পশ্চিমা বিশ্ব কি অং সান সু চি-কে ভুল বুঝেছিল?

মিয়ানমার রোহিঙ্গাছবির কপিরাইটGETTY IMAGES
Image captionরোহিঙ্গা ইস্যুতে তার ভুমিকার জন্য মিজ সুচির সমালোচনা হচ্ছে

এক সময় অং সান সু চি ছিলেন গণতন্ত্রের প্রতীক। অত্যন্ত বুদ্ধিমতী, শিক্ষিত, সুন্দরী, – আর তিনি কথাও বলতেন চমৎকার।

তার সাথে প্রতিতুলনায় বর্মী সেনাবাহিনীর জেনারেলরা ছিলেন প্রায় গুন্ডাদের মতো – যাদের আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ইতিবাচক প্রচার পাবার কোন কারণই ছিল না। অবশ্য তারা তা পাবার চেষ্টাও করেন নি।

বিবিসির ফার্গাল কীন বলছেন, ১৯৯৫ সালে অং সান সু চির সাথে তার যখন প্রথম সাক্ষাত হয় – তখন তিনি নেলসন মান্দেলার পর স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সবচেয়ে বড় প্রতীক।

তিনি ১৯৯০এর দশকে তার দেয়া সাক্ষাৎকারগুলোয় বার বার বলতেন অহিংসার কথা।

তখন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের রোয়ান্ডা আর বলকান অঞ্চলের সহিংসতার অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে । তাদের কাছে মিজ সু চির কথাগুলো ছিল খুবই অনুপ্রেরণাদায়ক।

কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, মিয়ানমার সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম আসলে খুবই কম জানতো।

সেখানকার জাতিগত বৈরিতার জটিল ইতিহাস – যা দারিদ্র্যের কারণে গভীরতর হয়েছে, এবং দশকের পর দশক ধরে সামরিক শাসকরা যার সুযোগ নিয়েছে – সে সম্পর্কেও পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যম খুব কমই জানতো।

ফার্গাল কীন তার বিশ্লেষণে বলছেন, “অং সান সু চির সম্পর্কেও আমরা আসলে খুবই কম জানতাম।”

মিয়ানমার রোহিঙ্গাছবির কপিরাইটGETTY IMAGES
Image captionমিজ সুচি এক সময় ছিলেন গণতন্ত্রের প্রতীক, এখন তাকে নিয়ে শুরু হয়েছে গভীর সমালোচনা

মিজ সু চি যে জেদ নিয়ে সামরিক জান্তার শক্তিকে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই জেদ যে তার বিরুদ্ধে বিদেশের সমালোচনার সময়ও একই রকম কঠোর হয়ে উঠবে – তা আমাদের হিসেবে ছিল না, বলছেন ফার্গাল কীন।

যা ছিল তার সবচেয়ে বড় শক্তি – এখন দেখা যাচ্ছে সেটাই তার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হয়ে উঠতে পারে। একসময় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আন্দোলনে যারা তার পুরোনো বন্ধু ছিলেন, তারা এবং তার প্রতি সহমর্মী কিছু রাজনীতিবিদও এখন তার কড়া সমালোচক হয়ে উঠেছেন।

মিজ সু চি-র সাথে যারা সময় কাটিয়েছেন – তারাই জানেন যে তিনি একবার কোন একটা রাস্তা নিলে তার মত পরিবর্তন করানো খুবই কঠিন।

গত বছর এ অভিজ্ঞতাই হয়েছিল জাতিসংঘের মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি বিজয় নাম্বিয়ারের।

তিনি মিজ সু চিকে রাখাইন রাজ্য পরিদর্শনে যাবার আহ্বান জানালে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।

তার ঘনিষ্ঠ একজন বলেছেন, “নাম্বিয়ার তাকে কিছু করতে বললে তিনি তা কখনোই করবেন না।”

তিনি এটাও কখনো স্বীকার করবেন না যে রোহিঙ্গা মুসলিমরা জাতিগত শুদ্ধি অভিযান বা ‘এখনিক ক্লেনজিং’এর শিকার হচ্ছে, বা হাজার হাজার লোকের বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়ে তাদের তাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, বা তাদের ওপর হত্যা ও যৌন সহিংসতা চালানোর খবর পাওয়া যাচ্ছে।

রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে অং সান সু চির সমালোচনার মুখে পড়া এবারই প্রথম নয়।

পাঁচ বছর আগে একই রকম আক্রমণে ১ লক্ষ রোহিঙ্গা বাড়িঘর হারায়। তখনও মিজ সু চি ওই এলাকা সফর করেন নি, বা নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের পক্ষে কথা বলেন নি।

মিয়ানমার রোহিঙ্গাছবির কপিরাইটGETTY IMAGES
Image captionমিজ সুচির ছবি পুড়িয়ে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিক্ষোভ

তার সরকার অবশ্য বৌদ্ধ চরমপন্থীদের ঘৃণাসূচক বক্তব্য ঠেকানোর পদক্ষেপ নিয়েছে, তবে তিনি কিন্তু তার ‘হিরো’ গান্ধী বা সহযোগী নেহরুর মতো মুসলিমদের সমর্থনে প্রকাশ্য অবস্থান নেন নি।

গান্ধী-নেহরু যা করেছেন – তা কেউ অং সান সু চির কাছ থেকে আশা করে না। কিন্তু তিনি যে এমনকি মৌখিকভাবেও এতে হস্তক্ষেপ করছেন না – তা তার অনেক সাবেক সমর্থককে মর্মাহত করছে।

রাখাইন রাজ্য রোহিঙ্গা গ্রামগুলো থেকে ওঠা ধোঁয়ার কুন্ডলি বুঝিয়ে দেয় – বার্মার সামরিক বাহিনী এখনও মনে করে যে তারা আগের মতই বর্বর পন্থা অবাধে চালিয়ে যেতে পারে, বিশ্বের অন্যরা যাই বলুক না কেন। শুধু রোহিঙ্গা নয়, কারেন বা শানদের বিরুদ্ধেও একই রকম ঘটনা ঘটেছে।

মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ওপর অং সান সু চি-র কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। সামরিক বাহিনীও মিজ সু চিকে বিশ্বাস করে না।

কিন্তু তিনি যে সামরিক বাহিনীর প্রমাণিত নির্যাতনেরও কোন নিন্দা করছেন না সেটাতে বার্মার জেনারেলরা রাজনৈতিক সুরক্ষা পেয়ে যাচ্ছে।

তা ছাড়া মিজ সু চি যে শুধু চুপ করেই আছেন তা-ও নয়। এ ছাড়াও আরো কিছু করছেন তিনি।

তাঁর কূটনীতিকরা এখন রাশিয়া এবং জাতিসংঘের সাথে কাজ করে চলেছেন, যাতে নিরাপত্তা পরিষদের মতো স্তরে মিয়ানমার সরকারের নিন্দা হতে না পারে।

মিজ সু চি নিজেও রাখাইন প্রদেশের এই সহিংসতাকে চিত্রিত করেছেন ‘সন্ত্রাসবাদ জনিত সমস্যা’ হিসেবে।

তিনি মনে করেন, তার যে নিন্দা হচ্ছে – তার কোন ভিত্তি নেই। এবং এ নিন্দার মুখেও তিনি যে তার জেদ ত্যাগ করেন নি – এটাও এই সমীকরণের অংশ।

কিন্তু আরো একটা প্রশ্ন উঠছে যা খুবই অস্বস্তিকর।

প্রশ্নটা হলো এই : তিনি দীর্ঘদিন ধরে সার্বজনীন মানবাধিকারের প্রতি যে অঙ্গীকার দেখিয়ে এসেছেন – সেটা কি তাহলে পক্ষপাতদুষ্ট? বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটিতে থাকা বিপন্ন রোহিঙ্গা মুসলিমরা কি তাহলে তার সেই অঙ্গীকারের আওতায় পড়ে না, বা কখনোই পড়বে না?

অং সান সু চি হয়তো এখনো এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন, তিনি সামরিক বাহিনীর ওপর চাপ দিতে পারেন এই বর্বর অভিযান বন্ধ করার জন্য।

কিন্তু এ মুহূর্তে এরকম কিছু ঘটবে – এমন সম্ভাবনা খুবই কম।

Please follow and like us:

Check Also

বেইজিং ঘনিষ্ট মুইজ্জুর জয়: ভারত থেকে আরও দূরে সরবে মালদ্বীপ

মালদ্বীপে দীর্ঘদিন ধরে থাকা ভারতের প্রভাব কমাতে ‘ইন্ডিয়া আউট’ স্লোগান দিয়ে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।