বৃদ্ধা মাকে ৪ দিন ধরে পিঠে বয়ে নিয়ে বাংলাদেশে এসেছে অছিউর মগসেনাদের নৃশংসতার লোমহর্ষক বর্ণনা পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মুখে

কক্সবাজার : নাফ নদীর পাড় থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে দক্ষিণ মংডুর সীমান্তঘেঁষা গ্রাম রাইম্মার বিল এলাকাটি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। উগ্রপন্থী সেনাসদস্যদের দেয়া আগুনে এলাকাটি পুড়ে যায় বলে অভিযোগ পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের। গতকাল জুমাবার বিকেল ৫টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। যা নাফ নদীর পাড় থেকে স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছিল। এদিকে বর্বর নৃশংসতা ও নির্যাতনের মুখে বিভিন্ন সীমান্ত পথে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে রোহিঙ্গারা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জীবন বাঁচাতে মাইন বিছানো পথ মারিয়েই তারা প্রবেশ করছে বাংলাদেশে।

মিয়ানমার থেকে বিভিন্ন পাহাড় জঙ্গল, ঝোপঝাড় পেরিয়ে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির চোখ ফাঁকি দিয়ে ৪ দিন ধরে গর্ভধারিনী মাকে পিঠে নিয়ে হোয়াইক্যং লম্বাবিল সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে মিয়ানমারের মংডু সবরদি বিল গ্রামের অছিউর রহমান (৪৪)। তার কাঁধে ৭৫ বছরের গর্ভধারিনী বৃদ্ধ মা মমতাজ বেগম। বয়সের কারণে তিনি খুব একটা হাঁটতে পারেন না। তাই ছেলে অছিউর ৪ দিন ধরে মাকে কাঁদে নিয়ে বয়ে বেড়িয়েছেন সীমান্তের বিভিন্ন অঞ্চল। কখনো জঙ্গলে, কখনো পাহাড়ে রাত কেটেছে মা ছেলের। মিয়ানমার থেকে সঙ্গে আনা যৎসামান্য শুকনো খাবার বৃদ্ধ মাকে খাইয়েছেন। তাও আবার তিন দিন। একদিন ধরে অভুক্ত তার মা। আর ছেলে অভুক্ত ৪ দিনের। তাই সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করা মাত্রই খিদের জ্বালায় হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দেন অছিউর রহমান।

অছিউর রহমান জানান, পরিবারের অন্যন্য সদস্যরা কয়েকদিন আগেই বাংলাদেশে পাড়ি জমায়। মা ও ছেলে ছিল মিয়ানমারে। কিন্তু মিয়ানমার বাহিনী যখন একের পর এক গ্রাম পেট্রোল দিয়ে জ্বালিয়ে দিচ্ছিল, তখন সে মাকে কাঁধে নিয়ে পালাতে থাকে, ৪ দিন ধরে বিভিন্ন জঙ্গল পেরিয়ে অবশেষে লস্বাবিল সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে মা, ছেলে। শুধু মা, ছেলে নয় সীমান্তজুড়ে এখন অসংখ্য রোহিঙ্গা মুসলিমের ভয়াবহ করুন চিত্র। কেউ বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে এসেছেন, কেউ কাঁধে করে নিয়ে এসেছেন প্রতিবন্দি বোনকে। সবার মুখে হতাশা ও আতংকের ছাপ।

স্থানীয় জনগণ নতুন আসা রোহিঙ্গাদের শুকনো খাবার দিয়েও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। পরিদর্শনকালে লম্বাবিল সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের বর্ণনায় যা উঠে আসে তা হৃদয়বিদারক, লোমহর্ষক। দুই শিশুসন্তান নিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে আসা ফাতেমা বেগম (২৫) জানান, তার স্বামী বাড়ির পার্শ্বে লুকিয়ে ছিল। এ সময় সেনাবাহিনী ও রাখাইন সম্প্রদায়ের একটি দল তাকে ধরে নিয়ে যায়। কেরোসিন ঢেলে পরবর্তীতে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয় তার ঘর। জীবন বাঁচাতে দু’টি সন্তানকে নিয়ে পালিয়ে এসেছে, স্বামীর কি অবস্থা এখনো জানে না সে। তার ভাষায়, মিয়ানমারে মুসলিম রোহিঙ্গা নিধনে ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে সে দেশের সেনাবাহিনী ও পুলিশ। পাশাপাশি স্থানীয় রাখাইন সম্প্রদায়ও হামলা চালাচ্ছে গ্রামে গ্রামে। পুরুষ যুবকদের হত্যা করা হচ্ছে, ধরে নিয়ে গিয়ে রোহিঙ্গা যুবতীদের উপর চালাচ্ছে পাশবিক নির্যাতন, বসতবাড়ীতে আগুন দেওয়া হচ্ছে, মিয়ামমারে প্রকাশ্যে জুলুম হচ্ছে কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করছে নাÑ এ কথা বলতে বলতে ফাতেমা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।

মংন্ডু পোয়াখালী গ্রামের জমিলা খাতুন (৪৫) জানায়, তারা মিয়ানমার বাহিনীর আক্রমনে দিশেহারা হয়ে সেদেশের সীমান্ত এলাকার খেয়াবনে কিছু না খেয়ে ৫ দিন আত্মগোপনে ছিলেন। পরিবর্তিতে ৭ দিন পায়ে হেঁটে সীমান্ত পেরিয়ে অবশেষে বাংলাদেশে এসেছেন। সে আরো জানায়, তার পাশের বাড়ীটি লুটপাট করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিলে তার বাড়ীটিও পুড়ে যায়। মংন্ডু পোয়াখালী গ্রামের সব হারিয়ে নিঃস্ব মমতাজ বেগম (৪০) জানায়, সেনা সদস্যরা তাদের গ্রামে লুটপাট চালিয়ে মেয়েদের ইজ্জত লুন্ঠন করছে। ছেলেদের ধরে নিয়ে জবাই করে মারছে। ছোট ছোট ছেলেদের আগুনে নিক্ষেপ করছে। নৃশংস এ বর্বরতার হাত থেকে রেহায় পাওয়ার জন্য ছেলেমেয়ে নিয়ে এখানে চলে এসেছি। সে দুঃখ করে বলে,এত সহায় সম্পদ থাকা সত্ত্বেও আজ এক কাপড়ে অনাহারে দিন কাটাতে হচ্ছে। স্বামী হারা সাজু বেগম (২৫) জানায়, পুলিশ তার স্বামী ইউনুছকে ধরে নিয়ে গেছে। পরে শুনেছি তাকে মেরে ফেলে লাশ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। শিশুসন্তান ফায়সাল (৫), রাশেদ (৩) ও আনোয়ার (২) এই তিন সন্তানকে নিয়ে কোন রকমে বেঁচে পালিয়ে এসেছি।

খেয়ারীপাড়ার আব্দুল হামিদ (২৬) জানায়, ঘরে আগুন দিয়ে পুড়ে দেওয়ার সময় তার চোখের সামনে বয়োবৃদ্ধ পিতা শফিউল্লাহ (৫৫) মারা যায়। উপায় না দেখে বাবার লাশ ফেলে মাকে নিয়ে সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছি। নাগপুরা থেকে পালিয়ে আসা আব্দুল গফুর (৪০) জানায়, গত এক সপ্তাহ ধরে মগসেনারা সীমান্তের ঢেকিবনিয়া, কুমিরখালী, শিলখালী, বলিবাজার ও নাগপুরাসহ ২০টি গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। এখনো গ্রামের পর গ্রাম জ্বলছে। বয়োবৃদ্ধ মরিয়ম খাতুন (৫৫) জানায়, তার ছেলে ইমাম শরীফ (২৮) ও তার পুত্র বধু মনোয়ারা (২২) ৩ জনের সংসার তছনছ করে দিয়েছে মগসেনারা। এভাবেই পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বর্ণনায় ভারী হয়ে উঠেছে সীমান্ত এলাকার পরিবেশ। প্রতিদিনই আসছে রোহিঙ্গারা। প্রতিদিনই শোনা যাচ্ছে মগসেনাদের এমন নির্মমতার কাহিনী।

Please follow and like us:

Check Also

কলারোয়া  উপজেলা জামায়াতের প্রথম সভাপতি আবুল কাশেমের ইন্তেকালঃ বঙ্গবন্ধু বিশেষ সুপারিশে  যিনি কারা মুক্ত হন

সাতক্ষীরা সংবাদদাতাঃ কলারোয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান, উপজেলা জামায়াতের প্রথম সভাপতি বাংলাদেশ পরিবহন মালিক সমিতির …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।