ওয়াশিংটন পোস্টের নিবন্ধ রোহিঙ্গা সংকট আঞ্চলিক অগ্নিকুণ্ডে রূপ নেয়ার শঙ্কা

প্রায় ১০ লাখ মানুষ এখন আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করছেন। তাদের দিকে কোনো কর্ণপাত করে না এমন সরকারের নিষ্ঠুরতার মুখোমুখি তারা।

এসব মানুষ এ দেশটিকে তাদের নিজেদের দেশ বলে দাবি করবে বহুকাল ধরে, সব সময়। কিন্তু তাদের সেই দাবিকে স্বীকৃতি দেয় না এই সরকার।

গত সপ্তাহে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে সংকট নাটকীয়ভাবে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে।

ত্রাণবিষয়ক সংগঠনগুলোর মতে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অব্যাহত নিষ্পেষণের কারণে এক লাখ ২৫ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম পালিয়ে এসেছেন বাংলাদেশে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গণহত্যা, গণধর্ষণ ও রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে পর্যায়ক্রমে অগ্নিসংযোগের মতো ভয়াবহ অভিযোগ ব্যাপকভাবে আসছে।

মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা ‘বেঙ্গলি’ উগ্র বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশনস’ চালাচ্ছে।

এখানে বেঙ্গলি বলতে মিয়ানমার সরকার অনুপ্রবেশকারী বিদেশি রোহিঙ্গাদের বুঝিয়ে থাকে। (অর্থাৎ তারা বাংলাদেশি এমনটা বুঝিয়ে থাকে)। তাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না সেদেশের সরকার।

এ অবস্থায় মিয়ানমারের সরকারের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে মুসলিম বিশ্বের নেতাদের প্রতিবাদ ক্রমেই বাড়ছে।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোগান মিয়ানমারের অভিযানকে গণহত্যা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। মিয়ানমারের শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী, যিনি সেখানে বেসামরিক প্রশাসনের মূল নেত্রী, তার বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা যেভাবে অবহেলিত এমনটা অন্য কোনো সম্প্রদায় ততটা অবহেলিত নয়।

এই রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের অধিকার ১৯৮২ সালে কেড়ে নেয় তখনকার সামরিক জান্তা। তারপর থেকে রাখাইনে তারা বর্ণবাদী যুগের মতো পরিস্থিতির মধ্যে বসবাস করছেন।

মিয়ানমারের মাটিতে বিদেশি ইসলামপন্থী জঙ্গি নেটওয়ার্কের যতটা বিস্তার ঘটছে তার চেয়ে বেশি মাত্রায় নির্যাতন ও নিষ্পেষণ চালাচ্ছে। এর ফলে ক্রমবর্ধমান হারে সেখানে বিদ্রোহী বিস্তারের লক্ষণ দেখতে পাচ্ছেন পর্যবেক্ষকরা। রোহিঙ্গাদের বিপন্নতার বিষয়ে অনেকদিন ধরেই সতর্কতা উচ্চারণ করে আসছে মানবাধিকারবিষয়ক গ্রুপগুলো।

২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হলোকাস্ট মিউজিয়াম পর্যন্ত মিয়ানমারকে গণহত্যার সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশ হিসেবে র‌্যাংকিং করে।

মিয়ানমারে নিয়োজিত মানবাধিকারবিষয়ক জাতিসংঘের স্পেশাল র‌্যাপোর্টিউর ইয়াঙ্গি লি বলেছেন, এখন উচিত পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের মূল নেত্রীর (সুচি) হস্তক্ষেপ করা। আমরা যে কোনো সরকারের কাছ থেকে এমনটা প্রত্যাশা করি। আশা করি, তাদের নিজস্ব বিচারবুদ্ধিতে সবাইকে সুরক্ষা দেবেন।

ইয়াঙ্গি লি দাবি করেছেন, এবারের সহিংসতায় গত এক সপ্তাহে হত্যা করা হয়েছে কমপক্ষে এক হাজার রোহিঙ্গাকে। কিন্তু এই যে নৃশংসতা এ বিষয়ে এখনও পর্যন্ত রহস্যজনকভাবে নীরবতা বজায় রেখেছেন অং সান সুচি। এমনকি বিশ্ব নেতারা ও আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরা এ ভয়াবহতার বিষয়ে আভাস দিয়ে বিবৃতি দেয়ার পরও তিনি চুপ করে আছেন।

সুচির পক্ষাবলম্বন করেন যারা তারা যুক্তি দেখান, সুচিকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হচ্ছে, যে সেনাবাহিনী তাকে খুব বেশিদিন হয়নি জেলে রেখেছিল। তাদের সমর্থন করছে বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীরা।

অনেক বছরের নীরবতার বাইরেও সুচি বিদ্রোহীদের দ্বারা আক্রান্ত মিয়ানমারের অনেক অঞ্চলে মানবিক সুবিধা পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে যে কঠোর কড়াকড়ি রয়েছে তা প্রত্যাহার করেননি। রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ রাখাইনে যা ঘটছে তা পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করতে নিরপেক্ষ সংবাদ মিডিয়াকে প্রবেশও করতে দিচ্ছে না।

লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকার কলামনিস্ট জর্জ মনবায়োত লিখেছেন, আমি মনে করি মিয়ানমারের সেনাবাহিনী অতিরিক্ত ক্ষমতা ফিরে পেয়েছে এবং তাদের ওপর অং সান সুচি কার্যত কোনো নিয়ন্ত্রণ চর্চা করেন না। আমি মনে করি, তার পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ খুবই সীমিত।

এই নৃশংসতা থেকে তিনি নিজেকে সরাসরি বিরত রাখতে বেশ কিছু প্রাকটিক্যাল ও আইনি ব্যবস্থা প্রয়োগ করতে পারতেন। তার হাতে অন্তত একটি অবাধ ক্ষমতা আছে। তা হল কথা বলার ক্ষমতা।

তিনি তা ব্যবহার করার পরিবর্তে নীরবতার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। প্রমাণিত ডকুমেন্ট সংগ্রহে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন। বাধা দিচ্ছেন মানবিক সহায়তায়। অতীতে তার অফিস রোহিঙ্গাদের ধর্ষণের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।

এমন অভিযোগকে তার অফিস ‘টেরোরিস্ট’দের মিথ্যা প্রচারণা বলে দাবি করেছে। একই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগের বিষয়ে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ার প্রতিবেদনকে অতিরঞ্জিত বলে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।

গত বছর তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি ব্যবহার না করতে অনুরোধ করেন বলে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এতে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের সরকারি অবস্থানের প্রতিফলন ঘটেছে। তারা এর মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছে মিয়ানমারে ১৩ লাখেরও বেশি মানুষের (রোহিঙ্গা) সরকারিভাবে কোনো অস্তিত্ব নেই।

দ্য ইন্টারসেপ্টে মেহদী হাসান লিখেছেন, নীরবতা হল সুচির পাপ। আবার নীরবতাকে গবেষণায় নিরপেক্ষতা হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু অং সান সুচির অবস্থানকে কোনোভাবেই নিরপেক্ষতা বলা যায় না। তিনি পক্ষ বেছে নিয়েছেন। সেই পক্ষ হল বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদ এবং একেবারে ইসলাম বিরোধিতা।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। তাদের দুর্ভোগকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো বড় করে দেখছে। তবে এক্ষেত্রে ভারতে জনমত মেরুকরণ হয়েছে।

মিয়ানমারের গুরুত্বপূর্ণ এক মিত্র হল ভারত। এখানে হিন্দুত্ববাদী সরকার কয়েক হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ফেরত পাঠানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। মিয়ানমারের সহিংসতা যেহেতু অব্যাহত আছে, তাই এ সংকট আঞ্চলিক অগ্নিকুণ্ডে রূপ নিতে পারে।

শান্তিপূর্ণ একটি সমাধান খোঁজার পরিবর্তে ‘সুচির অফিস তা বন্ধে কিছুই করছে না। শুধু তা-ই নয়, অন্যভাবে বলা যায়, তারা আগুনে ঘি ঢালছে।’

বাংলাদেশে কাজ করছে মানবাধিকারবিষয়ক সংগঠন ফোরটিফাই রাইটস। এর প্রতিষ্ঠাতা ম্যাথিউ স্মিথ এসব কথা বলেছেন সিএনএনকে। যখন অনেক সমালোচক শান্তিতে পাওয়া সুচির নোবেল পুরস্কার বাতিল করার আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছেন তখন ওয়াশিংটন পোস্ট একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে। এতে অং সান সুচিকে তার ২০১২ সালে নোবেল পুরস্কার নেয়ার সময় দেয়া বক্তব্যের দিকে মনোযোগ দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

ওই বক্তব্যে সুচি বলেছিলেন, চূড়ান্তভাবে আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত বাস্তুচ্যুত, গৃহহীন ও আশাহীন মানুষমুক্ত একটি পৃথিবী সৃষ্টি করা। সেটা হবে এমন একটি পৃথিবী যার প্রতিটি প্রান্ত হবে সত্যিকার এক আশ্রয়স্থল। সেখানে প্রতিটি মানুষের থাকবে স্বাধীনতা এবং শান্তিতে বসবাসের সক্ষমতা।

(ইশান ঠারুর সুপরিচিত সাংবাদিক। তিনি ওয়াশিংটন পোস্টে পররাষ্ট্র বিষয়ে লেখেন। যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনে তিনি এর আগে সিনিয়র সম্পাদক ও করসপন্ডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ওয়াশিংটন পোস্টের অনলাইনে প্রকাশিত তার লেখা ‘দ্য শেমফুল সাইলেন্স অব অং সান সুচি’র অনুবাদ এটি।

Please follow and like us:

Check Also

বাংলাদেশি জাহাজ ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত ৮ জলদস্যু গ্রেফতার

বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ অপহরণে যুক্ত ৮ জলদস্যুকে আটক করেছে সোমালিয়ার পুলিশ। রোববার জাহাজটিকে মুক্তি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।