রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে ঢাকার পাশে থাকবে সুইজারল্যান্ড

স্টাফ রিপোর্টার : বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য এই বছরই ১ কোটি ২০ লাখ সুইস ফ্রাঁ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রপতি অ্যাঁলা বেরসে। ঢাকায় আসা ইউরোপীয় দেশটির রাষ্ট্রপ্রধান গতকাল সোমবার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে এসে এই ঘোষণা দেন।

সুইজারল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট মিয়ানমারের নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক সহায়তার জন্য শেখ হাসিনা সরকারের প্রশংসা করেন এবং এই সমস্যা সমাধানে তার দেশের পক্ষ থেকে পূর্ণ সমর্থনের কথা বলেন। এই সমস্যা সমাধানের জন্য মিয়ানমারের উপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানোর বিষয়টিতে নজর দিতে সুইজারল্যান্ডের প্রতি আহ্বান জানান বাংলাদেশের সরকার প্রধান।

এর আগে দুপুর ৩টার দিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শিমুল হলে একান্ত বৈঠকে বসেন শেখ হাসিনা ও বেরসে। তারপর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চামেলী হলে দুই দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসেন তারা। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পরই করবী হলে এসে যৌথ বিবৃতি দেন দুই নেতা।

চার দিনের সফরে গত রোববার দুপুরে ঢাকায় পৌঁছান সুইস প্রেসিডেন্ট। তাকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। সুইজারল্যান্ডের কোনও প্রেসিডেন্টের এটাই বাংলাদেশে প্রথম আনুষ্ঠানিক সফর। তার এই সফরে আলোচনায় দু’টি বিষয় বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে, মিয়ানমারে সংঘটিত রোহিঙ্গা সংকটে গুরুতর প্রভাবিত বাংলাদেশের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ এবং দুই দেশের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা। সফরে প্রেসিডেন্ট বেরসে আজ মঙ্গলবার কক্সবাজারের কুতুপালংয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করবেন।

বেরসে বলেন, রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশ যে মানবিক ভূমিকা পালন করছে, সেটাকে সাধুবাদ জানাচ্ছে সুইজারল্যান্ড। এই সংকটের সঙ্গে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের প্রশ্ন জড়িত। মানবতা, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের স্বার্থে এই সংকটের সমাধানে বাংলাদেশের পাশে থাকবে সুইজারল্যান্ড।

রোহিঙ্গাদের সহায়তায় সুইজারল্যান্ড এর আগে ৮০ লাখ ফ্রাংক দিয়েছে জানিয়ে দেশটির রাষ্ট্রপতি বলেন, এ দফায় আমরা আরও ১২ মিলিয়ন (১ কোটি ২০ লাখ) ফ্রাংক দেবো বিপদগ্রস্ত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তায়।

বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে সুইস রাষ্ট্রপতি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে দু’দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চার দশকেরও বেশি সময় ধরে। এই সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করতে সুইজারল্যান্ড প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। উন্নয়ন ও বাণিজ্যখাতে বাংলাদেশের সঙ্গে আরও গভীর সম্পর্ক গড়তে চাই। তিনি বলেন, ধারাবাহিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশ যেভাবে সফলতার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে, তা প্রশংসনীয়। সবুজ অর্থনীতি, তথ্যপ্রযুক্তি খাতসহ একাধিক বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।

বেরসে বলেন, বাংলাদেশ গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করতে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় যে প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে সুইজারল্যান্ড তা গুরুত্ব দেয়। কেননা গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন দুই দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের মূল ভিত্তি। সুইজারল্যান্ড এই নীতিতে বাংলাদেশ সরকার, সুশীল সমাজ এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে কাজ করে যাবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বিবৃতিতে বলেন, আমরা দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনা করেছি। মিয়ানমার এই সমস্যা তৈরি করেছে, তাই মিয়ানমারকেই এর সমাধান করতে হবে। এর জন্য দ্রুত কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে হবে। রোহিঙ্গাদের নিরাপদে সম্মানের সঙ্গে তাদের দেশে ফেরত নিতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে সুইজারল্যান্ড জাতিসংঘে যে ভূমিকা রেখেছে তার জন্যও দেশটির রাষ্ট্রপতিকে ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী।

কয়েক যুগ ধরে চার লাখের বেশি রোহিঙ্গার বাংলাদেশে অবস্থানের মধ্যেই গত বছরের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সহিংসতা শুরু হলে বাংলাদেশ সীমান্তে নামে রোহিঙ্গার ঢল। নতুন করে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা ইতোমধ্যে ছয় লাখ ছাড়িছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে পাঁচ দফা প্রস্তাবও তুলে ধরেন।

শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে দারিদ্র্য বিমোচন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং গণতন্ত্র শক্তিশালী করতে বাংলাদেশ সরকারের নেওয়া উদ্যোগের প্রশংসা করেন সুইজারল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায়প্যারিস চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নের উপরও জোর দেন তিনি।

দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা ও বাণিজ্য নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার কথাও বলেন বেরসে। শেখ হাসিনা এসডিজি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ডের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা জোরদার করার উপর জোর দেন।

পরে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে দু’দেশের মধ্যে সব ধরনের সম্পর্ক উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা আমরা লক্ষ্য করেছি।

এর আগে সুইজারল্যান্ডের সফররত প্রেসিডেন্ট অ্যালেন বারসে ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধু স্মৃতি যাদুঘরের সামনে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এম শাহরিয়ার আলম ও বঙ্গবন্ধুর নাতি রেজোয়ান সিদ্দিকী ববি সুইস প্রেসিডেন্টকে অভ্যর্থনা জানান।

প্রেসিডেন্ট যাদুঘরের বিভিন্ন কক্ষ ঘুরে দেখেন। এ সময় সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত অন্যান্যের মধ্যে তার সঙ্গে ছিলেন। ববি প্রেসিডেন্টকে যাদুঘরের ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত করেন এবং তাকে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত জীবনীসহ বঙ্গবন্ধুর জীবনভিত্তিক কিছু বই উপহার দেন।

পরে বারসে পরিদর্শক বইয়ে স্বাক্ষর করেন। এই বাড়িতে বঙ্গবন্ধু তাঁর পরিবার নিয়ে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত বসবাস করেন।

এর আগে সুইস প্রেসিডেন্ট সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। পুষ্পস্তবক অর্পণের পর প্রেসিডেন্ট সেখানে কিছু সময় নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন।

সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর সুসজ্জিত একটি দল প্রেসিডেন্টকে গার্ড-অব অনার প্রদান করে। সেখানে তিনি পরিদর্শক বইয়ে স্বাক্ষর করেন।

Please follow and like us:

Check Also

বিমান থেকে ডলারভর্তি তিনটি ব্যাগ সাগরে ফেলা হয়

অবশেষে মুক্তিপণে ৩১ দিন পর অক্ষত অবস্থায় মুক্তি পেলেন সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে জিম্মি থাকা বাংলাদেশি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।