১৮৮টি ইটভাটায় বছরে ৫শ’ একর ফসলি জমি বিনষ্ট

Matlob-Itevataজাহাঙ্গীর আলম কবীর: জেলার ইট পোড়ানোর কারণে মূল্যবান মাটির উপরিভাগ বা টপসয়েল নষ্ট হচ্ছে। সরকারি কঠোর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও কৃষি জমির মাটি কেটে ইট ভাটার মাটি সংগ্রহ করা হচ্ছে। এই জেলার জনসংখ্যা বাড়লেও বাড়ছে না ভূমির পরিমাণ। কিন্তু সেই ভূমি হরহামেশাই নষ্ট করা হচ্ছে। প্রতিবছর নিবন্ধিত ৮৮টিসহ মোট ১৮৮টি ইটভাটায় দেড় কোটি কাদার ইট পোড়াতে প্রতিবছর ৫০০ একর ফসলি জমি বিনষ্ট হচ্ছে। ফসল উপযোগী মাটির উপরিভাগ ব্যবহার করা হচ্ছে ইটের উপকরণ বা কাঁচামাল হিসাবে। তাছাড়া যে জমিতে ইটভাটা করা হয় এবং যে জমির টপসয়েল নেয়া হয় সেখানে ৫০ বছরেও ভাল ফসল উৎপাদনের কোনও সম্ভবনা থাকে না।

কৃষি জমিতে ইটভাটা স্থাপনে ভূমি মন্ত্রণালয়ের কঠোর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও এ জেলায় তা উপেক্ষিত হচ্ছে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের বিধান অনুযায়ী ইটভাটা অবশ্যই যে কোনও নদীর তীরে করতে হবে এবং এতে কোনওমতে এক দশমিক পাঁচ একরের বেশী জমি ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু জেলার অধিকাংশ ইটভাটাই মূলত উর্বর জমিতে গড়ে উঠেছে এবং নির্ধারিত জমির চেয়ে তিন-চার গুণ বেশী জমিতে সম্প্রসারিত হয়েছে। উর্বর জমি ছাড়াও জনবসতি রয়েছে এমন এলাকাতেও গড়ে তোলা হচ্ছে ইটভাটা।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, নদীর তীরে ইটভাটা তৈরী করা হলে এবং নদীর মাটি ব্যবহার করা হলে একদিকে নদীর নাব্যতা বাড়তো, অন্যদিকে ফসলি জমির টপসয়েল নষ্ট হতো না। কিন্তু জেলার শতকরা ৮০ ভাগ ইটভাটাই কৃষি জমিতে স্থাপন করা হয়েছে। তাদের মতে,  ১৯৭১ সালে জেলার মানুষের মাথাপিছু জমির পরিমাণ ছিল ২৮ কাঠা। ২০০২ সালে মাথাপিছু জমির পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ১৩ কাঠায়। ২০২০ সালে মাথাপিছু জমির পরিমাণ কমে হবে ৮ দশমিক ৮ কাঠা। শতকরা ২১ ভাগ বন, নদী ও জলাভূমি বাদ দিলে জমির পরিমাণ আরও কমে যাবে।

২১-শে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক রোকনুদ্দৌল্লাহ বলেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে এমনিতেই যেখানে মাথাপিছু জমির পরিমাণ কমছে সেখানে ইটভাটাগুলোতে বছরে দেড় কোটি ইট পুড়িয়ে কৃষি জমি নষ্ট করা হচ্ছে। তিনি বলেন, আবাদযোগ্য ভূমিকে অপরিকল্পিতভাবে অনাবাদী জমিতে রূপান্তর করার অধিকার কারও নেই।

কৃষি বিভাগের সূত্র মতে, টপসয়েলে ফসল উৎপাদনের জন্য যে ১৬টি উপাদান অতিপ্রয়োজনীয় এবং যাতে ফসল ও চারার জীবনচক্র পরিচালিত হয়, তা বিনষ্ট করে জমির বিপুল ক্ষতি করা হচ্ছে। জেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ৫০০ একর জমি আবাদের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। ইটভাটা করা জমিতে অন্তত ৫০ বছরে কোনও ফসল উৎপাদন করা যায় না। একথা ইটভাটা করা বিভিন্ন এলাকার কৃষকদের।

যে জমিতে ইটভাটা নির্মিত হয় এবং যে জমির উপরিভাগ কেটে ইট তৈরী করা হয়, সেখানে ফসল ফলাতে এক পুরুষ কেটে যাবে। এই মাটিতে পুকুর কাটলেও মাছ বড় হয় না বলে অনেকে অভিমত দিয়েছেন। ইটভাটা মালিকদের অভিমত, ইট তৈরীতে মাটির একমাত্র উপরিভাগই প্রয়োজন। এঁটেল দোআঁশ মাটিতে ইট ভাল হয়, যা মাটির উপরিভাগেই থাকে।

জেলার ভূমি খুবই উর্বর, যে কোনও জায়গায় বীজ লাগালে গাছ হয়। কিন্তু এই ভূমিকে যেভাবে যথেচ্ছ অপব্যবহার করা হচ্ছে তার নজির বিরল। প্রকৃতির দান এই মূল্যবান সম্পদকে মানুষ অবহেলা করছে বলে পরিবেশবিদরা মনে করেন। জানা যায়, ভাটাতে ইট পোড়ানোর ফলে প্রতিনিয়ত কার্বন-মনোক্সাইড, কার্বন-ডাই-অক্সাইডসহ অন্যান্য বিষাক্ত গ্যাস উৎপন্ন হচ্ছে। ইটভাটার চিমনিতে কোনও প্রকার ফিল্টার না থাকায় বিষাক্ত গ্যাস প্রতিদিনই বায়ুমন্ডলে ছড়িয়ে পড়ছে। তাছাড়া চিমনির উচ্চতা দেড়শ’ ফুট হবার কথা থাকলেও অধিকাংশ চিমনির উচ্চতা ১শ’ ২০ ফুটের মধ্যে। ইটভাটা থেকে নির্গত বিষাক্ত গ্যাসসমূহের মধ্যে থাকা সালফার-ডাই অক্সাইড প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানির সঙ্গে বিক্রিয়া করে সালফিউরিক এসিড হিসেবে বৃষ্টির পানির সঙ্গে মাটিতে নেমে আসেছে। ফলে জেলার মাটিতে এসিডিটির মাত্রা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় আবাদী জমির ফসলের অকালে হলুদ হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে।

ইটভাটার কারণে গ্রামাঞ্চল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে খেজুর, নারিকেল ও বট গাছ। জেলার এমন এলাকা খুবই কম আছে যেখানে এসব গাছের প্রাচুর্য ছিল না। ইটভাটার আগ্রাসনে গ্রামের মাঠ-ঘাট থেকে এসব বৃক্ষ হারিয়ে যেতে বসেছে। এই তিন প্রকার গাছের ফার্ণিচার হয় না বলে কদর ছিল কম। কিন্তু ইটভাটার মালিকরা এবস গাছের কদর বাড়িয়ে দিয়েছে। আশির দশক থেকে জ্বালানি হিসেবে ইটভাটাতে এসব গাছের ব্যবহার শুরু হয়। ইটভাটার মালিকরা প্রতি হাত নারকেল ও খেজুর গাছ কিনে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার শুরু করে। গ্রামের নি¤œবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষ অভাব ও আর্থিক সংকটের সময় এসব পুরোনো গাছ বিক্রি করে। চলে যায় ইটভাটায়। সাতক্ষীরার বিভিন্ন এলাকায় খেজুর ও নারিকেল গাছের সংখ্যা ইটভাটার কারণে অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে। ফলে খেজুর রস ও গুড়ের দাম বেড়েছে আনুপাতিক হারে চার গুণ। দাম বেড়েছে নারিকেলেরও। এর কারণে হিসেবে ইটভাটাতে নারিকেল ও খেজুর গাছ উজাড় করাকে দায়ি করা হয়।

Check Also

আশাশুনি উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী শহিদুল ইসলামের গণসংযোগ 

এস, এম মোস্তাফিজুর রহমান।। আসন্ন আশাশুনি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী এ্যাড. শহিদুল ইসলামের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।