জটিল হচ্ছে রোহিঙ্গা সমস্যা

ক্রাইমবার্তা রিপোট:রাখাইনে রোহিঙ্গা সমস্যা দিন-দিন জটিল আকার ধারণ করছে। সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন-হত্যাযজ্ঞ বন্ধে এবং সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের ওপর বিভিন্ন দেশের চাপ বাড়ছে। মালয়েশিয়ায় আজ অনুষ্ঠিত হবে সংহতি সমাবেশ, যেখানে যোগ দেবেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক। গত শুক্রবার বাংলাদেশেও রাজধানীসহ দেশের সর্বত্র ব্যাপক বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে। সরকারি নির্দেশে দেশটির সেনাবাহিনী সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর গণহত্যা চালাচ্ছে এমন অভিযোগ এনে এটি প্রতিরোধে পদক্ষেপ নিতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন ‘ফরটিফাই রাইটস’। সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা পশ্চিমা শক্তিগুলো অব্যাহতভাবে ‘উপেক্ষা’ করে চলছে বলে সংগঠনটির অভিযোগ। এ ছাড়া ইন্দোনেশিয়ায়ও চলছে ব্যাপক প্রতিবাদ বিক্ষোভ। এর জেরে সে দেশে সফর বাতিল করেছেন অং সান সু চি।

বর্তমানে রাখাইন রাজ্য পরিদর্শন করছেন জাতিসংঘ গঠিত রোহিঙ্গা কমিশনের প্রধান কফি আনান। তিনি রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের কারণে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

এদিকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে এতদিন চুপ ছিলেন অং সান সু চি। নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী এ নেত্রী অবশেষে মুখ খুলেছেন। তিনি বলেছেন, রাখাইনে বৌদ্ধদের সঙ্গে রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরোধ বাড়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দায়ী। তার এই বক্তব্যে বিস্মিত রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা মানবাধিকার সংস্থাগুলো।

সব মিলিয়ে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কার্যকর কোনো উদ্যোগ এখনো দেখা যাচ্ছে না। বরং এ সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে। এর মাসুল দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করলেও মানবিক কারণেই তাদের ফিরিয়ে দিতে পারছে না বাংলাদেশ।

মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দলের প্রধান আন সং সু চির অভিযোগ, আন্তর্জাতিক মহলের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রাখাইন রাজ্যে বিভক্তি বাড়িয়ে দিচ্ছে। মিয়ানমারের জাতিগত জটিলতার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বিশ্ববাসীর এটা ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, সেখানে সামরিক অভিযান শুরু হয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলার পর। যার জন্য মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদীরা দায়ী। সিঙ্গাপুরের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যম চ্যানেল নিউজ এশিয়াকে এক সাক্ষাৎকারে সু চি বলেন, আমি খুব খুশি হব যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সব সময় বড় ধরনের অসন্তোষ ছড়ানোর কারণ তৈরি না করে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ভালো সম্পর্ক গড়ার জন্য অগ্রগতি আনতে এবং শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় আমাদের সহযোগিতা করে।

এদিকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মালয়েশিয়া কড়া হুশিয়ারি দিয়েছে মিয়ানমারকে। মুসলিমদের ওপর মিয়ানমার সেনাদের নির্মম নির্যাতন ও মানবিক সংকটের প্রতিবাদে আজ ৪ ডিসেম্বর দেশটিতে সংহতি সমাবেশ হওয়ার কথা রয়েছে। গতকাল শনিবার দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত একটি আদেশ জারি করেছে। সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক যোগ দেবেন বলে এতে জানানো হয়। এর আগে, রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর অভিযানের বিষয়ে মালয়েশিয়াকে নাক না গলানোর আহ্বান জানায় মিয়ানমার। মিয়ানমারের আহ্বান যে অগ্রহণযোগ্য, সংহতি সমাবেশের ঘোষণা দিয়ে মালয়েশিয়া সেই বার্তাই দিল। এ বিষয়ে মিয়ানমার টাইমসের খবরে বলা হয়, রোববার (আজ) রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিক্ষোভ সমাবেশ করবেন নাজিব রাজাক।

মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, রাখাইনে সেনাবাহিনীর নির্যাতনে মুসলিম রোহিঙ্গারা চরম মানবিক সংকটে রয়েছে। মিয়ানমার সরকারকে এ সংকটের সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।

মালয়েশিয়ার এ অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট দপ্তরের ডেপুটি জেনারেল ইউ জউ হায়ে বলেন, প্রতিবেশী দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি মালয়েশিয়ার শ্রদ্ধা দেখানো উচিত। তিনি বলেন, আসিয়ান আঞ্চলিক জোটের মূলনীতিতে একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষপ করার অধিকার আরেকটি দেশের নেই। আমাদের এ নীতিকে অনুসরণ ও সম্মান দেখানো উচিত।

রাখাইন রাজ্যে মুসলমানদের হত্যার এবং তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া অঞ্চলগুলো পরিদর্শন করেছেন রোহিঙ্গা কমিশনের প্রধান কফি আনান। জাতিসংঘের সাবেক এই মহাসচিব স্থানীয় নির্যাতিতদের সঙ্গে কথা বলেন।

রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের কারণে কফি আনান ক্ষোভ প্রকাশ করেন। গভীর উদ্বেগের সঙ্গে তিনি বলেন, রাজ্যটিকে নতুন করে অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে সহিংসতা। নতুন করে অনেককেই তাদের বসতবাড়ি থেকে উৎখাত করা হয়েছে, যা কখনই কাম্য নয়। সরকারি বাহিনীকে সহিংসতা পরিত্যাগ করার আহ্বান জানান তিনি।

এদিকে অং সান সু চি রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিধনের বিষয়টি তদন্তে আরেকটি তদন্ত কমিশন গঠন করেছেন। ১৩ সদস্যবিশিষ্ট এ কমিশনের প্রধান নিযুক্ত করা হয়েছে মিয়ানমারের ভাইস প্রেসিডেন্ট মিন্ট সিউকে। তিনি জাতিসংঘের কালো তালিকাভুক্ত সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল। এ তদন্ত কমিশনকে প্রত্যাখ্যান করেছে রোহিঙ্গা মুসলমানদের জাতিগত নিধনের বিরুদ্ধে সোচ্চার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো।

রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর নির্মম নির্যাতন ও গণহত্যার অভিযোগ উঠেছে দেশটির সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। তাদের অমানবিক নির্যাতনে বাধ্য হয়ে এসব অসহায় রোহিঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করে পার্শবর্তী বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছে।

জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত দুই মাসে ১০ হাজারেরও অধিক মানুষ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব) আবদুর রশিদ আমাদের সময়কে বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুটি বরাবরই একটি জটিল ইস্যু। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারকে আলোচনায় বসতে বাধ্য করতে হবে। এজন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সম্মিলিতভাবে চাপ দিতে হবে। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ওপর যে অমানবিক আচারণ করছে, সেটি এক কথায় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। বাংলাদেশের উচিত হবে সমস্যার সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখা।

গতকাল মিয়ানমারে সেনা অভিযানের মুখে কক্সবাজারের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে এদেশে অনুপ্রবেশকালে দুটি নৌকাসহ অন্তত ২২ রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি। শনিবার ভোররাতে উখিয়ার বালুখালী এবং টেকনাফে নাফ নদীর জাদিমুরা পয়েন্ট জলসীমায় এ অভিযান চালানো হয় বলে বিজিবির কর্মকর্তারা জানান।

সাম্প্রতিক নির্যাতনে প্রায় ৩০,০০০ রোহিঙ্গা তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে এবং উপগ্রহ থেকে প্রাপ্ত চিত্রাদি বিশ্লেষণে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে কয়েক হাজার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। ২০১২ সালে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লে কয়েক লাখ রোহিঙ্গাকে তাদের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয় এবং এরপর থেকে তারা পুলিশ পাহারায় দারিদ্র্যপীড়িত ক্যাম্পে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে। সেখানে তারা স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং তাদের আন্দোলনকে প্রচ-ভাবে দমিয়ে রাখা হয়েছে।

 

Check Also

বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে: স্মৃতিসৌধে পরিদর্শন বইয়ে রাষ্ট্রপতি

মহান স্বাধীনতা দিবসে ঢাকার সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের প্রতি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।