শাহজালালের বাবার অভিযোগ দেড় লাখ টাকার জন্য দু’চোখ উপড়ে ফেলে পুলিশ

খুলনায় শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে আসা যুবক শাহজালাল কোনো গণপিটুনির শিকার হননি। বরং থানার দু’জন কথিত সোর্সের ইন্ধনে দেড় লাখ টাকার জন্যই পুলিশ তার দু’চোখ উপড়ে ফেলেছে। এতে শাহজালাল চিরদিনের জন্য অন্ধ হয়ে গেছেন।
শুক্রবার এ অভিযোগ করেছেন শাহজালালের বাবা দরিদ্র কৃষি শ্রমিক জাকির হোসেন।

পিরোজপুর জেলার কাউখালী থানার সুবিদপুর গ্রামের কৃষি শ্রমিক জাকির হোসেন যুগান্তরকে জানান, শাহজালালের চোখ তুলে ফেলার পর দীর্ঘদিন চিকিৎসা চললেও চোখের কোটরের পচন এখনও সেরে উঠেনি। আরও কতদিন চিকিৎসা করাতে হবে তাও জানেন না। এরপর সেরে উঠলেও তার মতো গরিব বাবার পক্ষে অন্ধ ছেলের বোঝা কতদিন বইতে পারবেন-এ প্রশ্নের উত্তর জানা নেই।

তিনি বলেন, দুই ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে শাহজালাল সবার বড়। ছোট ছেলেটি ৮ম শ্রেণীর ছাত্র। এক মেয়ের বিয়ে হলেও ছোট মেয়েটি ১৮ বছরের শারীরিক প্রতিবন্ধী। নিজের জমি নেই। অন্যের জমিতে চাষাবাদের কাজ করে সংসার খরচের একটি অংশ আসত। বাকিটা বড় ছেলে শাহজালাল জোগাড় করত। কিন্তু পুলিশ তার চোখ উপড়ে ফেলে পুরো পরিবারটিকেই অন্ধ করে দিয়েছে।

জাকির হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘ঘটনার দিন (১৮ জুলাই) শাহজালালকে থানাহাজতে রেখে টাকার জন্য প্রথম দফায় নির্যাতন চালালে তার হাতে জখম হয়। রাত সাড়ে ৯টার দিকে পুলিশ তাকে পাশের খালিশপুর ক্লিনিকে নিয়ে চিকিৎসা করায়। ডাক্তার তার হাতে যখন ব্যান্ডেজ বেঁধে দেয় তখন তার দু’চোখই ভালো ছিল। যা ওই ক্লিনিকের সিসি ক্যামেরা দেখলে শনাক্ত করা যাবে।’

তিনি বলেন, ‘থানায় সিসি ক্যামেরা থাকলে এবং ওই দিনের দৃশ্য (ফুটেজ) নষ্ট না করলে সেখানেও চোখওয়ালা শাহজালালকে দেখা যাবে।’

তিনি দাবি করেন, স্থানীয় বিজিবি ক্যাম্পের সামনে থেকে তার ছেলেকে পুলিশ আটক করার পর প্রথমে স্থানীয় গোয়ালখালী ক্লাবে নিয়ে বসিয়ে রাখে।

তিনি বলেন, ‘সে সময় পরিচিত যারা তাকে ছাড়াতে গিয়েছিলেন তারা সবাই সাক্ষী যে, আমার ছেলে তখন সুস্থ ছিল। ওইদিন রাত সাড়ে ১১টার দিকে আমার স্ত্রী, পুত্রবধূ ও আত্মীয়স্বজনরা যখন খালিশপুর থানায় আমার ছেলেকে দেখে তখনও তার চোখ দুটি ভালো ছিল। এ সময় ছেলেকে ছাড়াতে পুলিশ দেড় লাখ টাকা চায়। আমরা গরিব মানুষ, তবুও ধারদেনা করে ১০ হাজার টাকা দিতে রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু তাকে না ছাড়ায় রাত সাড়ে ১২টার দিকে সবাই বাসায় চলে যায়। আর ভোর সাড়ে ৫টার দিকে থানায় এসে জানতে পারে যে শাহজালাল থানায় নেই, হাসপাতালে ভর্তি আছে। আমরা হাসপাতালে যেয়ে তৃতীয় তলায় তাকে চোখ উপড়ানো রক্তাক্ত অবস্থায় কাতরাতে দেখি।’

জাকির হোসেন আরও বলেন, ‘পুলিশ আমার ছেলেকে গণপিটুনির যে নাটক সাজিয়েছে তার প্রমাণ নেই। কারণ তার শুধু চোখ দুটিই উপড়ানো। অথচ গণপিটুনি হলে শরীরের অন্যত্র আঘাতের চিহ্ন বা কাপড়চোপড় বিধ্বস্ত বা ছেঁড়া থাকার কথা।’ তিনি এ নাটক বন্ধ করে দোষীদের কঠোর শাস্তি দাবি করেন।

বৃহস্পতিবার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে শাহজালালের মা রেণু বেগম ৭ পুলিশ সদস্য, ৩ আনসার ও দু’জন কথিত সোর্সকে আসামি করে মামলা করেন। মামলায় ১০ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। বাদীর আবেদন ও জবানবন্দি গ্রহণ করে বিচারক শহিদুল ইসলাম আদেশের জন্য ১৭ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করেছেন।

মামলার আসামিরা হলেন : খালিশপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাসিম খান, এসআই মোরসালিম মোল্যা, এসআই মিজান, এসআই নূর ইসলাম ও এএসআই সৈয়দ সাহেব আলী, এসআই রাসেল, এসআই তাপস রায়, এসআই মামুন, আনসার সদস্য আফসার আলী, আনসার ল্যান্স নায়েক আবুল হোসেন, আনসার নায়েক রেজাউল।

এ ছাড়া থানা পুলিশের কথিত সোর্স স্থানীয় খালিশপুর পুরাতন যশোর রোড এলাকার সুমা আক্তার ও শিরোমণি বাদামতলা এলাকার লুৎফুর হাওলাদারের ছেলে রাসেলকে মামলার অন্যতম আসামি করা হয়েছে।

মামলার এজাহারে বাদী উল্লেখ করেছেন, গত ১৮ জুলাই তার ছেলে মো. শাহজালাল স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলার সুবিদপুর গ্রামের বাড়ি থেকে খালিশপুরের নয়াবাটি রেললাইন বস্তি কলোনির শ্বশুরবাড়িতে ফিরছিলেন। রাত ৮টায় শাহজালাল মেয়ের দুধ কেনার জন্য পাশের দোকানে যায়।

এ সময় খালিশপুর থানার ওসি নাসিম খানের নির্দেশে পুলিশ কর্মকর্তারা তাকে থানায় ডেকে নিয়ে যায়। তার ফিরতে দেরি দেখে পরিবারের লোকজন থানায় গেলে ওসি ছাড়ানো বাবদ দেড় লাখ টাকা দাবি করেন। অন্যথায় তাকে মেরে ফেলার হুমকি দেন।

এত টাকা শাহজালালের পরিবার দিতে ব্যর্থ হলে স্বজনরা থানার সামনে অপেক্ষায় থাকেন। রাত সাড়ে ১১টার দিকে পুলিশের লোকজন শাহজালালকে গাড়িতে করে বাইরে নিয়ে যায়। এ ঘটনার পরদিন ১৯ জুলাই শাহজালালকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার পরিবারের লোকজন হাসপাতালের বারান্দায় দুটি চোখ উপড়ানো অবস্থায় শাহজালালকে দেখতে পান।

সর্বশেষ জানা গেছে, শাহজালাল পুলিশের মামলায় এখন কেরানীগঞ্জ কারাগারে আটক রয়েছেন। তার বাবা জানান, বৃহস্পতিবার খুলনার আদালত থেকে তার জামিন মঞ্জুর হলেও কারাগারে এ সংক্রান্ত কাগজপত্র না পৌঁছানোর কারণে তাকে ছাড়ানো যায়নি। শনিবার (আজ) সে মুক্তি পেলে ধারাবাহিক চিকিৎসার জন্য খুলনায় নেয়া হবে।

Please follow and like us:

Check Also

আলিপুরে চেয়ারম্যান প্রার্থী জিয়ার মোটর সাইকেল বহরে বোমা হামলা, ৫জন আহত

নিজস্ব প্রতিনিধি: সন্ত্রাসী জনপদ আলিপুরে চেয়ারম্যান প্রার্থী জিয়াউল ইসলাম জিয়ার মোটর সাইকেল বহরে বোমা হামলা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।