প্রকাশ : ০৫ মে ২০১৭,
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হেফাজতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলোর তদন্তে তেমন কোনো আগ্রহ নেই পুলিশের সংশ্লিষ্টদের। কবে নাগাদ মামলার তদন্ত শেষ হবে, তাও কেউ স্পষ্ট করে বলতে পারছেন না। শুধু তাই নয়, মামলার মূল আসামিদের কারও কারও বিরুদ্ধে আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকলেও তারা প্রকাশ্যেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
আরও জানা গেছে, ওইসব মামলা প্রত্যাহারে জোর তৎপরতা শুরু করেছে হেফাজত। এ ব্যাপারে বিভিন্ন মাধ্যমে সরকারের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখছেন হেফাজত নেতারা। এ প্রসঙ্গে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী যুগান্তরকে বলেন, হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হাটহাজারীসহ সারা দেশে যেসব মামলা রয়েছে, তা প্রত্যাহারের জন্য প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের একাধিকবার বলা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মামলা প্রত্যাহারের বিষয়টি দেখবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেশের বাইরে থাকায় মামলা প্রত্যাহারের বিষয়ে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বুধবার যুগান্তরকে বলেন, ‘মামলা প্রত্যাহারের কোনো প্রস্তাব আমার কাছে আসেনি। এসব মামলা প্রত্যাহারের ব্যাপারে সুপারিশ করবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এরকম কোনো সুপারিশও মন্ত্রণালয় থেকে আসেনি। ফলে হেফাজতের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কোনো তথ্য আমার জানা নেই। মামলাগুলো প্রত্যাহারের বিষয়ে রাজনৈতিক কোনো সিদ্ধান্ত আছে কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়টিও আমার জানা নেই।
হেফাজত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহারের তৎপরতা সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল যুগান্তরকে বলেন, অভিযুক্তরা খুব কম ক্ষেত্রেই তাদের দোষ স্বীকার করেন। বর্তমানে বিষয়টি (মামলা) চলে গেছে বিচার প্রক্রিয়ায়। কাজেই বিচার প্রক্রিয়াকে তার নিজস্ব গতিতেই চলতে দেয়া উচিত।
যদি তারা (হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মী) অপরাধ না করেন, তাহলে তদন্তে তা বেরিয়ে আসবে। আগে থেকে মামলা প্রত্যাহারের সংস্কৃতিটা সুস্থ না। আমরা চাই, একটা সুষ্ঠু প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই তা প্রমাণিত কিংবা অপ্রমাণিত হোক কে দোষী অথবা কে দোষী নয়। আর এটাই সংস্কৃতি হওয়া উচিত। মামলা প্রত্যাহারের দাবি করে, জোর খাটিয়ে কিংবা প্রভাব খাটিয়ে মামলা প্রত্যাহার করানোর যে সংস্কৃতি আমাদের দেশে চালু আছে, মূলত এটাই আমাদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে। আমাদের বিচারহীনতার সংস্কৃতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, ওই সময়ের সহিংসতার ঘটনায় যেসব মামলা করা হয়েছিল, সেসব ঘটনায় মাঠপর্যায়ে কার কী ভূমিকা ছিল, তাদের পরিচয় কী- এ সম্পর্কে নিশ্চিত না হওয়ায় মামলার তদন্ত এখনও শেষ হয়নি।
তদন্তাধীন মামলার মধ্যে এসআই শাহজাহান হত্যা ও ট্রাফিক পুলিশ বক্সে আগুন দিয়ে পুলিশের এক সদস্যকে হত্যাচেষ্টার মামলা রয়েছে। এসআই শাহজাহান হত্যা মামলায় গ্রেফতার হওয়া একজন আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে বিভিন্ন সংগঠনের নেতাদের নাম এসেছে। কাদের নির্দেশে এ হত্যাকাণ্ড হয়, তাদের নাম এসেছে। কিন্তু ঘটনাস্থলে কারা ছিল, সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর মতিঝিলে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশের দিন মতিঝিলসহ আশপাশে ব্যাপক তাণ্ডব চালানো হয়। এদিন ওই সহিংসতা নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ কয়েকটি স্থানেও ছড়িয়ে যায়। রাজধানীর মতিঝিল, পল্টন ও আশপাশের কয়েকটি এলাকায় ভাংচুর ও আগুন দেয়ার একপর্যায়ে হেফাজত কর্মীরা মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয়।
তবে রাতে অভিযান চালিয়ে পুলিশ ও র্যাব তাদের মতিঝিল থেকে তাড়িয়ে দেয়। সমাবেশের পরবর্তী সময়ে বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ জানায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওই অভিযানে ৬১ জন হেফাজত কর্মী নিহত হয়েছে। তবে পরে প্রমাণিত হয় ওই তালিকা সঠিক নয়। পুলিশ অধিকারের ওই তালিকার ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, ওই দিন পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে রাজধানীতে ১৩ জন নিহত হন।
হেফাজতের পক্ষ থেকে তাদের কর্মী নিহত হওয়ার দাবি করা হলেও সংগঠনের পক্ষ থেকে কোনো মামলা করা হয়নি।
ওই দিনের ঘটনায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও বাগেরহাটে মোট ৭০টি মামলা করা হয়। রাজধানীতে দায়ের করা ৫৩টি মামলার মধ্যে রমনা থানায় ৩টি, শাহবাগ থানায় ৪টি, কলাবাগান থানায় ২টি, শেরেবাংলা নগর থানায় ১টি, মতিঝিল থানায় ৬টি, পল্টন থানায় ৩৩টি, রামপুরা থানায় ১টি ও যাত্রাবাড়ী থানায় ৩টি মামলা হয়। এতে হেফাজতের অর্ধশতাধিক কেন্দ্রীয় নেতাসহ কয়েক হাজার আসামি করা হয়।
রাজধানীতে দায়ের করা মামলাগুলোর মধ্যে রমনা থানার ১টি, শাহবাগ থানার ১টি ও কলাবাগান থানার ২টি মামলায় চার্জশিট দেয়া হয়েছে। এছাড়া নারায়ণগঞ্জের ৯টি মামলার মধ্যে ৭টি মামলায় চার্জশিট, চট্টগ্রামের ৩টি মামলা তদন্তাধীন ও বাগেরহাটের ৫টি মামলাই বিচারাধীন রয়েছে। ঢাকার সব মামলাতেই হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরীকে প্রধান আসামি করা হয়।
এছাড়া ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ নেজামী এবং যুবদল, ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবির নেতাকর্মীদের মামলার আসামি করা হয়। তবে কোনো মামলাতেই হেফাজতের আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফীকে আসামি করা হয়নি।
আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি তাপস কুমার পাল যুগান্তরকে বলেন, আদালত বিস্ফোরক মামলায় হেফাজতের নেতাসহ ২৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন। এখন ওই আসামিদের গ্রেফতার করে আদালতে উপস্থাপনের দায়িত্ব পুলিশের।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ শাখার উপকমিশনার (ডিসি) মাসুদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, সাধারণত গ্রেফতারি পরোয়ানা স্থায়ী ঠিকানায় পাঠানো হয়। এছাড়া হেফাজতের কোন কোন নেতার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি রয়েছে- বিষয়টি খোঁজ নিয়ে জানতে হবে।
এদিকে ওই তাণ্ডবের সঙ্গে হেফাজতের কোনো নেতাকর্মী জড়িত নয় বলে দাবি করেছেন সংগঠনটির যুগ্ম মহাসচিব ও ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ।
তিনি যুগান্তরকে বলেন, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ অরাজনৈতিক একটি সংগঠন। হেফাজত কোনো মারামারি-হানাহানি, কাটাকাটি, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, সহিংসতায় বিশ্বাসী নয়।
হেফাজত সব সময় জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের পক্ষে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষে। মানুষের ঈমান-আকিদা, সভ্যতা-সংস্কৃতি সংরক্ষণে, মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধের হেফাজতের লক্ষ্যে সব সময় কাজ করে।
ওই দিনের ঘটনায় (৫ মে) কোনো মারামারি-হানাহানি-কাটাকাটি, গাছ কাটা অথবা অগ্নিসংযোগ করা অথবা গাড়ি ভংচুর- এসবের কোনোটির সঙ্গেই হেফাজতের কোনো নেতা বা কর্মীর ন্যূনতম কোনো যোগাযোগ বা সংশ্লিষ্টতা ছিল না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পুরো জগৎবাসী এটা (তাণ্ডব) দেখেছেন। পুরো বাংলাদেশ দেখেছে কারা ওই কাজ করেছে।
বিভিন্ন মিডিয়ায় সেসব ভিডিও ফুটেজও আছে। এ বিষয়ে বারবার দাবি জানানো হয়েছে, যেন ভিডিও ফুটেজগুলো দেখে অপরাধীদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়। এতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। যে মামলাগুলো হয়েছে, সেগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল। যারা মামলাগুলো করেছে (সরকার), তারা ভুল বুঝে ভুল সিদ্ধান্ত হিসেবে এ মামলাগুলো করেছিল।
আশা করছি, ভুল করার ওই উপলব্ধি থেকেই মামলাগুলো শেষ করার জন্য একটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। সরকারের পক্ষ থেকে মামলাগুলো প্রত্যাহারের বিষয়ে কোনো জবাব পেয়েছেন কি- জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকার সব সময় দেশের মানুষের লালিত স্বপ্ন, মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফল হয়- এমন উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে।
আশা করছি, সরকার এক্ষেত্রেও মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে এবং মিথ্যা যে মামলাগুলো করা হয়েছে, সেগুলো প্রত্যাহারের উদ্যোগ গ্রহণ করবে। হেফাজতে ইসলামের নেতাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর পুলিশ আপনাদের কাজে কোনো বাধা সৃষ্টি করছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আইনগত বিষয়কে আইনগতভাবেই মোকাবেলা করা উচিত। আমরা সেভাবেই মোকাবেলা করছি।
(প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন যুগান্তরের চট্টগ্রাম ব্যুরো, নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি ও বাগেরহাট প্রতিনিধি)যুগা