পাটের বাজারে ধস:পাচারের শঙ্কা

আবু সাইদ বিশ্বাসঃ সাতক্ষীরায় পাটের বাজারে ধস। পর্যাপ্ত উৎপাদন হলেও ন্যার্য মূল্য নিয়ে শঙ্কায় পাট চাষীরা। গত বছরের চেয়ে বাজারে পাটের দাম কম থাকায় দিশেহারা কৃষক। দেশী বাজারে মূল্য কম থাকায় পাট পাঁচারের আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইত্যোমধ্যে দেশীয় দালালদের মাধ্যমে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের সীমান্তে আনাগোনার খবর পাওয়া গেছে। চলতি মৌসুমে সাতক্ষীরায় ১১ হাজার ৬৩০ হেক্টর জমিতে পাট চাষ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। জেলার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৭ হাজার ৩৪৫ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। সাতক্ষীরায় পাট চাষে জড়িত অর্ধলক্ষাধিক চাষী পাট নিয়ে বিপাকে পড়েছে। jut sat 1
এখন সোনালী আঁশ পাট বেচা-কেনার উপযুক্ত সময়। এবার পাটের দাম হাট-বাজারে একটু বেশি হওয়ায় কথা ছিল। কৃষক তথা ব্যবসায়ীরা ভাল লাভের আশা করেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের লাভের গুড় পিঁপড়ায় খাচ্ছে। সিন্ডিকেটের কবলে পড়েছে পাট। দাম কম হওয়ার জন্য খুচরা ব্যবসায়ীরা দুষছেন পাইকারী ব্যবসায়ীদের আর পাইকারী ব্যবসায়ীরা দায়ী করছে খুচরা ব্যবসায়ীদের। প্রতিবেশি দেশ ভারতে পাটের দাম তুলনা মুলক বেশি। বাংলাদেশে প্রতিমণ পাট বিক্রি হচ্ছে এক হাজার থেকে ১২শ টাকার মধ্যে । অন্যদিকে একই পাট ভারতের বাজারে বিক্রি হচ্ছে ষোলশ থেকে দুই হাজার টাকার মধ্যে। যে কারণে পাট ভারতে পাচার হওয়ার আশঙ্কা করপা হচ্ছে।
ভারতের এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী আগে থেকে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের (পাট) সঙ্গে যোগসাজশ করে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে। ভারতীয় ওইসব ব্যবসায়ী বাংলাদেশ সীমানায় ঢুকে ব্যবসার নানা দিক দেখাশোনা করে এবং কোন পথ বা রুট দিয়ে তা নিবে সেটা পর্যবেক্ষণ করে গোপনে। সাধারণ কৃষক ও পাট ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ পাট সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে পাচার হয়ে যাচ্ছে প্রতিবেশি দেশ ভারতে। ভারতে লোকসংখ্যা বেশি বিধায় সেখানে পাটের চাহিদাও বেশি। সেই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে ভারতের ব্যবসায়ীরা। একটি সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবছর সীমান্তবর্তী জেলা সাতক্ষীরা, ঠাকুরগাঁও, রংপুর, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, যশোর, প্রভৃতি এলাকা দিয়ে প্রতিদিনই প্রচুর পরিমাণ পাট ভারতে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এক শ্রেণীর চোরাকারবারী এ দেশের হাট-বাজারে কৌশলে সিন্ডিকেট করে সেই পাট ক্রয় করে ভারতে পাচার করছে। ভারতে অবাধে পাট চলে যাওয়াতে দেশের রাষ্ট্রীয়ও পাটকলগুলোতে দেখা দিয়েছে চরম পাট সংকট। এসব মিল ভরা মওসুমে পাট কিনতে পারছে না। পাট রফতানিকারকরা বলেছেন, সরকার পাটপাচার রোধে অনতিবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলে এ দেশের প্রায় পুরো বাজারই চলে যাবে ভারতের দখলে বা নিয়ন্ত্রণে। পাকিস্তান, চীন, ভারত, প্রভৃতি দেশে বাংলাদেশের পাটের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। পাট পাচার রোধ করা না গেলে খুব শিগগিরই এসব দেশের বাজার আমরা হারাবো বলে জানা গেছে। শুধু পাটের বাজার নয় বরং পাটের বীজের বাজার, সারের বাজার ইত্যাদিও দখল করেছে ভারত। jute sat 3
চলতি মৌসুমে সাতক্ষীরায় সরকারি ও বেসরকারি মিলের কোনো ক্রয় কেন্দ্র নেই। সরকার পাটের মূল্য নির্ধারণ করে দেয়নি ফলে পাট চাষিরা তাদের উত্পাদিত পাটের ন্যায্যমূল্য হতে বঞ্চিত হচ্ছে। গত বছর পাটের চাহিদা ও মূল্য ভালো ছিল। তা দেখে চাষিরা পাট আবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু এবার সে মূল্য না পাওয়ায় হতাশ হয়েছেন চাষিরা। ক্রেতা না থাকায় দালাল, ফঁড়িয়া ও বেপারীরাই একমাত্র ভরসা। তারা তাদের ইচ্ছেমতো দরে পাট কিনছেন। ফলে উত্পাদন খরচও তুলতে পারছেন না কৃষক। ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় আগামীতে পাট চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন কৃষক। পাট চাষি আবদুল লতিফ জানান, পাটের বাজারে এমন ধস নামবে তা ভাবতেও পারিনি।
নিম্নমানের ভেজাল বীজ, প্রকৃতির বিরূপ প্রভাব এবং স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তাদের উদাসীনতার কারণে সাতক্ষীরায় পাটের ক্ষেত হুমকিতে ছিল।
বেশির ভাগ পাট ক্ষেত পোকার আক্রমণে আক্রান্ত হয়েছিল ।চলতি মৌসুমে সাতক্ষীরায় ১১ হাজার ৬৩০ হেক্টর জমিতে পাট চাষ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। জেলার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৭ হাজার ৩৪৫ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। তবে জেলার কৃষকরা বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা না করে পানি সেচ দিয়ে পাটের আবাদ করছে অনেক কৃষক।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, জেলার সদর উপজেলায় ৪ হাজার ৭৮০ হেক্টর জমি আবাদের লক্ষ্যমাত্রায় চাষ হয়েছে ৪ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে। কলারোয়া উপজেলায় ৩ হাজার ৯০ হেক্টর জমি আবাদের লক্ষ্যমাত্রায় চাষ হয়েছে ১ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে। তালা উপজেলায় ৩ হাজার ৫০ হেক্টর জমি আবাদের লক্ষ্যমাত্রায় চাষ হয়েছে ১ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে। দেবহাটা উপজেলায় ১৮৫ হেক্টর জমি আবাদের লক্ষ্যমাত্রায় চাষ হয়েছে ৩৫ হেক্টর জমিতে।
আশাশুনি উপজেলায় ১২০ হেক্টর জমি আবাদের লক্ষ্যমাত্রায় চাষ হয়েছে ১১০ হেক্টর জমিতে। শ্যামনগর উপজেলায় ০১ হেক্টর জমি আবাদের লক্ষ্যমাত্রায় কোন আবাদ হয়নি। এবং কালীগঞ্জ উপজেলায় ১৮৫ হেক্টর জমি আবাদের লক্ষ্যমাত্রায় চাষ হয়েছে ৩৫ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে।
কৃষি কর্মকর্তারা জানান, এখানে মৌসুমের শুরুতে বৈরী আবহাওয়ার কারণে বেগ পেতে হয় চাষিদের। আবার প্রচন্ড গরমের কারণে আবাদ কিছুটা বিলম্বে ।
এ ব্যাপারে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কাজী আব্দুল মান্নান বলেন, সাতক্ষীরায় খুব ভাল মানের পাট উৎপাদন হয়। এ বছর বৃষ্টি কম হওয়ায় কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে ।
ভারত পাটজাত পণ্যদ্রব্য আমদানির ওপর বেশ কিছু জুটমিলের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করায় বাংলাদেশ থেকে পাটের তৈরি জিনিসপত্র ভারতে রফতানি হুমকির মুখে পড়েছে। বেনাপোল বন্দর দিয়ে পাটজাতদ্রব্য রফতানি অনেকাংশে কমে গেছে।
ভারত সরকার বাংলাদেশি পাটজাত পণ্যে নতুন করে উচ্চ হারে এন্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করার পর এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে । গত বছরের পাট এখনো অনেকের আড়তে। নতুন করে শুল্ক আরোপের আগের এলসির পণ্য ভারতে যাচ্ছে। নতুন কোনো পণ্য যাচ্ছে না। ফলে বেনাপোল বন্দর দিয়ে পাটজাত পণ্য রপ্তানি আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসেবে, বাংলাদেশ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রায় ৯৯ কোটি ৯৫ লাখ ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করেছে। এর ২০ শতাংশ গেছে ভারতে। যা সেখানকার বাজারের প্রায় ৮ শতাংশ।
বাংলাদেশি উৎপাদকরা পাট রপ্তানিতে দশ শতাংশ নগদ সহায়তা পাওয়ায় ভারতীয় পাট মার খাচ্ছে বলে অভিযোগ এনে দেশটির অ্যান্টি-ডাম্পিং অ্যান্ড অ্যালাইড ডিউটিজ (ডিজিএডি) অধিদপ্তর বাংলাদেশ ও নেপালের পাটজাত পণ্যে প্রতিরক্ষামূলক শুল্ক আরোপের সুপারিশ করে। এর ভিত্তিতে ভারতের রাজস্ব বিভাগ অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপের গেজেট প্রকাশ করে। সেখানে ৪৩টি জুট মিলের ওপর অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করা হয়। এর মধ্যে ১৮টি নেপালের ও ২৫টি বাংলাদেশি জুটমিল রয়েছে।
গেজেটে বলা হয়, বাংলাদেশের কোনো জুটমিল ভারতে পাটসুতা, চট ও বস্তা রপ্তানি করতে চাইলে প্রতি মেট্রিক টনে ২০ থেকে ৩৫০ মার্কিন ডলার অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক দিতে হবে। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় এক হাজার ৬০০ থেকে ২৮ হাজার টাকা পর্যন্ত। আগে মাত্র শতকারা চার ভাগ শুল্ক ছিল এসব পণ্যে। যে টা রিফান্ড নিতেন ভারতীয় আমদানিকারকরা।
ভারত সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশের পাটপণ্যের রপ্তানি কমে গেছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। প্রতিবছর ভারতে প্রায় দুই লাখ টন পাটসুতা, বস্তা ও চট রফতানি করে আসছে বাংলাদেশ। যার মধ্যে পাটসুতার পরিমাণ দেড় লাখ টনের বেশি।
প্রসঙ্গত, এর আগে ২০১৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ভারতের পাট কমিশন ‘বাংলাদেশ থেকে প্রতি চালান পাট ও পাটজাত পণ্য আমদানির আগে কমিশন থেকে এনওসি (অনুমতিপত্র) নিতে হবে’- নতুন করে এই প্রজ্ঞাপন জারি করে পাট রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। বিজবি বলছে,পাট পাচারে কঠোর অবস্থানে রয়েছে তারা। –আবু সাইদ বিশ্বাসঃসাতক্ষীরা ঃ ২৬/৮/১৭

Please follow and like us:

Check Also

উপজেলা ভোট: প্রথম ধাপে মনোনয়নপত্র জমা দিলেন ১৮৯১ জন

ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপের ভোটে তিনটি পদে এক হাজার ৮৯১ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।