চার লাখ টাকা দিয়েও রেহাই পাননি পাঁচজন

রাজধানীর পল্টন এলাকা থেকে পাঁচজনকে ধরে নিয়ে বেধড়ক মারধরের পর তাদের স্বজনের কাছ থেকে চার লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ডিবি পুলিশের অস্ত্র উদ্ধার প্রতিরোধ টিম (পশ্চিম)। ওই টিমের প্রধান সহকারী কমিশনার (এসি) মাহমুদ নাছের জনি।
পাসপোর্ট জালিয়াতির অভিযোগে ১৯ জুন তাদেরকে আটক করে চোখ বেঁধে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়ার পর পঁচিশ লাখ টাকা দাবি করা হয়। টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় আটককৃতদের বেধড়ক মারধর করেন ডিবি সদস্যরা।

মারধরে একজনের কান ও আরেকজনের হাত ফেটে যায়। নির্যাতন থেকে রেহাই পেতে আটক ব্যক্তিরা বাধ্য হয়ে স্বজনের মাধ্যমে ডিবির ওই টিমকে চার লাখ টাকা দেন। কিন্তু এতেও মন গলেনি টিম সদস্যদের। তাই টাকা নিয়েও পাসপোর্ট ও ভিসা জালিয়াতির মামলা দিয়ে কোর্টের মাধ্যমে তাদের জেলে পাঠানো হয়।

নির্যাতনের মাত্রা এতই নির্মম ছিল যে, জেলে বসেই তাদের চিকিৎসা নিতে হয়েছে। ১১ দিন জেল খাটার পর ২ জুলাই মুক্তি পান তারা।

এই পাঁচজন হলেন : ধিরাজ বাবু, জসিম উদ্দীন, আবুল হাসান, রাজবীর ও মাঈনুদ্দিন। তারা ট্রাভেল এজেন্সি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তবে টাকা নেয়া ও মারধরের বিষয়টি অস্বীকার করছে ডিবি পুলিশ। যদিও আটক ব্যক্তিদের কাছ থেকে ডিবি পুলিশ কিভাবে কত টাকা নিয়েছে তার কথোপকথন এবং দেনদরবার সংক্রান্ত ভিডিও ও স্থিরচিত্র যুগান্তরের কাছে সংরক্ষিত আছে।

ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে নির্যাতনের শিকার মাঈনুদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, ‘১৯ জুন রাতে পল্টন কমিউনিটি সেন্টার মার্কেটের নিচ থেকে ডিবির একটি টিম আমাদের পাঁচজনকে আটক করে। আমাদের সঙ্গে ওই মার্কেটের ইমামও ছিলেন। পরদিন সকালে আমাদের কাছে ২৫ লাখ টাকা দাবি করে বলা হয়, এই টাকা দিলে আমাদের ছেড়ে দেয়া হবে। টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করতেই আমাদের ওপর চরম নির্যাতন নেমে আসে। মারধরের একপর্যায়ে টাকার ব্যাপারে আমাদের ফোন দিয়ে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তারা। বিষয়টি জানার পর আমাদের পরিবারের সদস্যরা ডিবিকে ওই দিনই চার লাখ টাকা দেন। টাকা নেয়ার পর ডিবি ইমামকে ছেড়ে দেয়, কিন্তু আমাদের না ছেড়ে উল্টো পল্টন থানায় জালিয়াতি মামলা দিয়ে আদালতে চালান করে দেয়। মামলায় জাল ভিসা ও পাসপোর্টের কথা উল্লেখ করা হয়েছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।’

মাঈনুদ্দিন জানান, মারধরে ধিরাজ বাবুর কান ও রাজবীরের হাত ফেটে যায়। অন্যদের শরীরে এখনও মারের কাল দাগ রয়েছে।

নির্যাতনের শিকার আরেকজন আবুল হাসান যুগান্তরকে বলেন, ‘ডিবির হাতে কেউ আটক হলে তদবির করা উচিত না। তদবির করলেই তারা সুযোগ পেয়ে যায়। বেশি মারধর করে বেশি টাকার লোভে। আমাদের আটকের পর ব্যাপক মারধর করা হয় টাকার জন্য। টাকা দিয়েও কাজ হয়নি। আমাদের মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে পাঠানো হয়। নির্যাতন নির্মম ছিল যে, জেলে গিয়েও আমাদের চিকিৎসা নিতে হয়েছে। এখনও চিকিৎসা নিচ্ছি।’

ট্রাভেল এজেন্সির মালিক ধিরাজ বাবুর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি যুগান্তরের অফিসে এসে কথা বলবেন বলে জানান। পরবর্তী সময়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথমে কিছুই বলতে রাজি হননি। একপর্যায়ে বলেন, ওই দিনের কোনো ঘটনাই প্রকাশ করতে চাই না। যা হয়েছে সেটা বলে আর কি লাভ হবে?’

১১ দিন জেল খেটে ২ জুলাই জামিন পান পাঁচজন। পরদিন মিন্টো রোডের গোয়েন্দা কার্যালয়ে ডিবির এসি মাহমুদ নাছের জনির সঙ্গে দেখা করতে যান মাঈনুদ্দিন, রাজবীর ও আবুল হাসান। কিন্তু তার দেখা না পেয়ে ওই টিমের পরিদর্শক ও মামলার আইও মাজেদুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করেন তারা। ডিবির গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য বিভাগের সামনেই তাদের কথা হয়। এ সময় পরিদর্শক মাজেদুল ইসলামের সঙ্গে ডিবির আরও একজন সদস্য ছিলেন।

ডিবির সঙ্গে কি কথা হয়েছে, জানতে চাইলে মাঈনুদ্দিন, রাজবীর ও আবুল হাসান যুগান্তরকে বলেন, ‘আটকের সময় ডিবি আমাদের কাছ থেকে মোবাইল ফোনসহ বেশকিছু মালপত্র নিয়েছিল। সেগুলো নিতে এসেছি। কিন্তু তারা জানিয়েছে আজ দেয়া সম্ভব নয়, বুধবার আসেন।’

কথামতো বুধবার পাঁচজনের মোবাইলসহ অন্যান্য জিনিসপত্র হস্তান্তর করে ডিবি।

এ বিষয়ে জানতে গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক ও মামলার আইও মাজেদুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি মোবাইলে কথা বলতে রাজি হননি। কথা বলতে হলে সশরীরে আসতে হবে বলে জানান তিনি।

অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার (এসি) মাহমুদ নাছের জনি যুগান্তরকে বলেন, ‘যাদের ধরা হয়েছে তারা বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত। তাদের বিরুদ্ধে পাসপোর্ট এবং ভিসা জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে।’

মারধরের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘প্রথমত কোনো আসামি ধরা হলে তাদেরকে কমবেশি মারধর করা হয়। কিন্তু এমন কোনো আচরণ করা হয়নি যে, তাদের কান ফেটে রক্ত বের হবে।’

টাকা নেয়ার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি ওই তরিকার লোক নই।’

একপর্র্যায়ে পুলিশের ওই কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘এ নিউজের সঙ্গে পুরো পুলিশ বিভাগের ভাবমূর্তি জড়িত। এ জন্য আপনার (রিপোর্টার) সঙ্গে বসে বিষয়টি মীমাংসা করতে চাই। কিন্তু আপনি তো বসতেই চান না।’

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন যুগান্তরকে বলেন, ‘পুলিশের বিরুদ্ধে টাকা নেয়ার অভিযোগ নতুন কিছু নয়। অপরাধীদের পুলিশ ধরবে এটাই স্বাভাবিক। নিয়ম অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে কোর্টে চালান করা হয়েছে।’

মারধরের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সেটা আদালত দেখবেন। আদালত যখন কোনো আসামি গ্রহণ করেন তখন এগুলো দেখে নেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘আদালতে বিচারাধীন বিষয়ে নিউজ না করাই ভালো। কারণ এতে আপনাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নষ্ট হয়।’যুগান্তর

Please follow and like us:

Check Also

নতুন যোগ হচ্ছে ২০ লাখ দরিদ্র

মূল্যস্ফীতির কশাঘাত মোকাবিলায় ২০ লাখ ২৬ হাজার দরিদ্র মানুষকে নতুন করে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।