্রার্থীকে মাঠছাড়া করার অভিযোগ ছিল। ১৪ দলের একাধিক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, আগের অভিজ্ঞতা থেকে জেলা পরিষদ নির্বাচনে জোটগতভাবে অংশ নেওয়ার আশা তাঁরা করছেন না।

 আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দপ্তর সূত্র জানায়, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে সমর্থন পেতে সর্বাধিক ২৯টি আবেদন পড়েছে পাবনা জেলা থেকে। এরপর শেরপুর থেকে ২৫টি, নোয়াখালীতে ২৩টি, চাঁদপুর ও পঞ্চগড় থেকে ২২টি করে আবেদন পড়েছে। বিভাগ পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি, ১৩৩টি পড়েছে খুলনা বিভাগ থেকে। এরপরই চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে ১২৮টি আবেদন পড়েছে। সবচেয়ে কম ৩২টি আবেদন পড়েছে সিলেট বিভাগ থেকে।

পাবনা জেলা আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, পাবনা থেকে ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফের মেয়ে মাহজাবিন শিরিন আবেদন করেছেন। মাহজাবিন বর্তমানে ঈশ্বরদী উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান। তাঁর স্বামী আবুল কালাম আজাদ ঈশ্বরদী পৌরসভার মেয়র।

কুমিল্লা জেলা আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, ওই জেলা থেকে ৯ জন আবেদন করেছেন। তাঁদের মধ্যে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আফজল খান ও নৌবাহিনীর সাবেক প্রধান আবু তাহের রয়েছেন।

আবু তাহের প্রথম আলোকে বলেন, তিনি মনে করেন জেলা পরিষদের দায়িত্ব পেলে জেলার উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে। এ জন্য তিনি আগ্রহ দেখিয়েছেন। পদ ছোট কি বড়, সেটি ভাবেন না তিনি।

দেশে ৬৪ জেলার মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩ জেলা রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির জন্য আলাদা আইন থাকায় সেখানে এ নির্বাচন হবে না। বাকি ৬১টি জেলায় জেলা পরিষদ নির্বাচন হবে। বর্তমানে এসব পদে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রশাসকেরা দায়িত্ব পালন করছেন।

নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ৬১ জেলায় মোট জনপ্রতিনিধির সংখ্যা প্রায় ৬৫ হাজার, যাঁরা জেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটার। এর মধ্যে প্রতিটি ইউপিতে জনপ্রতিনিধি, অর্থাৎ ভোটার ১৩ জন।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এই নির্বাচনে ভোটাররা, অর্থাৎ স্থানীয় সরকারের সব স্তরে অধিকাংশ প্রতিনিধিই আওয়ামী লীগের। তাই দলের সমর্থন পাওয়া মানেই চেয়ারম্যান নিশ্চিত। ফলে দলের নেতাদের মধ্যে আগ্রহ বেশি। তিনি বলেন, জেলা পরিষদ হচ্ছে পরোক্ষ ভোটে আর অন্যগুলো সর্বজনীন ভোটের মাধ্যমে। এক দেশে দুই নির্বাচনব্যবস্থা থাকা ঠিক নয়।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদও বলেছেন, সব মানুষের ভোটে নির্বাচন হলে অনেক প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো। তাঁর মতে, এমনও করা যেত যে পরিষদের সদস্যরা সাধারণ মানুষের ভোটে নির্বাচিত হবেন। আর নির্বাচিত সদস্যদের ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবেন। তিনি বলেন, ‘এরপরও বলব এমন মানুষকে আওয়ামী লীগের সমর্থন দেওয়া উচিত যাকে সাংসদ, উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা সমীহ করবে। ব্রিটিশ আমলে জাতীয় নেতারা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হতেন।’

 

Please follow and like us:

Check Also

নতুন যোগ হচ্ছে ২০ লাখ দরিদ্র

মূল্যস্ফীতির কশাঘাত মোকাবিলায় ২০ লাখ ২৬ হাজার দরিদ্র মানুষকে নতুন করে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।