আদালতের আদেশ লঙ্ঘন গ্রেফতার-রিমান্ডে

ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোট:9 আসামি বা সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে নির্যাতন না করার বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালতের আদেশ মানা হচ্ছে না। প্রায়ই আদেশ লঙ্ঘন হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বলেছেন, হেফাজতের (রিমান্ড) নামে কাউকে নির্যাতন করা যাবে না। বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার (ফৌজদারি কার্যবিধি ৫৪ ধারা) ও রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের (১৬৭ ধারা) ক্ষেত্রে গত বছরের ১০ নভেম্বর পূর্ণাঙ্গ এক রায়ে নীতিমালা প্রণয়ন করে দেন সর্বোচ্চ আদালত। পাশাপাশি হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য ১০ দফার একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। একই সঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেটদের জন্য নয় দফা এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব পালনের বিষয়েও সাত দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়। আপিল বিভাগ পূর্ণাঙ্গ রায়ে ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ ও র‌্যাবের প্রতি কতিপয় নির্দেশনা দেন। আর এ নির্দেশনা প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল, পুলিশের মহাপরিদর্শক ও র‌্যাবের মহাপরিচালককে সরবরাহের নির্দেশ দেওয়া হয়। সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনার কপি সংশ্লিষ্টদের কাছে পাঠানো হয়। এরই মধ্যে তার মাস পার হয়েছে। কিন্তু সর্বোচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। এ-সংক্রান্ত আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নে কোনো প্রজ্ঞাপনও জারি করেনি সরকার; বরং রায়ের কতিপয় নির্দেশনা সংশোধন চেয়ে সরকারের পক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় থেকে পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) আবেদন করা হয়েছে। আপিল বিভাগে রিভিউ আবেদনটি শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।

 এদিকে, সর্বোচ্চ আদালতের সেই রায়ের নির্দেশনা মানছে না পুলিশ। দেশের বিভিন্ন থানা ও আদালতে দায়ের করা ফৌজদারি মামলায় পুলিশ আসামির বিরুদ্ধে রিমান্ড চাইছে। সংশ্লিষ্ট আদালতও রিমান্ড মঞ্জুর করছেন। হরহামেশাই পুলিশের বিরুদ্ধে জিজ্ঞাসাবাদের নামে হেফাজতে নিয়ে আসামিদের নির্যাতনের অভিযোগ উঠছে। এমনকি নির্যাতনের ফলে অনেক সময় আটক ব্যক্তির অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর ঘটনাও

ঘটেছে। আইনজীবীরা বলছেন, হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের পদ্ধতি নিয়ে সংশ্লিষ্ট আইনের ধারা সংশোধন হলেই নির্যাতন বন্ধ হবে। তারা বলেন, সর্বোচ্চ আদালতের রায় মেনে চলা সব নাগরিকের জন্য বাধ্যতামূলক। তা মানা না হলে আদালত অবমাননা করা হবে। এর আগে হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছিল, রিমান্ডে নিয়ে আসামিকে নির্যাতন করা যাবে না। জেলগেটে কাচের দেয়ালঘেরা কক্ষে আসামির আইনজীবীর উপস্থিতিতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে চিকিৎসককে দিয়ে আসামির শারীরিক পরীক্ষা করাতে হবে। চিকিৎসা-সংক্রান্ত প্রতিবেদন আদালতে পাঠাতে হবে। এ রায়ের কপি পাওয়ার পরও আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দেশের কোনো জেলগেট বা থানায় কাচের দেয়ালঘেরা কক্ষ স্থাপন করা হয়নি। তবে পুলিশের দাবি, আদালতের যথাযথ নির্দেশনা মেনেই রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

পটুয়াখালীর বাউফলের কনকদিয়া ইউনিয়নের কলতা গ্রামের হাফিজুর রহমান বিজয়কে গ্রেফতারের পর থানায় নিয়ে নির্যাতন করেন এএসপি (সার্কেল) সাইফুল ইসলাম। গত ১২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার দিকে এক মামলায় তাকে বাউফল থানার এসআই ফেরদৌস গ্রেফতার করেন। ওই দিন রাত ১২টার পর বিজয়কে থানাহাজত থেকে ওসির রুমে এনে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। রাত দেড়টা পর্যন্ত চলে তার ওপর নির্যাতন। এ বিষয়ে বাউফল থানার ওসি আযম খান ফারুকী বলেন, ‘বাউফল সার্কেলের এএসপি সাইফুল ইসলাম আসামিকে থানাহাজত থেকে আমার রুমে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করেন, তাকে নির্যাতন করেননি।’ এ সময় তিনি থানায় ছিলেন না বলেও দাবি করেন। পরে একটি জাতীয় দৈনিকে ‘বাউফলে ওসির রুমে নির্যাতন’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। বিজয়ের মা জোসনা বেগমের করা রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি আসামিকে থানা হেফাজতে নির্যাতনের ঘটনায় এএসপি সাইফুল ইসলামকে অবিলম্বে প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে নির্যাতনের শিকার হাফিজুর রহমান বিজয়ের পরিবারকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। আগামী ১৯ মার্চ পরবর্তী শুনানির জন্য দিন ধার্য রয়েছে।

সম্প্রতি পেশাগত দায়িত্বের সময় গ্রেফতার হয়েছিলেন একুশে টিভির সাভার প্রতিনিধি নাজমুল হুদা। ডিসেম্বরের শেষ দিকে পুলিশ তাকে আশুলিয়া থানায় ডেকে নিয়ে পরদিন তার বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা করে। পরে তাকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় নির্যাতনের চিহ্ন পাওয়া যায়।

রিমান্ডে নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিরা বলছেন, রিমান্ডে নেওয়া আসামিদের যে ধরনের নির্যাতন করা হয় তার মধ্যে গিঁটা নির্যাতন, টানা নির্যাতন, ওয়াটারথেরাপি, ডিমথেরাপি, উলঙ্গ করে নির্যাতন, বোতলথেরাপি উল্লেখযোগ্য। এসব নির্যাতনের ফলে হাড়-মাংস থেঁতলে যায়। তবে বাইরে থেকে কোনো কিছুই দৃশ্যমান নয়। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশ মূলত এসব নির্যাতন করে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে। গ্রেফতার আসামির স্বজনদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের জন্য এভাবে নির্যাতন করা হয়। টাকার পরিমাণের ওপর নির্ভর করে নির্যাতনের ধরন।

সর্বোচ্চ আদালতের রায় প্রতিপালন বিষয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ  বলেন, যারা আইন বা আদালতের আদেশ লঙ্ঘন করছেন, তাদের জন্য প্রতিকারের ব্যবস্থা রয়েছে। এ বিষয়ে আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে অবশ্যই একটা আদেশ দেবেন। তিনি বলেন, সাধারণ নাগরিক হোক আর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, কারোরই আইন ভঙ্গ করা উচিত নয়। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকের আইন মেনে চলা বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) আইনজীবী ইদ্রিসুর রহমানের মতে, সরকারের রিভিউ আবেদন গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন, সর্বোচ্চ আদালত যে নির্দেশনা দিয়েছেন, তা সংবিধান ও প্রচলিত আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সরকারের উচিত, রায় বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী শ ম রেজাউল করিম বলেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সবারই আইন মানতে হবে। সর্বোচ্চ আদালতের দেওয়া রায়ের নির্দেশনা প্রতিপালন সবার জন্য বাধ্যতামূলক। তা না হলে একদিকে যেমন আদালত অবমাননা হবে, অন্যদিকে আইনের শাসনকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার শামিল বলে গণ্য হবে। ফৌজদারি বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট মোশারফ হোসেন কাজল বলেন, সর্বোচ্চ আদালত যে আদেশ বা গাইডলাইন দিয়েছেন, তা প্রতিপালন করা হচ্ছে কি-না স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়ের মনিটর করা উচিত। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ নাগরিক জীবনের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেটা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কি-না, তার বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে পদক্ষেপ নিতে হবে। না হলে মানুষ অধিকার ফিরে পাবে না।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য করা গাইডলাইনে বলা হয়েছে, গ্রেফতারের পরপরই স্থান ও সময় উল্লেখ করে গ্রেফতারকৃতের স্বাক্ষরসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য একটি নোট তৈরি করবেন। গ্রেফতারের সময় ও স্থান এবং আটক রাখার জায়গা গ্রেফতার ব্যক্তির আত্মীয়কে জানাতে হবে। স্বজন না পেলে ওই ব্যক্তির নির্দেশনা মেনে তার বন্ধুকে জানাতে হবে। এ কাজে ১২ ঘণ্টা অতিক্রম করা যাবে না। কোন যুক্তিতে, কার তথ্যে বা অভিযোগে ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে, ঠিকানাসহ তা কেস ডায়েরিতে লিখতে হবে। বিশেষ ক্ষমতা আইনের ৫৪ ধারায় সন্দেহভাজন কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না।

ম্যাজিস্ট্রেট ও বিচারকদের জন্য করা গাইডলাইনে বলা হয়েছে, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭(২) ধারা অনুসারে ডায়েরির অনুলিপি ছাড়া আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাউকে আদালতে হাজির করে আটকাদেশ চাইলে ম্যাজিস্ট্রেট, আদালত, ট্রাইব্যুনাল একটি বন্ড নিয়ে তাকে মুক্তি দিয়ে দেবেন। আটক থাকা কোনো ব্যক্তিকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অন্য কোনো সুনির্দিষ্ট মামলায় যদি গ্রেফতার দেখাতে চায়, সে ক্ষেত্রে যদি ডায়েরির অনুলিপিসহ তাকে হাজির না করা হয়, তাহলে আদালত তা মঞ্জুর করবেন না; গ্রেফতার দেখানোর আবেদনের ভিত্তি না থাকলে বিচারক আবেদন খারিজ করে দেবেন।

১৯৯৮ সালে ডিবি পুলিশ রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকা থেকে ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শামীম রেজা রুবেলকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করে। ওই বছরের ২৩ জুলাই পুলিশ হেফাজতে তার মৃত্যু হয়। এর পর তৎকালীন সরকার রুবেল হত্যা তদন্তের জন্য বিচারপতি হাবিবুর রহমান খানের সমন্বয়ে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত শেষে কমিটি ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের পক্ষে কয়েকটি সুপারিশ করে। এ সুপারিশ বাস্তবায়িত না হওয়ায় ব্লাস্ট হাইকোর্টে একটি রিট করে। ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল চূড়ান্ত রায়ে এ বিষয়ে কয়েক দফা নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট। – samakal.net

Please follow and like us:

Check Also

ফরিদপুরে বাস-পিকআপ সংঘর্ষে নিহত ১৩

ফরিদপুরের কানাইপুরে বাস ও পিকআপ ভ্যানের সংঘর্ষে ১৩ জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া আহত হয়েছেন …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।