বিপন্ন মানবতা…. জীবন বাঁচাতে দুঃসাহসিক অভিযাত্রায় রোহিঙ্গারা

বৃদ্ধ বাবা-মাকে এভাবেই নিয়ে আসছে রোহিঙ্গা যুবকরা

সাত ফুটের একটি বাঁশের মাঝে পুঁটলি ঝুলিয়ে কাঁধে করে ধানক্ষেতের ভেজা আইল ধরে এগোচ্ছিলেন দুই যুবক। পেছনে আরও কয়েক নারী-শিশু। সবার শরীর কাদায় মাখা।

হঠাৎ করেই পা পিছলে পড়ে যান ওই দুই যুবক। তখনই পুঁটলি থেকে ভেসে আসে আর্তনাদ। দুই যুবক পুঁটলি খুলে আইলের মধ্যেই শুইয়ে দেন সত্তরোর্ধ্ব এক বৃদ্ধকে।

কেঁদে চিৎকার করে তিনি বলছিলেন, ‘আর বাঁচব না। কোমরটা ভেঙে গেল।’

কাছে গিয়ে জানা গেল- ওই বৃদ্ধের নাম জামাল উদ্দিন। তিনি পরিবার নিয়ে মিয়ানমারের রাখাইন স্টেটের বুচিঢং এলাকায় থাকতেন। সে দেশের সেনাবাহিনী তার বড় ছেলে আনোয়ারকে গুলি করে হত্যা করেছে। তাদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে।

জীবন বাঁচাতে পরিবারের ১৪ সদস্য ৮ দিনের চেষ্টায় নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে আসতে পেরেছেন। দুই ছেলে আবদুল করিম এবং আবদুর রহিম মাইলের পর মাইল পাহাড় ও জঙ্গল দিয়ে বৃদ্ধ বাবাকে এভাবেই বয়ে নিয়ে এসেছেন।

শুক্রবার ভোরে তারা কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার সীমান্তবর্তী কাঞ্জড়পাড়ার দক্ষিণ মাথা এলাকার নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকেন। তারপর চার ঘণ্টায় সাত কিলোমিটার কাদামাখা ধানক্ষেতের আইল পেরিয়ে দুই ভাই বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে কাঞ্জরপাড়া পর্যন্ত এসেছেন। সব ক্লান্তি ঠেলে আর পিচ্ছিল পথ মারিয়েও শেষ পর্যন্ত বাবাকে নিরাপদ গন্তব্যে সুস্থভাবে পৌঁছাতে পারলেন না।

করিম আর রহিমই নন, মিয়ানমার থেকে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা কয়েকশ’ তরুণ-যুবক-মধ্যবয়সী কাঁধে অথবা পিঠে করে বয়ে নিয়ে এসেছেন অক্ষম বৃদ্ধ বাবা-মাকে। বর্ষার এই প্রতিকূল পরিবেশও তাদের পথে বাধা হতে পারেনি।

নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের জীবন বাঁচাতে যেন তারা দুঃসাহসিক অভিযানে নেমেছেন। তাদের সহযাত্রী হয়েছেন নারী ও শিশুরাও। যখন তারা আর এগোতে পারছেন না জিরিয়ে নিচ্ছেন। বাংলাদেশের ভেতরে ঢোকার পর তাদের ভয় অনেকটাই কমে গেছে। এ কারণে তারা বিশ্রাম নিয়ে আস্তে আস্তে এগোচ্ছেন। অনেকেই আবার কাদার মধ্যেই বিশ্রাম নিয়ে পা বাড়াচ্ছেন।

শুক্রবার ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত সরেজমিন কাঞ্জরপাড়া এলাকার দুর্গম সীমান্ত এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, নাফ নদীর ওপারে এখনও হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছেন। তারা যেন বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশ করতে পারলেই বেঁচে যান।

বন, জঙ্গল, পাহাড় আর নদী পেরিয়ে যারা বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছেন তারা নিজেদের নিরাপদ মনে করছেন। তাদের গন্তব্য এখন টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্প। যদিও সেখানেও নেমে এসেছে মানবিক বিপর্যয়।

জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা শুক্রবার জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় দুই লাখ ৭০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা মিয়ানমারের রাখাইন স্টেট থেকে প্রাণভয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন।

তবে স্থানীয়রা বলছেন, সম্প্রতি বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গার প্রকৃত সংখ্যা তিন লাখ ছাড়িয়ে গেছে। তাদের প্রায় ৭০ শতাংশ নারী ও শিশু। তারা সবাই আশ্রয় নিয়েছে কক্সবাজার জেলার দুই উপজেলা টেকনাফ ও উখিয়া এবং বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায়। এই তিন উপজেলার সীমান্ত দিয়েই এসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছেন।

টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে দেখা গেছে, নতুন করে আসা রোহিঙ্গারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাদের অধিকাংশই খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন। ক্যাম্পের বাইরে রাস্তায় এবং পাহাড়ে তারা আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করছেন। তবে বৃষ্টির কারণে তারা আরও বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধরা পড়েছেন সবচেয়ে বেশি বিপাকে।

দুঃসাহসিক অভিযানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে এলেও অনেকের জীবনও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে। বিশেষ করে তাদের স্বাস্থ্য বিপন্ন হয়ে পড়েছে। এখন তাদের নেই খাদ্যের নিরাপত্তা, নেই স্যানিটেশন ব্যবস্থা। ফলে বৃদ্ধ ও অনেক শিশু এরই মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তবে স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, তারা এ বিষয়ে সতর্ক রয়েছে।

বান্দরবানের সিভিল সার্জন অং সুই প্রু বলেন, স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তাদের কাছ থেকে কোনো ধরনের রোগবালাই যেন ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখা হচ্ছে। এছাড়া রোহিঙ্গা শিশুদের পোলিও টিকা দেয়া হবে।

শুক্রবার সকালে উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী এবং পালংখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তার মধ্যে এবং পাহাড় কেটে রোহিঙ্গারা আশ্রয় খোঁজার চেষ্টা করছেন। কুতুপালং এলাকার রাস্তার ধারে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছেন। তবে তাদের অধিকাংশেরই মাথার ওপর কোনো ছাদ নেই। এ কারণে বৃষ্টিতে ভিজে তারা চরম বিপাকে পড়েছেন। বালুখালী এলাকায় পাহাড় কেটে বসতি করার চেষ্টা করছেন অনেক রোহিঙ্গা।

ওদের কোনো দেশ নেই : মিয়ানমারের রাখাইন স্টেটের রোহিঙ্গাদের কোনো দেশ নেই। রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতি নেই। তাদের নেই নাগরিক অধিকার। ভোটের অধিকারও কেড়ে নেয়া হয়েছে। জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ, সন্তান ধারণ, শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি সব থেকেই তারা ছিল বঞ্চিত। এখন তো বেঁচে থাকার অধিকারটুকুও কেড়ে নেয়া হচ্ছে। এ কারণেই তারা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছেন।

মিয়ানমার থেকে বেঁচে ফেরা রোহিঙ্গারা এ তথ্য জানান। তারা বলেন, নির্মমভাবে তাদের খুন করা হচ্ছে। বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। খুনের পর গুম করা হচ্ছে লাশ। আবার কখনও সেই লাশ নিয়ে উল্লাস করছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও স্থানীয় অধিবাসী ‘মগ’।

কুতুপালং এলাকায় পাহাড় কেটে একটি ছোট্ট খুপরি ঘর তৈরি করছিলেন কলিম উদ্দিন। পাশেই তাকে সহায়তা করছিলেন তার স্ত্রী আকলিমা বেগম।

আকলিমা জানান, মিয়ানমারের আরঢাং এলাকায় তার বাবার বসতবাড়ি ছিল। পাঁচ শিশু সন্তান নিয়ে সেখানেই তারা থাকতেন। তার বাবা আনসার আলী ও শুকুর আলীকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ধরে নিয়ে হত্যা করেছে। তার মা আমেনা বেগম ও ভাইয়ের স্ত্রী সুলতানা এখন কোথায় আছেন তারা জানেন না। তারা প্রাণভয়ে পালিয়ে এসেছেন।

কলিম উদ্দিন বলেন, রাখাইনে জন্ম নিয়েই পাপ করেছি। সেই পাপের শাস্তি পাচ্ছি আমরা। এখন পাপে তো সবই শেষ হয়ে গেছে। কলিম উদ্দিন ও আকলিমার মতো বাংলাদেশে আসা অনেক রোহিঙ্গার স্বজন খুন হয়েছেন অথবা নিখোঁজ রয়েছেন।

এক শিশুকে অন্য শিশু বয়ে নিচ্ছে মাইলের পর মাইল : দক্ষিণ কাঞ্জড়পাড়ার সীমান্ত এলাকায় নাফ নদী পেরিয়ে শুক্রবার সকালে আবুল হোসেনের সাত সদস্যের পরিবার একটি নৌকা করে বাংলাদেশে এসেছেন।

আবুল হোসেনের বৃদ্ধ মা আম্বিয়া খাতুন চলাফেরা করতে পারেন না। মংডু থেকে আবুলই তার মাকে কাঁধে করে এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন। আবুলের স্ত্রী আমেনা বেগম তিন বছরের শিশু সন্তান রহিমসহ নিখোঁজ রয়েছেন।

আবুলের সাত বছরের কন্যা রহিমা তাই দুই বছর বয়সী তার ভাইকে কোলে করে মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়েছে। শুধু রহিমাই নয়, বৃহস্পতি ও শুক্রবার টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় এক শিশু অপর শিশুকে বহন করে নিয়ে যাওয়ার বহু দৃশ্য চোখে পড়েছে।

মিয়ানমারের বর্বরতা পাকিস্তানিদেরও ছাড়িয়ে গেছে : মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার জবানি ও ধারণ করা ভিডিওচিত্রে উঠে এসেছে সে দেশের সেনাবাহিনীর বর্বরতার চিত্র। তারা রোহিঙ্গাদের পেলেই নির্মমভাবে হত্যা করছে। বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। শিশুদেরও পুড়িয়ে মারছে। কখনও কখনও মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছে শিশুদের।

বাবা-মায়ের সামনে ছেলেকে, স্ত্রীর সামনে স্বামীকে, সন্তানের সামনে বাবাকে কখনও গুলি করে, আবার কখনও গলা কেটে হত্যা করা হচ্ছে। যারা জীবন বাঁচাতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে চাইছে তাদেরও রেহাই নেই। খুঁজে পেলেই হত্যা করা হচ্ছে। নৌকা দিয়ে পাড়ি দেয়ার সময়ও হত্যা করা হচ্ছে অনেককেই।

তারা আরও বলেন, বর্বরতায় হিটলার, মুসোলিনি, জার, বাতিস্তাকেও ছাড়িয়ে গেছে মিয়ানমার। এমনকি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতাকেও তারা ছাপিয়ে গেছে।

Check Also

মালয়েশিয়ার পাম তেলে ইইউ’র নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের শ্রমবাজারে অশনি সংকেত

বন উজাড়, কার্বন নির্গমনের ঝুঁকি এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্টগত কারণ দেখিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়ার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।