গুম হওয়া স্বজনের আর্তনাদ

ক্রাইমবার্তা রিপোট:কিছুটা ভাবলেশহীন। কিছুক্ষণ আগেও যে তিনি কাঁদছিলেন, মুখ দেখে তা বোঝা যাচ্ছিল। চোখ দু’টোও লাল। গালে শুকিয়ে যাওয়া অশ্রুর চিহ্ন। ২০১৩ সালে গুম হওয়া শাহীনবাগ তেজগাঁওয়ের আদনান চৌধুরীর বাবা বৃদ্ধ রুহুল আমিন। এখন প্রতিটি দিন কাটে অপেক্ষা আর কান্নায়। তার বিশ্বাস, ছেলে একদিন ফিরে আসবে। তিনি আল্লাহর কাছে প্রতিদিন প্রার্থনা করেন। বলেন, আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দাও। আমার একটাই ইচ্ছা, মৃত্যুর আগে যেন সন্তানকে দেখে যেতে পারি।

রুহুল আমীন বলেন, আমি এক হতভাগা বাবা। খুব কষ্ট করে সন্তানকে বড় করেছি। কিন্তু ২০১৩ সালে প্রশাসনের লোক আমার ছেলেকে তুলে নেয়ার পর থেকে অনেক ঘোরার পরেও আমি এখনো সন্তানের দেখা পাইনি।

আজ রোববার সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে শুধু রুহুল আমিন নয়, সংবাদ সম্মেলনে সন্তানহারা মা, বাবাহারা সন্তান কিংবা স্বামীহারা স্ত্রীরা তাদের এমন আকুতি তুলে ধরেন। কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে প্রেসক্লাবের কনফারেঞ্জ লাউঞ্জ।

২০১৩ সালে রাজধানী থেকে গুম হওয়া ২০ জনকে ফিরে পেতে তাদের পরিবারের সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। তারা অভিযোগ করেছেন, বিভিন্ন দফতরে দফায় দফায় আবেদন করেও নিখোঁজদের সন্ধান পাওয়া যায়নি।

সাত বছরের শিশু লামিয়া আক্তার মিম। সকাল থেকে বাবা কায়সারের ছবি বুকে নিয়ে ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন প্রেস ক্লাবে। সাথে ছিলেন তার মা মুন্নি। পিতাকে ফেরত চেয়ে লামিয়া বলেন, আমি আমার বাবাকে ফেরত চাই। বাবার সাথে স্কুলে যেতে চাই। বাবার সাথে খেলতে চাই। তোমরা আবার বাবাকে ফেরত দাও।

তিন বছর পেরিয়ে গেলেও খোঁজ মেলেনি কারো। ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর উত্তর সিটির ২৫ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমনসহ আটজন একই দিনে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গা থেকে নিখোঁজ হন। ওই বছরের বিভিন্ন সময় গুম হন আরো ১১ জন। পরিবারগুলোর অভিযোগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাদের, যাদের কেউই এখনো ফিরে আসেননি।

রাসেলের ভাই বলেন, তার মা মাঝরাতে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকেন। বলেন, আমার রাসেল আসবে। এই বুঝি আমার সন্তান আসছে।

ঘটনার এতদিন পরেও পরিবারের সদস্যদেরকে ফিরে না পেয়ে হতাশা আর ক্ষোভের কথা উঠে এসেছে স্বজনদের বক্তব্যে।
গুম হওয়া অন্য আরেকজনের স্বজন বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে বলতে চাই, আমার যে ভাইরা গুম হয়েছে বাংলাদেশের মধ্যে, আমার প্রতিটা ভাইয়ের তথ্য আপনি আমাদের কাছে দিয়ে দেন।

এক মা বলেন, যেভাবে হোক ফেরত চাই। সুমনসহ প্রতিটি মায়ের বাচ্চাকে ফেরত দিতে হবে। কিভাবে দেবেন সেটা আপনারা জানেন। আপনারা রাস্তা তৈরি করবেন। ফেরত দিতে হবে।

ছেলেকে ফিরে না পাওয়ার শোকে কাতর হয়ে পড়েছেন হাজেরা খাতুন। সন্তানের ছবি বুকে আগলে রেখেই দিন কাটছে তার। তিনি বলেন, আমি আমার সব সন্তানকে যেন ফিরে পাই। আপনারা ফিরিয়ে দেন।

গুম হওয়া মাসুমের মা আয়েশা আক্তার প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়ে বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি যদি ব্যবস্থা নেন, তাহলে আমাদের সন্তানরা অবশ্যই ফিরে আসবে, ফিরে আসবে।

গুম হওয়া এই ২০ পরিবারে আয় করার মানুষ নেই। এই পরিবারগুলোর কথা রাষ্ট্র একবারও ভাবেনি। কাউকে গুম করে ফেলা শুধুমাত্র ব্যক্তি বিশেষের মানবিক অধিকার লঙ্ঘন নয়, একই সাথে মানবতার বিরুদ্ধে গুরুতর অপরাধ। গুম হওয়ার অপরাধে যখন রাষ্ট্র অভিযুক্ত হয় তখন মানবাধিকার রক্ষা আন্দোলনের কর্মী এবং গুমের শিকার হওয়া পরিবারগুলোর জন্য তা একটা চ্যালেঞ্জ তৈরি করে।

তারা বলেন, গুমজনিত অপরাধকে ধারাবাহিক অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ আটক বা অপহরণের পর তা একটি দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকে। বাংলাদেশ ২০১০ সালের ২৩ মার্চ আন্তর্জাতিক ফৈজদারি অপরাধ আদালতে (আইসিসি) রোম সংবিধানে অনুস্বাক্ষর করেছে। রোম সংবিধিতেও গুমকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

পরিবারগুলোর অভিযোগ, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিতর্কিত নির্বাচনের পর দেশে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময় অনেকগুলো গুমের ঘটনা ঘটে। ভিন্নমতের রাজনৈতিক কর্মীরা এর শিকার হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাদের ধরে নিয়ে গেছে। এর পর থেকে তারা গুম রয়েছে অথবা পরে কোনো মামলায় তাদের কয়েকজনকে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। তাদের কারো কারো লাশ পাওয়া গেছে। যদিও এই তালিকায় তাদের ২০ জনের কেউ নেই। গুম হওয়া স্বজনদের দ্রুত পরিবারের কাছে ফেরত দিতে রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানান তারা।

সংবাদ সম্মেলনে ২০ পরিবারের সদস্য এবং আত্মীয় স্বজনরা উপস্থিত ছিলেন।

Check Also

বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে: স্মৃতিসৌধে পরিদর্শন বইয়ে রাষ্ট্রপতি

মহান স্বাধীনতা দিবসে ঢাকার সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের প্রতি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।