অন্তত একবার রোহিঙ্গাদের কথা ভাবুন

ক্রাইমবার্তা ডেস্ক রিপোট:এক সময় সব ছিল। ঘর বাড়ি, ফসলের মাঠ, ছোট টং দোকান। মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলে রোহিঙ্গা মুসলমানরা একেবারে খেটে খাওয়া মানুষ অর্থাৎ অনগ্রসর জনগোষ্ঠী। এই অনগ্রসর জনগোষ্ঠী যখন স্বাধীন আরাকান রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল তখন আকিয়াব বন্দর থেকে আশে পাশের দেশগুলো থেকে জীবীকার তাগিদে মানুষ আসত কাজে। অভিবাসীর 18462660_302বৈশিষ্টই হচ্ছে যেখানে অর্থনীতি গতিশীল ও বাড়ন্ত থাকে সেখানে শ্রম থেকে মেধার চাহিদা মেটাতে মানুষ ছুটে যায়। ইতিহাস বলে, আরকানের মুসলমানরা এমন অর্থনীতির গতি সেখানে প্রতিষ্ঠা করেছিল। কিন্তু মিয়ানমারের রাজা বোদাওফায়া আরাকান দখল করে নিলে নেমে আসে দুর্গতি। তারপর ইংরেজদের শোষণ, বিশ্বযুদ্ধ ইত্যাদির পথ পরিক্রমায় আজকের রোহিঙ্গা মুসলমানরা তাদের নিজ দেশেই বহিরাগত। আরাকানের প্রাচীন নামও ছিল রোহিন। ১৩৯টি জাতিগোষ্ঠীর তালিকা করলেও ব্রিটিশরা রোহিঙ্গা মুসলমানদের সে তালিকায় রাখেনি। অথচ ব্রিটিশদের সমর্থন দেয়ায় জাপানি সৈন্যদের হাতে রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রাণ দিতে হয়েছে।18462661_302

আর এখন গণতন্ত্রীপন্থি নেত্রী অং সাং সুচি যা করছেন, তা বিশ্ববাসী দেখছেই। শুধুই দেখছে। রাখাইন রাজ্যের মংডু এলাকায় এখনো অনেক মুসলিম রোহিঙ্গা বন জঙ্গলে পালিয়ে আছেন।  তারা লোকালয়ে যেতে পারেন না।  তাদের ছেলেমেয়ে, ভাইবোন কোথায় কিভাবে আছেন তাও তারা জানেন না। কারণ মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, নারী ধর্ষণ, ঘর বাড়িতে আগুন দেয়ার মত জাতি নিধনে রোহিঙ্গারা না পারছে বাংলাদেশে আসতে, না পারছে দেশে ফিরতে। রাতের আঁধারে সীমান্ত পারি দিয়ে বাংলাদেশে যে পরিমাণ রোহিঙ্গা মুসলমান আশ্রয় নিয়েছে তারচেয়ে অনেক বেশি পালিয়ে আছে জঙ্গলে, নৌকায় ভাসছে, অথবা ক্ষুধা পিপাসায় সাগরে ডুবে মারা মরছে।36475481_303

মিয়ানমারের মংডুর চালিপাড়াং এলাকায় বন আর টিলার মাঝে লুকিয়ে আছেন নূর মোহাম্মদ।  বাংলাদেশের একটি মোবাইল ফোন নম্বর দিয়ে তিনি কথা বলেন ডয়চে ভেলের সঙ্গে।  তিনি জানান, ‘‘মংডুর এলাকার বন আর টিলার মধ্যে তারা কয়েকজন লুকিয়ে আছেন।  তাদের বাড়িও ওই এলাকায়।  গত অক্টোবরে তাদের এলাকায় হামলা চালিয়ে ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়।  হেলিকপ্টার থেকেও হামলা চালানো হয়।  ওই হামলায় অনেক লোক মারা গেছে।  আর কেউ কেউ পালিয়ে বাঁচতে পেরেছেন।”

তিনি জানান, হামলাকারীরা নারীদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন করেছে।  অনেককে ধরে নিয়ে গেছে।

এখন পরিস্থিতি কেমন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘যখন মিলিটারী থাকেনা তখন আমরা গ্রামে যাই।  সৌরবিদ্যুতে, ব্যাটারির মাধ্যমে মোবাইল চার্জ দিয়ে ফিরে আসি। আমরা কয়েকজন মিলে মোবাইল ফোন চার্জের ব্যবসাও করতাম।  কেউ কেউ আছেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে।  আমরা মাঝে মাঝে খাবারের খোঁজেও যাই।  তবে আবার বনে ফিরে আসি।’18462667_302

এভাবে বাঁচা সম্ভব? প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘‘খাবার নেই, পানি নেই।  তিনদিনও না খেয়ে থেকেছি।  তারপরও বাঁচার চেষ্টা করছি।  আপনারা যদি পারেন আমাদেও জন্য কিছু করেন।”

নূর মোহাম্মদ জানান, ‘আমাদের গ্রামে সাত হাজারের মত বাসিন্দা, দেড় হাজারের মত পরিবার।  তাদের সব কিছু শেষ হয়ে গেছে।  কোনো ঘর-বাড়িই আর অক্ষত নেই। ’

তিনি বলেন, ‘‘আমার ছয় বোন, বাবা-মা নেই।  দুই বোনকে বিয়ে দিয়েছি।  চারবোন হামলার দিন আমার সঙ্গে বাড়িতে ছিলো।  দুই বোন পালিয়ে কক্সবাজারের কুতুপালং গেছে বলে জানতে পেরেছি।  বাকি দুই বোন কোথায় আছে জানিনা।18462663_302

শুধু ডয়চে ভেলে নয়, বিবিসি সহ আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞের এসব খবর এলেও সুচির সরকার তাতে কান দেয়নি। গণতন্ত্রের এই ফেরিওয়ালা বিদেশ সফর করলেও নিজের দেশে রাখাইন অঞ্চলে যাওয়ার সময় পাচ্ছেন না। যদিও জাতিসংঘ তাকে সেখানে যাওয়ার আহবান জানিয়েছে। কেনই বা যাবেন সুচি। তাকে সেনাবাহিনী নিয়মিত ব্রিফিং দিচ্ছেন। আর তাতেই সন্তষ্ট হয়ে সুচি বলছেন, রাখাইন অঞ্চলে যা হচ্ছে তা নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাড়াবাড়ি করছে।

বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সৌদি আরব সহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে রোহিঙ্গা মুসলমানরা পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। আর যারা পালাতে যেতে পারেনি তাদের স্থান হয়েছে নিজদেশ মিয়ানমারে গণকবরে। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয় বলছে সুচির সরকার। তাই বলে তাদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালাতে হবে। সুচির গণতন্ত্র এটাই বলে। স্যাটেলাইটে ধারণকৃত চিত্রে দেখা যাচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। শান্তির দূত বুদ্ধের অনুসারীরা বলছেন, রোহিঙ্গারা নিজেরাই ঘরে আগুন দিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।18462666_302

বাংলাদেশ সংলগ্ন মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকায় বাংলাদেশের মোবাইল ফোন কোম্পনিগুলোর নেটওয়ার্ক কাজ করে এবং ওইসব এলাকায় বাংলাদেশের মোবাইল ফোন কোম্পানির সিম ব্যবহার হয়।  নূর মোহাম্মদের সঙ্গে ডয়চে ভেলে’র ঢাকা প্রতিনিধির চার দফা কথা হয়েছে।  তবে তাঁকে সব সময় মোবাইল ফোনে পাওয়া যায়নি।  মাঝে মাঝে পাওয়া গেছে।  কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘মাঝে মাঝে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক ডাউন হয়ে যায়।”’

তিনি বলেন, ‘‘আমি বাংলাদেশে আশ্রয়ের জন্য আসার চেষ্টা করছি।  ওখানে আমার আত্মীয়-স্বজন আছে। কিন্তু আসতে পারবো কিনা জানিনা।”

18462659_302জাতিসংঘের প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ‘‘গত ছয় সপ্তাহে ২২ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।  শুক্রবার এক বিবৃতিতে জাতিসংঘ জানায়, ৯ অক্টোবর থেকে রাখাইনে শুরু হওয়া মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দমন-অভিযানে অন্তত ৮৬ জন নিহত হয়েছেন।  এছাড়া ঘর হারিয়েছেন ৩০ হাজার মানুষ।  সহিংসতা থেকে বাঁচতে রোহিঙ্গরা বাংলাদেশ সীমান্তে ছুটে আসছেন। ডয়চে ভেলে অবলম্বনে

 

Please follow and like us:

Check Also

দেশীয় খেলাকে সমান সুযোগ দিন: প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্যান্য খেলার পাশাপাশি দেশীয় খেলাকেও সুযোগ দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কতৃর্পক্ষের প্রতি আহবান …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।