ইসলামে বিবাহ, দেনমোহর ও যৌতুকের বিধান

ইসলামে বিবাহ, দেনমোহর ও যৌতুকের বিধান
-প্রভাষক বি.এইচ.মাহিনী
মানুষের জীবনে এমন কোনো দিক ও বিভাগ নেই যে বিষয়ে আল্লাহর বিধান ইসলামে সুস্পষ্ঠ নির্দেশনা নেই। ইসলাম মানবকল্যাণের ধর্ম, মানব জীবনের ইহ ও পারলৌকিক কল্যাণ এবং নাজাতের ধর্ম। মানুষের সব প্রাকৃতিক ও সামাজিক চাহিদা সহজ, সুন্দর, মার্জিত ও পরিশীলিত উপায়ে পূরণ করাই ইসলামি শরিয়তের উদ্দেশ্য। এ জন্য সৃষ্টি হয়েছে পুরুষ ও নারীর হালাল (বৈধ) উপায়ে যৌন সম্ভোগের মাধ্যম ‘বিবাহ’ নামক বিধানের।
বিবাহের সূত্রপাত : মহান আল্লাহ প্রথম মানব ও প্রথম নবী হজরত আদম আ. কে সৃষ্টি করার পর তিনি (আদম) একাকিত্ববোধ করলেন। আদি পিতা হজরত আদম (আ.)-এর এই একাকিত্ব দূর করার জন্য মহান আল্লাহ তাআলা তাঁর সঙ্গী হিসেবে আদি মাতা বিবি হাওয়া আ. কে সৃষ্টি করলেন। এখান থেকেই শুরু নারী ও পুরুষের দাম্পত্য জীবনের। আল্লাহ রব্বুল আলামিনের মহাপরিকল্পনায় বাবা আদম আ. ও মা হাওয়া আ. দুনিয়ায় এলেন। তাঁদেরই ঔরসজাত সন্তানেরাই শরিয়তের পন্থায় পুরুষ ও নারী একে অপরের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে নতুন প্রজন্ম সৃষ্টি করে পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তুলেছেন। আর সেই সময় থেকে ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে এই বিয়ের রীতি।
বিবাহের পরিচয় : বিবাহের আরবি পরিভাষা ‘নিকাহ’। নারী ও পুরুষের যুগলবন্দী হওয়ার পদ্ধতিকে ‘বিবাহ’ বা ‘বিয়ে’ বলা হয়। বিবাহ সম্পাদনের প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘আক্দ’। আর ‘আক্দ’ সম্পন্ন হওয়ার মৌলিক উপকরণ চারটি যথা- প্রস্তাব, গ্রহণ, সাক্ষী ও দেনমোহর হলো । এ উপকরণগুলোর লিখিত রূপ হলো ‘কাবিন’। বিবাহে কখনো দেনমোহর অনির্ধারিত বা ঊহ্য থাকলে ‘মোহরে মিছল’ বা ‘সমমান মোহর’ বর্তাবে। ‘মোহরে মিছল’ বা ‘সমমান মোহর’ হলো, ঐ পরিবারের অন্য কোনো মেয়েকে দেওয়া সমমানের মোহর। বিবাহ বিধিবদ্ধভাবে রেজিস্ট্রি হওয়া আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক। এতে পূর্বাপর অনেক অহেতুক ঝামেলা থেকে মুক্ত থাকা যায়। যেমন স্বামী বা স্ত্রীর অধিকার নিশ্চিত করা, সন্তানের দায়দায়িত্ব ও ভরণপোষণ ইত্যাদি।
পবিত্র কুরআনে বিবাহ : মহান আল্লাহ মহাগ্রন্থ পবিত্র কুরআনের সূরা ফুরকানে বলেছেন : ‘তিনিই সেই সত্তা! যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন পানি হতে; অতঃপর তিনি তার বংশীয় সম্পর্ক ও বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপন করেছেন। আর তোমার প্রতিপালক সর্বশক্তিমান।’ তিনি সুরা রূমে আরো বলেন, ‘এবং তার নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের নিজেদের মধ্য হতে জোড়া (বন্ধন) সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের নিকটে শান্তি পাও; এবং তোমাদের মাঝে পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য এতে অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে।’
ইসলাম মানবতাবোধ ও চিন্তার উন্মেষ ঘটায়। তাই বৃহত্তর পরিম- সৃষ্টি ও সংকীর্ণতা দূর করা এবং মানুষে মানুষে সখ্য, সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য তৈরির লক্ষ্যে বিশেষ কিছু বিধান দেওয়া হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় একান্ত আপনজনদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রক্তের সম্পর্কিত আত্মীয়স্বজন সব সময় আপন; এখন প্রয়োজন এই সম্পর্কের বাইরের লোকদের আপন করা; বিভিন্ন গোত্র, গোষ্ঠী ও বংশের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করা। তাই একান্ত আপনজনদের সঙ্গে বিবাহবন্ধন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সব বোন বা একাধিক বোন এক পুরুষে সমর্পণ নিষিদ্ধ হলো। সব ভাইয়ের বা একাধিক ভাইয়ের এক কনে গ্রহণও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নিষিদ্ধ করা হয়েছে পিতার বিবাহিতা এবং সন্তানের বিবাহিতা নারীও। যাদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ বা হারাম, আরবিতে তাদের বলা হয় ‘মুহরিম’। মুহরিম শব্দের অর্থ হলো সম্মানিত ও নিষিদ্ধ। ‘মুহরিম’ শব্দটি পুরুষবাচক, এর স্ত্রীবাচক শব্দ হলো ‘মুহরিমাহ’। একজন পুরুষের জন্য ‘মুহরিমাহ’ হলেন ১৪ প্রকার নারী এবং একজন নারীর ক্ষেত্রে ‘মুহরিম’ হলেন ১৪ প্রকার পুরুষ।
মহান আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনের সুরা নিসায় ঘোষণা করেছেন : ‘তোমাদের (পুরুষদের) জন্য হারাম করা হয়েছে তোমাদের মাতা (দাদি, নানি ও ঊর্ধ্বতন), কন্যা (ও অধ:স্তন), বোন (ও অধ:স্তন), ফুফু, খালা, ভাতিজি (ও অধ:স্তন), ভাগনি (ও অধ:স্তন), দুধমা (দাদি, নানি ও ঊর্ধ্বতন), দুধবোন (ও অধ:স্তন), শাশুড়ি (দাদিশাশুড়ি, নানিশাশুড়ি ও ঊর্ধ্বতন) এবং তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যাদের সহিত সংগত হয়েছ তার অন্য পক্ষের (পূর্ব বা পরের স্বামীর) ঔরসজাত ও তার গর্ভজাত কন্যা (ও অধ:স্তন)। তোমাদের জন্য আরও নিষিদ্ধ করা হয়েছে তোমাদের ঔরসজাত পুত্রের স্ত্রী (ও অধ:স্তন) এবং দুই বোনকে (বিয়ের মাধ্যমে) একত্র করা; পূর্বে যা ঘটেছে। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
নারীর জন্য মুহরিম ১৪ পুরুষ হলেন: পিতা (এবং দাদা, নানা ও ঊর্ধ্বতন), পুত্র (ও অধ:স্তন), ভাই (এবং সৎভাই তথা বৈমাত্রেয় বা বৈপিতৃয় ভাই ও অধ:স্তন), চাচা (ও সৎচাচা তথা দাদার অন্য পক্ষের সন্তান বা দাদির অন্য পক্ষের সন্তান), মামা (ও সৎমামা তথা নানার অন্য পক্ষের সন্তান বা নানির অন্য পক্ষের সন্তান), ভাতিজা (ভাই, সৎভাই ও দুধভাইয়ের সন্তান ও অধ:স্তন), ভাগনি (বোন, সৎবোন ও দুধবোনের সন্তান ও অধ:স্তন), দুধপিতা (এবং দুধদাদা, দুধনানা ও ঊর্ধ্বতন), দুধভাই (ও অধ:স্তন), শ্বশুর (এবং দাদাশ্বশুর, নানাশ্বশুর ও ঊর্ধ্বতন), সৎপুত্র তথা স্বামীর ঔরসজাত অন্য পক্ষের পুত্র বা স্বামীর অন্য স্ত্রীর পুত্র (ও অধ:স্তন), সৎবাবা (এবং সৎদাদা, সৎনানা ও ঊর্ধ্বতন)। একত্রে একাধিক স্বামী গ্রহণ করা হারাম এবং বিবাহবিচ্ছেদ বা স্বামীর মৃত্যুর পর ‘ইদ্দত’ (তিন মাস বা চার মাস দশ দিন) পূর্ণ হওয়ার আগে অন্য স্বামী গ্রহণ করাও নিষিদ্ধ।
বিবাহে যৌতুক হারাম দেনমোহর আবশ্যক
‘দেন মোহর’ বা ‘মোহর’ হলো বিবাহের সময় বর কর্তৃক কন্যাকে প্রদত্ত সম্মানী; যার মাধ্যমে তিনি স্বামীর অধিকার লাভ করেন। মোহর নগদে প্রদান করাই শ্রেয়। উভয় পক্ষের সম্মতিতে আংশিক বা সম্পূর্ণ বাকিতেও বিবাহ হতে পারে। তবে তা অবশ্যই পরিশোধযোগ্য। জীবনে পরিশোধ না করলে মৃত্যুর পর ঋণ হিসেবেও সম্পদ বণ্টনের আগে পরিশোধ করতে হবে। বিবাহে দেনমোহর প্রদান প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ সূরা নিসার ৪ নম্বর আয়াতে নির্দেশ করেছেন, ‘আর তোমরা স্ত্রীকে তাদের মোহর দিয়ে দাও খুশিমনে। তারা যদি খুশি হয়ে তা থেকে কিছু অংশ ছেড়ে দেয়, তবে তা তোমরা স্বাচ্ছন্দ্যে ভোগ করো।’ অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, ‘এদের ছাড়া তোমাদের জন্য সব নারী বৈধ করা হয়েছে। শর্ত এই যে, তোমরা তাদের স্বীয় অর্থের বিনিময়ে গ্রহণ করবে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য; ব্যভিচারের জন্য নয়।
ইসলাম নারী জীবনের প্রতিটি বিষয়ে তার অধিকার নিশ্চিত করেছে। বাদ পড়েনি বিবাহে দেনমোহরের অধিকারও। ইসলামি শরিয়তে যৌতুককে হারাম করে দেনমোহর বাধ্যতামূলক করেছে। বিবাহে বর কর্তৃক স্ত্রীকে দেনমোহর আদায় করা ফরজ করা হয়েছে। কিন্তু আজ পরিতাপের বিষয় হলো, দেনমোহর বিষয়ে সমাজে অজ্ঞতা ও অবহেলা বিরাজমান। ধর্মকে ভালোবাসেন, এমন অনেক মানুষও দেনমোহরের বিষয়ে সচেতন নন। এ বিষয়ে অবহেলা এতই প্রকট যে, নফল ইবাদতকে যতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন, মোহর আদায়কে তার সিকি ভাগও মনে করেন না। অথচ দেনমোহর আদায় একটি ফরজ বিধান। বান্দার অধিকা আদায় করা ছাড়া একজন মুসলিম প্রকৃত দ্বীনদার মুমিন হতে পারেন না। তাই বিয়েতে স্ত্রীকে দেনমোহর প্রদান করতে হবে। কেননা দেনমোহন আদায় করা ফরজ আর যৌতুক গ্রহণ হারাম।
বর্তমানে দেনমোহর নামেমাত্র নির্ধারণ করা হয়। অনেকটা যেন নিয়ম রক্ষার বিষয়। আদায় করার কোনো সদিচ্ছা নেই। বিয়ের কাবিননামার ফরমে দেনমোহরের পরিমাণ লিখতে হয়; তাই লেখেন। অথচ দেনমোহর বিয়ে বৈধ করার মাধ্যমও বটে। মহান আল্লাহর নির্দেশেই স্ত্রীকে দেনমোহর দিতে হবে। আর বিয়ের সময়ই স্ত্রীকে দেনমোহর পরিশোধ করার বিধান। স্বামী তার আর্থিক সংগতি অনুযায়ী দেনমোহর দেবে। স্ত্রী দেনমোহর হিসেবে প্রাপ্ত সম্পত্তির মালিক হয়েই স্বামীর সঙ্গে সংসারযাত্রা শুরু করবে। স্বামী কর্তৃক প্রাপ্ত এ সম্পদ এককভাবে স্ত্রীর। এখানে অন্য কারও বিন্দু পরিমাণ অধিকার নেই। স্ত্রী ইচ্ছে করলে প্রাপ্ত দেনমোহর থেকে স্বামীকে কিছু অংশ দিতে পারে। অন্য কাউকেও দান করতে পারে। দেনমোহর স্ত্রীর ব্যক্তিগত অধিকার। দেনমোহরে কার্পণ্যকারী সম্পর্কে মুহাম্মদ (সা.) তাবারানি শরীফের মধ্যে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো নারীকে কম বা বেশি দেনমোহর ধার্য করে বিয়ে করল, অথচ তার অন্তরে দেনমোহরের সে হক আদায়ের আদৌ কোনো ইচ্ছাই নেই, সে ব্যক্তি কেয়ামতের দিন আল্লাহর দরবারে ব্যভিচারী হিসেবে উপস্থিত হবে।’
লেখক-সাংবাদিক, শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক

Please follow and like us:

Check Also

ঢাকায় প্রথম মহিলাদের ঈদের জামাত

বাংলায় মুসলমান সমাজে নারীদের প্রতিকূলতার ইতিহাস অনস্বীকার্য। নারীদের শিক্ষা, চিকিৎসা, বিবাহ ও অন্যান্য ব্যাপারে ইসলামের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।