আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি (আরসা) বলেছে, তাদের সশস্ত্র বিদ্রোহ জেহাদ নয় বরং তারা জাতিগত মুক্তিকামী

আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি (আরসা) বলেছে, তাদের সশস্ত্র বিদ্রোহ জেহাদ নয় বরং তারা জাতিগত মুক্তিকামী। মিয়ানমারের মধ্যেই রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব এবং মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করাই তাদের উদ্দেশ্য। ২৫ আগস্টের হামলা ছিল আত্মরক্ষামূলক এবং রোহিঙ্গাদের অধিকার ফিরে পাওয়া পর্যন্ত এ যুদ্ধ চলবে বলে তারা ঘোষণা করেছে। ২০১২ সালের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রতিক্রিয়া থেকেই আরসার জন্ম বলে বিশেষ সাক্ষাৎকারে জানান সংগঠনের প্রধান নেতার মুখপাত্র ‘আবদুল্লাহ’। তিনি বলেন, আরসা ধর্মভিত্তিক নয়, জাতিগত অধিকারভিত্তিক সংগঠন।

হংকংভিত্তিক অনলাইন পত্রিকা এশিয়া টাইমসে প্রকাশিত এ সাক্ষাৎকারে আবদুল্লাহ আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী নেটওয়ার্কের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করে বলেন, মুসলমান বলেই আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সঙ্গে আন্তর্জাতিক জিহাদি তৎপরতার সম্পর্ক আছে, এমন দাবি ঠিক নয়।
‘মিয়ানমারের স্বীকৃত জাতিগোষ্ঠী হিসেবে রোহিঙ্গাদের অবস্থান পুনর্বহাল করতে হবে’, বলেন আবদুল্লাহ। ‘যত দিন না আমাদের দাবি মানা না হবে, তত দিন প্রতিরোধ চলবে। যদি এ দাবি না মানা হয়, তাহলে সংগ্রাম ‘অন্য স্তরে’ নেওয়া হবে। নিজেকে তিনি আরসার প্রধান নেতা আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনির নিয়োজিত মুখপাত্র বলে দাবি করেন।
এশিয়া টাইমসের মাইক উইনচেস্টারের নেওয়া ওই সাক্ষাৎকারের ভূমিকায় বলা হয়, নিরাপত্তার কারণে আবদুল্লাহর অবস্থান প্রকাশ করা হয়নি। ২৫ আগস্টের হামলার এক দিন পরে এই সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। এশিয়া টাইমস নিশ্চিত করে বলেছে, আবদুল্লাহর সঙ্গে আরসার সামরিক কমান্ডারের প্রতিদিনই কথা হয়। আবদুল্লাহকে শহুরে শিক্ষিত বলে মনে হয়েছে এশিয়া টাইমসের সাংবাদিক মাইক উইনচেস্টারের কাছে।

অন্য স্তরে বলতে ‘স্বাধীনতা’ কি না, তা স্পষ্ট করেননি আবদুল্লাহ। বরং তিনি বারবারই জোর দিয়ে বলেন, ‘আরসার লড়াই জাতীয়তাবাদী। ‘আমরা জিহাদি নই। আরসার কর্মপদ্ধতি, কাজের ধরন, যেভাবে তারা সংগঠন চালায় এবং যে লক্ষ্যের দিকে তারা চলছে, তাতেও এটা স্পষ্ট। এর কোনোটাই পাকিস্তানি কিংবা অন্য কোনো জিহাদি গোষ্ঠীর লক্ষ্যের সঙ্গে মেলে না। আমরা আসলে মিয়ানমারের অন্যান্য জাতীয়তাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোরই মতো।’ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি তাঁর আহ্বান, আরসাকে ‘সন্ত্রাসবাদী ভাবা’ কিংবা ‘মিয়ানমার সরকারের ফাঁদে পড়া’থেকে সতর্ক থাকুন।

মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ নিয়মিতভাবে আরসাকে ‘বাঙালি সন্ত্রাসবাদী’ বলে অভিযোগ করে আসছে। ২৭ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে সংগঠনটিকে বেআইনি ঘোষণা করে মিয়ানমার। আবদুল্লাহ রাখাইনে বেআইনি বাংলাদেশি অভিবাসনের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘এটা বলে তারা আমাদের ন্যায্য দাবিকে দমিয়ে রাখতে চাইছে। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জীবন অনেকটা লৌহযুগে পড়ে আছে, অনেক জায়গাতেই বিদ্যুৎ পর্যন্ত নেই। সেখানে নিয়মিতভাবে রোহিঙ্গাদের নির্যাতন-হত্যা করা হয়। প্রাণহানির ঝুঁকি নিয়ে কেন বাংলাদেশিরা সেখানে অভিবাসন করবে?’

কার্যত আশির দশকের গোড়া থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে চলে গেছে।
আবদুল্লাহ জানান, ২০১৩ সাল থেকে আরসা রাখাইনে কাজ করা শুরু করে। মূলত ২০১২ সালের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পরে রোহিঙ্গা যুবকদের মধ্যে যে রাগ ও জেদ তৈরি হয়েছিল, তা থেকেই এর জন্ম। ওই দাঙ্গায় শত শত রোহিঙ্গা নিহত হয় এবং ৮৫ হাজার বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। তা ছাড়া রাখাইন প্রদেশের রাজধানীর কাছে অবরুদ্ধ বস্তিগুলোতে আটকে আছে আরও ১ লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা।
আবদুল্লাহ মধ্যবয়সী, তার ইংরেজি বলার ধরন অভিজাত। দুজন যুবক ছিলেন তাঁর সঙ্গী। তিনি জানান, প্রবাসী রোহিঙ্গাদের থেকেই তাঁদের নেতা আতাউল্লাহ জুনুনি এসেছেন। তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা পাকিস্তানের এক রোহিঙ্গা শরণার্থী পরিবারে। পরে তিনি সৌদি আরবে চলে যান। সেখানকার দেড় লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে তিনি মসজিদের ইমাম ছিলেন। সদ্য চল্লিশ পেরোনো এই আরসা নেতা ২০১৩ সালে রাখাইনে ফিরে যুবকদের সংগঠিত করা শুরু করেন।

আবদুল্লাহর সঙ্গে কথা বলে সাংবাদিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মাইক উইনচেস্টারের মনে হয়েছে, হয় আরসা কফি আনানের প্রতিবেদনে কী আছে তা জানত না, নতুবা এ সফরকালে রোহিঙ্গা সমস্যার দিকে বিশ্বের মনোযোগের সুযোগ নিয়ে আরসা নাটকীয়ভাবে শক্তি দেখাতে চেয়েছে।
তবে আরসা শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক সমাধানই চায় বলে জানান আবদুল্লাহ। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার মধ্যে দিয়েই তা সম্ভব। ‘স্বল্প মেয়াদে আমাদের বাহিনী পৃথিবীর কাছে বার্তা পাঠাচ্ছে যে আমরা যে অনাচারের শিকার হয়েছি তা অনেক গভীর। আমরা বিচার চাই এবং বিশ্বাস করি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারের প্রতি রাজনৈতিক চাপ বাড়াবে। পূর্ণমাত্রার গণহত্যার আগের চূড়ান্ত পর্যায়ে আমরা আছি। তাই আমাদের বেসামরিক জনগণকে আমাদের বাঁচাতে হবে। দীর্ঘ মেয়াদে আমাদের সামরিক ও রাজনৈতিক শাখা সংলাপের লক্ষ্যে একযোগে কাজ চালিয়ে যাবে। আমরা দীর্ঘমেয়াদি গেরিলা সংগ্রামের চিন্তা করছি না। আমরা আশা হারাব না। আরাকানের সন্তান রাখাইনদের প্রতি আমাদের বার্তা হলো, আমরা একসঙ্গে বাস করতে পারি। আরাকান রোহিঙ্গা ও রাখাইন উভয়েরই। আরাকানের গৌরব মারাক উ রাখাইন ও মুসলিমরা একযোগেই তো তৈরি করেছিল।’

মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘তাঁর কাছে সঠিক নির্ভরযোগ্য তথ্য যায় না। তিনি সেনাবাহিনী এবং তাঁর দলের রাখাইন সদস্যদের ফাঁদে পড়ে আছেন। তারা তাঁকে বিকৃত তথ্য দিচ্ছে। নিজে গিয়ে পরিস্থিতি দেখে আসার নৈতিক দায়িত্ব তো তাঁর থাকা উচিত।’
(এশিয়া টাইমসের মাইক উইনচেস্টারের নেওয়া সাক্ষাৎকার অবলম্বনে)

Please follow and like us:

Check Also

উপজেলা নির্বাচন থেকে সরে দাড়ালো জামায়াত

ক্রাইমবাতা ডেস্করিপোট:   কেন্দ্রীয়ভাবে ঘোষণা ছিল না, এখনো নেই। তবে ‘জয়ের সম্ভাবনা’ আছে- এমন উপজেলায় চেয়ারম্যান, …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।