রাখাইনে শুধু তিন জেলাতেই ১৫০ গ্রাম রোহিঙ্গা শূন্য,,,আসছে আরও রোহিঙ্গা, ভিডিও

 ডেস্ক: বেশ কিছুদিন ধরেই মিয়ানমারের আরকান রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর চলছে বর্বর নির্যাতন ও গণহত্যা। বার্মিজ আর্মি ছাড়াও বিজিপি, নাসাকা বাহিনী ও উগ্র বৌদ্ধরা এ হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে।
নাফ নদের ওপারে এখনো জ্বলছে গ্রামের পর গ্রাম। প্রাণভয়ে টেকনাফের লাম্বা বিল, উখিয়ার আঞ্জুমানপাড়াসহ অনেকেই সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছেন লাখ লাখ মানুষ। বাংলাদেশ মুখি মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জনস্রোত কমার কোনো লক্ষণ নেই। এরইমধ্যে সে দেশের মংডু, বুচিডং ও রাচিডং টাউনশিপ (জেলা) এলাকার অন্তত ১৫০ গ্রাম রোহিঙ্গা শূন্য হয়েছে।
ধারণা করা হচ্ছে, এসব গ্রামের অন্তত পাঁচ লাখ মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে পুড়িয়ে ছাই করেছে সেদেশের সরকারি বাহিনীর লোকজন ও সংখ্যাগরিষ্ঠরা। তবে ওই তিন জেলা শহরের সদরে সরকারি স্থাপনা ও কার্যালয়ের পাশে এখনো কিছু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষ চরম বিপন্ন অবস্থায় টিকে রয়েছে। রাখাইনের (আরাকান) অন্য জেলাগুলোতেও সহিংসতা শুরু হওয়ায় সেখান থেকেও বিপন্ন মানুষ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসাতে শুরু করেছে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে মিয়ানমার থেকে যারা ফিরছেন, তাদের অনেকেই গুলিবিদ্ধ, ক্ষুধার্ত ও জীর্ণশীর্ণ চেহারায় বাংলাদেশের ক্যাম্পগুলোতে অবস্থান নিয়েছেন।

গতকাল রোববার টেকনাফের লাম্বা বিল সীমান্তের বিপরীতে মিয়ানমারের নাইছাদং, পোয়াখালী, বলিবাজার, শিকদারপাড়া গ্রামে দিনভর আগুনের কুুণ্ডলী লক্ষ্য করা যায়। ধোঁয়ায় ছেয়ে যায় আশপাশের এলাকা। উখিয়ার পালংখালীর আঞ্জুমানপাড়ার বিপরীতে মিয়ানমারের পোয়াংদিবন টমবাজার এলাকায়ও দিনভর আগুন জ্বলতে দেখা যায়। এসব এলাকায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী হেলিকপ্টারে টহল দিয়ে দাহ্য পদার্থ নিক্ষেপ করে। ওই এলাকাগুলোতে বসবাস করা কয়েক হাজার রোহিঙ্গা গতকালও বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। তারা সীমান্তের লাম্বা বিলের পাশে লেদা মুছুনি নয়াপাড়া, থাইনখালী, বালুখালী ও কুতুপালং ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়। এর মধ্যে অনেকেই পরিবারের সব সদস্যকে হারিয়ে একাই চলে আসেন। কোনো কোনো নারীকে দেখা যায় কোলের সন্তানকে নিয়ে একাই ফিরে আসতে।


বাংলাদেশ সরকার বা আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা- কারো কাছেই পালিয়ে আসা মানুষের প্রকৃত কোনো সংখ্যার তথ্য নেই। নিবন্ধনের মাধ্যমে প্রবেশ না করানোয় এই সমস্যার সৃষ্টি। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্তের প্রায় স্থান দিয়ে রোহিঙ্গারা প্রবেশ করছে। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা এক রোহিঙ্গা নেতা ও সু চির রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির এক সময়ের কর্মী জানান, তিন জেলার অন্তত ১৫০টি গ্রামের কোনো রোহিঙ্গা আর সে দেশে নেই। প্রতি গ্রামে কম করে হলে তিন হাজারের মতো মুসলিম জনগোষ্ঠীর মানুষের বাস ছিল। কোনটায় আবার ২৫ হাজার। সব মিলিয়ে কমপক্ষে পাঁচ লাখ মানুষ এরইমধ্যে বাংলাদেশে এসেছে। তারা কেউই বাংলাদেশি বা বাংলাভাষি নয়। শতশত বছর ধরে তারা বংশানুক্রমে সে দেশে বাস করছেন এবং রোহান ভাষায় কথা বলছেন। রোহান ভাষার সঙ্গে চট্টগ্রামের ভাষার হয়তো কিছুটা মিল আছে, কিন্তু তা বাংলা ভাষা তো নয়!
বুচিডং টাউনশিপের বাসিন্দা আব্দুল কাইয়ুম বলছিলেন, সীমান্ত পেরুনো মানুষের মধ্যে প্রথমেই এসেছে সীমান্ত জেলা মংডুর মানুষ। আঘাতটা তাদের ওপরই এসেছে প্রথম। নদী ও সমুদ্র পাড়ি দিয়ে তারা এসেছে সহজে। কিন্তু বুচিডং ও রাচিডং জেলার মানুষদের অনেকপথ পাড়ি দিতে হচ্ছে। অন্য জেলাগুলোর অবস্থাও ভালো নয়। সেখানকার মানুষও বাংলাদেশের দিকে রওনা দিয়ে পথে রয়েছেন বলে স্বজনদের কাছে জানতে পেরেছেন তিনি।

স্রোতের মতো আসছেন রোহিঙ্গা। নিজ দেশের খোদ সরকারের রোষানলে পড়ে দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছেন মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশের লাখ লাখ রোহিঙ্গা। বাংলাদেশ সীমনায় কড়া নিরাপত্তা বসিয়েও ঠেকানো যাচ্ছে না তাদের অনুপ্রবেশ।

রোববার বিকেলে হাজার হাজার রোহিঙ্গা এসেছেন। একই ধারায় সোমবার (১১ সেপ্টেম্বর) সকালেও প্রচুর রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছেন। এ ছাড়া সীমানার নো ম্যানস ল্যান্ডের মধ্যে আরও হাজার হাজার রোহিঙ্গা এ পারে আসার অপেক্ষায় রয়েছেন।

jagonews24

উখিয়ার রাজা পালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যানে জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী  বলেন, পরিস্থিতি এখন বেসামাল। তিল ধরার ঠাঁই নেই কুতুপালং আর বালুখালিতে। সড়কের দু’ধারে মানবেতর জীবনযাপন করছেন হাজার হাজার রোহিঙ্গা। জায়গাও মিলছে না তাদের। বৃষ্টি আর কাদার মধ্যেই বসে বা দাঁড়িয়ে রাত কাটছে তাদের।

jagonews24

তার ধারণা, গত ২৫ আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত আড়াই লাখের উপরে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছেন। এ অসংখ্যা আরও বাড়তে পারে। আজও হাজার হাজার রোহিঙ্গা আসছেন বলে জানান।

এদিকে বাংলাদেশে এ যাবৎ ৭ লাখের অধিক রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। আজ (সোমবার) সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে নিজ আইডিতে তিনি লিখেন, ‘নতুন করে ৩ লাখ রোহিঙ্গা এসেছে এবার।’ (আগে থেকেই বাংলাদেশে ৪ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করে আসছেন)।

jagonews24

কক্সবাজার জেলার উখিয়া বাজারের ব্যবসায়ী মালেক সওদাগার বলেন, আগে কখনও এমন পরিস্থিতি দেখিনি। টানা ১৫ দিন ধরে রোহিঙ্গারা আসছেন। দীর্ঘ সময় পথ পাড়ি দিয়ে এসে তাদের অবস্থা একেবারেই নাজেহাল।

জানা গেছে, উখিয়া উপজেলার পালংখালীর আঞ্জুমানপাড়া, টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যংয়ের উনচিপ্রাং, শাহপরীর দ্বীপ, বাহারছড়ার সৈকত এবং বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ির আছারবনিয়া, চাকঢালা, বাইশারি, আমতলি, ঘুমদুম তুমব্রু এলাকা দিয়ে এসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন। বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে নারী-শিশু এবং বৃদ্ধরাও রয়েছেন।

jagonews24

নতুন করে আসা রোহিঙ্গারা চরম বিপাকে পড়েছেন। আগে আসা রোহিঙ্গরা জায়গা দখলে নেয়ায় নতুনদের অনেকেই এখন আশ্রয়হীন অবস্থায় রয়েছেন। স্ত্রী, সন্তান, বৃদ্ধ মা-বাবা নিয়ে সড়কের পাশেই বসে দিন-রাত কাটাচ্ছেন। খাবারও জুটছে না তাদের।

সোমবার সকালে কুতুপালংয়ে এসে রাস্তার পাশে বসেছেন মোয়াজিন হোসেন নামের এক রোহিঙ্গা। সঙ্গে মা, স্ত্রী এবং তিন সন্তানও রয়েছে।

মিয়ানমারে তুমব্রু রাইট গ্রামে তিনদিন না খেয়ে অবস্থান করেছিলেন। রাতে সীমানা পার হয়ে নো ম্যানস ল্যান্ডে চলে আসেন। ভোরে এসে পৌঁছায় কুতুপালংয়ে। তিনি বলেন, গ্রামের অনেকেই এখানে এসেছে বলে জানতে পেরেছি। জীবন নিয়ে পালিয়ে এসেছি, শুকরিয়া। জায়গা হবেই। খাবারও মিলবে।

jagonews24

মিয়ানমারের কুসিডং উপজেলা থেকে এসেছেন রাহেনা। বৌদ্ধ মগেরা স্বামীকে হত্যা করেছে ঈদের দু’দিন পর। পাশেই আরেক বৌদ্ধ বাড়তি পালিয়ে ছিলেন চারদিন। শনিবার রাতে রওনা দিয়ে রোববার বিকেলে বালুখালিতে এসে পৌঁছান। দুই সন্তান নিয়ে রাস্তার পাশে অপেক্ষা করছেন। এপারে এসে এক টুকরো পলিথিন কাগজও সাহায্য পেয়েছেন। এখন জায়গা খুঁজছেন সামান্য টঙঘর বানাতে। রাহেনার মতো অসংখ্য অসহায় রোহিঙ্গারা ছুটে আসছেন বাংলাদেশে।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর হামলা, নির্যাতন, নিধনের মুখে রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের তালিকা তৈরি করবে বাংলাদেশ। এখন পর্যন্ত যত রোহিঙ্গা শরণার্থী এসেছেন সবাইকে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে তালিকাভুক্ত করা হবে।

jagonews24

কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা হাকিম (এডিএম) খালিদ মোহাম্মদ জানান, মিয়ানমার থেকে যারা এসেছেন সবাইকে তালিকভুক্ত করা হবে। চাইলেই যাতে তাদের খোঁজ পাওয়া যায়। সে জন্য তাদের ছবি, আঙুলের ছাপ নেয়া হবে।

উল্লেখ্য, গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের পুলিশের ওপর রোহিঙ্গাদের চালানো হামলার প্রতিক্রিয়ায় রাখাইনে সেনা অভিযান শুরু হয়েছে। যার কারণে তিন লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলমান মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশে শরণার্থীর স্রোত এখনো অব্যাহত রয়েছে। বহু রোহিঙ্গা নিহত হচ্ছেন এবং সীমান্তের দুপাশেই তৈরি হয়েছে এক মানবিক পরিস্থিতি।

 

 

Please follow and like us:

Check Also

‘জলবায়ুু পরিবর্তন’ —– ঝুঁকিতে উপকূলের ৪০ শতাংশ কৃষিজমি

বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা দুই লাখ ৪০ হাজার কৃষকের আবু সাইদ বিশ্বাস,সাতক্ষীরাঃ ‘জলবায়ুু পরিবর্তনে সবচেয়ে বড় …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।