মাওলানা সাঈদীর খালাস চেয়ে যুক্তি পেশ করলেন খন্দকার মাহবুব হোসেন

ক্রাইমবার্তা রিপোট:মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলায় রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি শুরু হয়েছে। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ শুনানি গ্রহণ করেন। মাওলানা সাঈদীর পক্ষে শুনানি পেশ করেন বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন।

 

বিশাবালী হত্যা, গৌরাঙ্গ সাহার তিন বোনকে ধর্ষণ এবং ১০০ থেকে দেড় শ’ হিন্দুকে জোর করে ধর্মান্তকরণের অভিযোগ বিষয়ে যুক্তি পেশ করেছেন খন্দকার মাহবুব হোসেন। এ তিন অভিযোগে মাওলানা সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয় আপিল বিভাগ। আজ রিভিউ শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের যুক্তি উপস্থাপনের কথা রয়েছে।

আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে মাওলানা সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়। তবে মাওলানা সাঈদীর বিচারের জন্য গঠিত পাঁচ সদস্যের বেঞ্চের একজন সদস্য বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা ভিন্ন রায়ে মাওলানা সাঈদীকে সব অভিযোগ থেকে বেকসুর খালাস দিয়ে তাকে সম্পূর্ণ নির্দোষ ঘোষণা করেন।

মাওলানা সাঈদীর রিভিউ শুনানিতে তাকে খালাস দেয়ার পক্ষে ২৫ পৃষ্ঠার লিখিত যুক্তি জমা দেয়া হয়েছে আদালতে আজ শুনানির সময়। এতে মাওলানা সাঈদীকে খালাসের পক্ষে বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞার রায় থেকে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

আজ শুনানির শুরুতে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম প্রথমে কথা বলতে চাইলে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, আপনি বসেন। মামলা তো আসামি পক্ষের। আপনি তো ফাঁসি চেয়েছেন তাই না? আসামি খালাস পেয়ে গেলে তো আর তার ফাঁসি হবে না। আসল রিভিউ তো আসামি পক্ষের। তাতে আসামি খালাস পেলে তো আর আপনার রিভিউ থাকবে না।

এরপর খন্দকার মাহবুব উদ্দিন লিখিত যুক্তি থেকে বিশেষ বিশেষ অংশ পড়ে শোনান আদালতকে।

আদালতে জমা দেয়া লিখিত যুক্তিতে বলা হয়েছে, বিশাবালীর ভাই সুখরঞ্জন বালী বলেছেন তার ভাই হত্যার সাথে মাওলানা সাঈদী জড়িত নন। তিনি ২০১২ সালের ৫ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে ট্রাইব্যুনালের সামনে থেকে অপহরণ করে। এটি আদালতের বিবেচনায় নেয়া উচিত ছিল। ২০১৩ সালের ১৫ মে দৈনিক নিউএজ পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয় যে, সুখরঞ্জন বালী ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দমদম কারাগারে বন্দী রয়েছেন এবং বালী জানিয়েছেন তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপহরণ করে ভারতে পাঠিয়ে দিয়েছে। এরপর সুখরঞ্জন বালীর পরিবার কলকাতা হাইকোর্টে আবেদন করেন বালীকে দেশে না পাঠানোর জন্য। কারণ বাংলাদেশে তার জীবনের ঝুঁকি রয়েছে। পরে এ মামলা ভারতের সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায় এবং সুপ্রিম কোর্ট বালীকে দেশে না পাঠানোর আদেশ দেন। এ বিষয়ক যাবতীয় পেপারকাটিং আসামি পক্ষ আপিল বিভাগে জমা দিয়েছে। কিন্তু আপিল বিভাগের রায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে এ বিষয়ক কোনো ডকুমেন্ট আমলে নেননি।

গৌরাঙ্গ সাহার তিন বোনকে ধর্ষণ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের ১, ২, ৩, ৪ এবং ৫ নং সাক্ষী একটি শব্দও বলেননি। গৌরাঙ্গ সাহার এলাকার লোক হওয়া সত্ত্বেও তারা এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ না করায় প্রমাণ করে এ অভিযোগ সত্য নয়। বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা তার রায়ে লিখেছেন ‘যদি সত্যিই গৌরাঙ্গ সাহার তিন বোনকে তিন দিন ক্যাম্পে আটকে রেখে পাকিস্তান আর্মি কর্তৃক ধর্ষণের ঘটনা ঘটে থাকে তাহলে রাষ্ট্রপক্ষের ১, ২, ৪, ৬, ৮, ৯, ১০, ১১ এবং ১২ নং সাক্ষীকে তা না বলার কথা নয় গৌরাঙ্গ সাহার।’

গৌরাঙ্গ সাহা বলেছেন- ১৯৭১ সালে তার বয়স ছিল ২৭ বছর। কিন্তু তার ভোটার পরিচয়পত্র এবং জাতীয় পরিচয়পত্রে তার জন্ম তারিখ লেখা ১৯৬৩ সাল। সে হিসাবে ১৯৭১ সালে তার বয়স হয় ৮ বছর। এ অবস্থায় তার ছোট তিন বোনকে ধর্ষণের ঘটনা অসত্য। বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা তার রায়ে লিখেছেন ‘বয়সের ব্যবধান ২/১ বা তিন বছরের হতে পারে। কিন্তু ১৯ বছরের ব্যবধান বিশ্বাসযোগ্য নয়। তার বোনরা ১৯৭১ সালে বড় ছিল এটি প্রমাণ করতে এটা বলেছেন তিনি।’

লিখিত যুক্তিতে বলা হয় সেফহাউজ রেজিস্ট্রার থেকে দেখা যায় মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ার কারণে গৌরাঙ্গ সাহাকে পুরস্কৃত করা হয়েছে।

লিখিত যুক্তিতে বলা হয় মাওলানা সাঈদী ১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত যশোরে ছিলেন, পিরোজপুর নয়। মাওলানা সাঈদীর পক্ষে পাঁচজন সাক্ষীর সাক্ষ্যে তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এ ছাড়া রাষ্ট্রপক্ষের ২৪ নং সাক্ষীর সাক্ষ্যেও তা প্রমাণিত। কাজেই মে, জুন ও জুলাই মাসে পিরোজপুর সংঘটিত অপরাধের সাথে তার জড়িত থাকার অভিযোগ সত্য নয়। বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা এসব সাক্ষ্য আমলে নিয়েছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে এটি বিবেচনায় না নিয়ে বড় ধরনের ভুল করেছেন।

সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্য এবং তদন্ত কর্মকর্তার কাছে গণেশ সাহার সাক্ষ্য বিবেচনায় নেয়ার ক্ষেত্রেও বড় ধরনের ত্রুটি। গণেশ চন্দ্র পরে রাষ্ট্রপক্ষ ত্যাগ করে মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন এবং কোর্টে তিনি বলেছেন তিনি তদন্ত কর্মকর্তার কাছে কোনো জবানবন্দী দেননি।

এমনিভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে পিরোজপুর জেলার ইতিহাস এবং স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র বই দু’টিও বিবেচনায় নেয়ার ক্ষেত্রে ভুল করেছেন। বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা এ বই দু’টিকে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাসঙ্গিক দলিল হিসেবে গ্রহণ করেছেন। পিরোজপুর জেলার ইতিহাস বইয়ে রাজাকার এবং শান্তি কমিটির তালিকায় মাওলানা সাঈদীর নাম নেই।
এ ছাড়া মেজর জিয়াউদ্দিন রচিত ‘মুক্তিযুদ্ধে সুন্দরবনের সেই উন্মাতাল দিনগুলি’ বইটিও কোনো বিবেচনায়ই নেননি সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিরা। এ বইয়ে পিরোজপুর এবং তার আশপাশ এলাকায় ১৯৭১ সালের নৃশংসতার বিবরণ থাকলেও মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। মেজর জিয়াউদ্দিন ছিলেন সুন্দরবন সাবসেক্টর ক্যাম্পের কমান্ডার। বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা তার রায়ে বলেছেন, মাওলানা সাঈদী রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন এবং এ হিসেবে তিনি যেসব অপরাধ করেছেন তা প্রমাণের জন্য মেজর জিয়াউদ্দিন ছিলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একজন সাক্ষী। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ কর্তৃক তার সাক্ষ্য না নেয়ায় মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ বিষয়ে বিরূপ অবস্থার সৃষ্টি করেছে।

খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, মাওলানা সাঈদী ১৯৭১ সালে মধ্য জুলাই পর্যন্ত যে পিরোজপুরে ছিলেন না তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণে সক্ষম হয়েছে। তিনি পিরোজপুর ছিলেন না এ মর্মে রায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিরা কোনো শক্তিশালী ভিত্তি তুলে ধরতে পারেননি।

খন্দকার মাহবুব হোসেন যুক্তি উপস্থাপন শেষে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, মাওলানা সাঈদী ওয়াজ করার জন্য পরিবার নিয়ে যশোরে বাসা ভাড়া করে ছিলেন তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। সাধারণত শীতকালে আমাদের দেশে ওয়াজ হয়। আপনারা যে সময়ে তার যশোর থাকার কথা বলছেন তা বর্ষাকাল। খন্দকার মাহবুব হোসেনকে প্রশ্ন করে তিনি বলেন, বর্ষাকালে কি ওয়াজ হয়? এখন কি বাংলাদেশে ওয়াজ হচ্ছে? মার্চ এপ্রিল মে মাসে ওয়াজ হয় কি না বলেন। যুদ্ধের সময় ওয়াজ মাহফিল করার জন্য পরিবার নিয়ে যশোর গিয়ে বাসা ভাড়া থাকবেন তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। আজকের দিনে কি কেউ কোথাও হোটেল বা বাসা ভাড়া করে থাকে ওয়াজ করার জন্য?

এ সময় তিনি অ্যাটর্নি জেনারেলকে লক্ষ্য করে বলেন, মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য যারা দায়িত্বে রয়েছেন তারা অনেকে সরাসরি পাকিস্তানপন্থী। মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে যে খেলা হচ্ছে তা বলার নয়।

এরপর তিনি বলেন, আমরা সাধারণত আপিলে ফাঁসির রায় বহাল রাখি। আপনাদেরটায় রাখা হয়নি। আমরা সাক্ষী প্রমাণ ছাড়াও সামগ্রিক বিষয় বিবেচনায় নিয়েছি। মামলা রিভিউ হলেই যে ফেলে দেবো তা নয়। আমরাই তো রিভিউ করা বিষয়ে রায় দিয়েছি। আমরা চাই যেন প্রহসন না হয় বিচারে।

২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মাওলানা সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেয় ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।

২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন মাওলানা সাঈদীকে।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে মাওলানা সাঈদীকে মোট আটটি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। এর মধ্যে দু’টি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয়। অপর ছয়টি অভিযোগে কোনো সাজা উল্লেখ করেননি ট্রাইব্যুনাল। ১৯৭১ সালে ইব্রাহীম কুট্টি এবং বিশাবালীকে হত্যার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল।

আপিল বিভাগের রায়ে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে বিশাবালী হত্যার অভিযোগে আমত্যৃ জেল এবং ইব্রাহিম কুট্টি হত্যার অভিযোগে ১২ বছর কারাদণ্ড দেয়া হলো। আপিল বিভাগের রায়ে বিশাবালী হত্যাকাণ্ডসহ মোট তিনটি পৃথক অভিযোগে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয় মাওলানা সাঈদীকে। অপর যে দু’টি অভিযোগে মাওলানা সাঈদীকে আমৃত্যু জেল দেয়া হয় তা হলো গৌরাঙ্গ সাহার তিন বোনকে পাকিস্তান আর্মির হাতে তুলে দেয়া এবং তিন দিন ক্যাম্পে আটকে রেখে ধর্ষণ ও ১০০ থেকে দেড় শ’ জনকে জোর করে ধর্মান্তকরণ।

আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে উভয় পক্ষ রিভিউ আবেদন করে। রাষ্ট্রপক্ষ আমৃত্যুর পরিবর্তে মৃত্যুদণ্ড বহাল চেয়ে এবং মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সব অভিযোগ থেকে খালাস চেয়ে পুনরায় আবেদন করা হয়।

২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের রায়ের লিখিত কপি প্রকাশের পর ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে রিভিউ আবেদন দায়ের করে উভয় পক্ষ।

রিভিউ শুনানির জন্য প্রধান বিচাপরতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে গঠিত পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেনÑ বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হুসেইন হায়দার।

Please follow and like us:

Check Also

আলিপুরে চেয়ারম্যান প্রার্থী জিয়ার মোটর সাইকেল বহরে বোমা হামলা, ৫জন আহত

নিজস্ব প্রতিনিধি: সন্ত্রাসী জনপদ আলিপুরে চেয়ারম্যান প্রার্থী জিয়াউল ইসলাম জিয়ার মোটর সাইকেল বহরে বোমা হামলা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।