ধর্ষক তুফানের ভাইয়ের বেপরোয়া জীবন ৫ বছর ‘পলাতক’ হলেও প্রকাশ্যে যুবলীগ নেতা মতিন সরকার সংগঠন থেকে সাময়িক বহিষ্কার * একাধিক বৈঠক করেছেন ডিসি এসপির সঙ্গেও * ৫ বছর ধরে সরকারি খরচে আইনজীবী নিয়োগ

2_144676_53945_1501647724বগুড়ার আলোচিত ধর্ষক ও নারী নির্যাতনকারী তুফান সরকারের বড় ভাই শহর যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক মতিন সরকার একাধিক হত্যা মামলার আসামি। আবু নাসের উজ্জ্বল হত্যা মামলায় পাঁচ বছর আগে গ্রেফতার হলেও অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি জামিনে মুক্তি পেয়ে যান। এরপর মামলায় হাজিরা না দেয়ায় তার বিরুদ্ধে জারি হয় গ্রেফতারি পরোয়ানা। এরপর থেকেই তিনি ‘পলাতক’। পুলিশ ও আদালতের দৃষ্টিতে মতিন সরকার পলাতক হলেও এলাকায় তিনি প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। শাসক দলের সহযোগী সংগঠন যুবলীগের এই নেতা প্রকাশ্যে ডিসি, এসপি ও দলীয় নেতাদের সঙ্গে সভা-সমাবেশেও যোগ দিয়েছেন। গত বছর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান। আদালতের দৃষ্টিতে পলাতক দেখানোর কারণে ৫ বছর ধরে সরকারি খরচে তার জন্য নিয়োগ করা হয়েছে আইনজীবী। এজন্য সরকারের তহবিল থেকে বিপুল অংকের অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, সরকারি কৌঁসুলিদের মোটা অংকের ঘুষ দিয়ে মতিন সরকার নিজেকে পলাতক হিসেবে আদালতে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। এদিকে মঙ্গলবার বিকালে যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর বরাত দিয়ে জেলা যুবলীগ থেকে মতিন সরকারকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। কিশোরী ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় রিমান্ডে থাকা তুফানের ভাই মতিন সরকারের এসব অপকর্ম এখন এলাকায় মানুষের মুখে মুখে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারি কৌঁসুলিদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। জানতে চাইলে বগুড়ার পিপি (সরকারি কৌঁসুলি) আবদুল মতিন জানান, মতিন সরকার প্রকাশ্যে ডিসি, এসপিসহ অনেকের সঙ্গে বৈঠক করছেন। তার দিক থেকে কোনো গাফিলতির কথা অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘হয়তো পুলিশকে ম্যানেজ করে মতিন সরকার আদালতে পলাতক রিপোর্ট দেয়া হয়েছে। এদিকে আবদুল মতিন সরকারকে সংগঠন থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আবদুল মতিন ১৮-২০ বছর আগেও যুবলীগের সাধারণ কর্মী ছিলেন। পরে তিনি অস্ত্রধারী ক্যাডার বনে যান। ২০০০ সালের দিকে শহরের নুরানী মোড় এলাকায় সদর ফাঁড়ির টিএসআই তাকে গুলিভর্তি একটি নাইন এমএম পিস্তলসহ গ্রেফতার করেন। ২০০৪ সালের দিকে ওই মামলায় তার ২৭ বছর কারাদণ্ড হয়। কিছুদিন জেলে থাকার পর উচ্চ আদালতে মামলাটি স্থগিত হলে তিনি বেরিয়ে আসেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে মতিন রাজনীতিতে সক্রিয় হন। এরপর তিনি সংগঠনকে ব্যবহার করে মাদক, চাঁদাবাজি, জুয়াসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। জায়গা দখলেও তার জুড়ি নেই। এভাবে খুব অল্প সময়ে কোটিপতি হয়ে যান। নাম পরিবর্তন করে হয়ে যান ‘আবদুল মতিন সরকার’। বর্তমানে বিলাসবহুল গাড়িতে চলাফেরা করেন। বগুড়া ও ঢাকায় রয়েছে একাধিক বাড়ি বা ফ্ল্যাট।

পুলিশ ও আদালতের তথ্য অনুসারে মতিনের নামে ৩-৪টি হত্যা মামলা রয়েছে। ১৯৯৮ সালের দিকে শহরের নুরানী মোড় এলাকায় রসুল, ২০০১ সালে চকসূত্রাপুরে আবু নাসের উজ্জ্বল, ২০১১ সালে মাটিডালি বাণিজ্য মেলায় শফিক চৌধুরী এবং ২০১৫ সালে চকসূত্রাপুরে এমরান হত্যার অভিযোগ ওঠে। ২০১২ সালে র‌্যাব-১২ বগুড়া ক্যাম্পের সদস্যরা তাকে বিপুল পরিমাণ মাদক ও নগদ টাকাসহ গ্রেফতার করেছিল। উজ্জ্বল হত্যা মামলা (৩০২/০৯) প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত এবং এমরান হত্যা মামলা (৩৫/১৫) দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। ২০০১ সালের ২৮ অক্টোবর শহরের চকসূত্রাপুর এলাকায় আবু নাসের উজ্জ্বল নামে এক যুবককে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। এ ব্যাপারে তার বাবা সদর থানায় আবদুল মতিন, আবু তালহা ঠাণ্ডু (পরে নিহত) ও শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। প্রথমে সদর থানা, ডিবি পুলিশ ও সিআইডি মামলাটি তদন্ত করে। তিন দফা আদালতে চার্জশিট দেয়া হয়। শেষ চার্জশিটে মতিনের নাম থাকে। পুলিশ মতিনকে গ্রেফতার করলেও কয়েকদিন পর জামিনে ছাড়া পান। হাজির না হওয়ায় পলাতক আসামি হিসেবে ২০১২ সালের ২৫ জুন তার পক্ষে অ্যাডভোকেট তাজউদ্দিনকে ‘স্টেট ডিফেন্স’ নিয়োগ করা হয়। গত ৫ বছর তিনি সরকারি খরচে মতিনের পক্ষে মামলা পরিচালনা করছেন। আগামী ৯ আগস্ট মামলার পরবর্তী দিন ধার্য আছে। আদালতের খাতায় পলাতক থাকলেও মতিন প্রকাশ্যে সভা-সমাবেশে অংশগ্রহণ করছেন। জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারের সঙ্গে অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন। গত বছরের ১১ জুন তিনি ঢাকায় এক মন্ত্রীকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান। ১৩ ফেব্রুয়ারি বর্তমান পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামানের সঙ্গে সোনাতলায় ফুটবল টুর্নামেন্টের অনুষ্ঠানে গরু বিতরণ করেন। কয়েকদিন আগেও পুলিশ সুপারের সঙ্গে এক অনুষ্ঠানে চেক বিতরণ করতে দেখা যায় তাকে। ৫ জুলাই শহরের চকযাদু রোডে জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও ব্যবসায়ী মো. মমতাজ উদ্দিনের সঙ্গে তার ভাই তুফান সরকারের স্যানেটারি স্টোর উদ্বোধন করেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মমতাজ উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, আমি সেখানে গিয়েছিলাম ব্যবসায়ী হিসেবে। রাজনৈতিক নেতা হিসেবে নয়। এতে আমার কোনো দোষ আছে বলে মনে করি না। বগুড়ার সাবেক ডিসি আশরাফ উদ্দিনের সঙ্গে মতিন সরকারকে সভায় যোগ দিতে দেখা গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক আইনজীবী জানান, মামলার তারিখেও মতিন সরকার আদালতে আসেন। সরকারি কৌঁসুলিদের মোটা অংকের টাকা ঘুষ দিয়ে পলাতক হিসেবে আছেন। আর সরকার অর্থ ব্যয় করে তার পক্ষে স্টেট ডিফেন্স রেখেছে। বগুড়ার প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে এপিপি রেজাউল হক জানান, মতিন পলাতক নয়- এটা প্রশাসন জানে। আদালত তাকে পলাতক দেখালে তাদের কী করার আছে। এ প্রসঙ্গে পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান জানান, হত্যা মামলায় আবদুল মতিন সরকার পলাতক থাকা এবং ২০১২ সালে তার পক্ষে স্টেট ডিফেন্স নিয়োগ করার বিষয়টি তার জানা নেই। তিনি বলেন, খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বগুড়া জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম ডাবলু জানান, ছাত্রী ধর্ষণ, নির্যাতন ও মাকেসহ তাকে ন্যাড়া করে দেয়ার ঘটনায় শহর যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক আবদুল মতিন সরকারকে সংগঠন থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। এর আগে তুফান বাহিনীর এসব বর্বরোচিত ঘটনায় জেলা যুবলীগের পক্ষে নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেয়া হয়েছিল।

Please follow and like us:

Check Also

ঈদে স্ত্রীর জন্য মাংস কিনতে না পারায় দিনমজুর স্বামীর আত্মহত্যা

জামালপুরের বকশীগঞ্জে স্ত্রীর জন্য মাংস কিনতে না পেরে চিঠি লিখে আত্মহত্যা করেছেন হাসান আলী (২৬) …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।