মালদ্বীপে ঘনীভূত হচ্ছে সঙ্কট, প্রভাব বিস্তারের দৌড়ে ভারত, চীন

ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট:   মালদ্বীপে যখন রাজনৈতিক সঙ্কট ঘনীভূত হচ্ছে, তখন দেশটিকে ঘিরে অনেকটা যেন যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে। ভারত মহাসাগরের এই নয়নাভিরাম দেশটিতে প্রাধান্য বিস্তারের জন্য একে অপরের সাথে টক্কর দিতে নেমেছে হেভিওয়েট চীন আর ভারত।

প্রথম নজরে মনে হবে, মালদ্বীপের সুপ্রিম কোর্ট বর্তমান প্রেসিডেন্টের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীসহ বেশ কিছু বিরোধী রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে জারি করা আদেশ উল্টে দেয়ার পর দেশটিতে যে টালমাটাল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে বেইজিং বা নয়াদিল্লী কেউই হস্তক্ষেপ করতে চায় না। চীন ও ভারত গতানুগতিক কূটনৈতিক সুরে কথা বলছে। তারা বলছে যে দ্বীপরাষ্ট্রটির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের কোন আগ্রহ নেই তাদের। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দুই দেশেরই এখানে কৌশলগত আঞ্চলিক স্বার্থ রয়েছে এবং উভয়েই এখানে নিজেদের প্রাধান্য বজায় রাখতে চায়।

আদালতের আদেশ প্রত্যাখ্যান, জরুরি অবস্থা জারি এবং সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতিকে গ্রেফতারের পর প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন আব্দুল গাইয়ুম “বন্ধু রাষ্ট্র” চীন, পাকিস্তান ও সৌদি আরবে বিশেষ দূত পাঠিয়েছে, সরকারের অবস্থান সম্পর্কে তাদেরকে ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য। তার পদক্ষেপের ফলে এ সন্দেহ দানা বেঁধেছে যে, আগামী নির্বাচনের আগে তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে নিজের কঠোর অবস্থান থেকে নমনীয় হবেন না তিনি।

তার সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী নির্বাসিত সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ ভারতের কাছে আবেদন জানিয়েছেন যাতে সঙ্কট কাটাতে সেনা পাঠায় তারা।

নাশিদ গত সপ্তাহে এক টুইটে বলেন, “মালদ্বীপের জনগণের পক্ষ থেকে আমরা বিনীত অনুরোধ জানাই: ১. বিচারপতি ও রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির জন্য ভারত যেন সামরিক সহায়তাসহ প্রতিনিধি পাঠায়… আমরা তাদের শারীরিক উপস্থিতি কামনা করি।”

ঐতিহ্যগতভাবে, ১২০০ দ্বীপ নিয়ে গঠিত দ্বীপরাষ্ট্র ও এর ৩৯০,০০০ সুন্নী মুসলিম শক্তভাবে নয়াদিল্লীর প্রভাবাধীন ছিল। এমনকি ১৯৮৮ সালে যখন একদল ভাড়াটে দেশটির ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে, ভারত তখন হস্তক্ষেপ করেছিল সেখানে। তাদের হস্তক্ষেপের কারণে মামুন আব্দুল গাইয়ুম ক্ষমতায় টিকে যান। পরে দেশের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট নাশিদকেও সাহায্য করেছে ভারত। পরিবেশ বিপর্যয়ের কুপ্রভাব তুলে ধরতে নিজের দেশের অবস্থা তুলে ধরে তিনি বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন।

কিন্তু ২০১৩ সালের নির্বাচনে নাশিদকে পরাজিত করে মামুন আব্দুল গাইয়ুমের সৎ ভাই ইয়ামিন ক্ষমতায় আসার পর থেকে মালদ্বীপ চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ে।

নাশিদের বেশ কিছু গণতান্ত্রিক অর্জনকে বন্ধ করে দেয় ইয়ামিন। সমস্ত সম্ভাবনাময় বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের কারাদণ্ড দেয়া হয় অথবা নির্বাসনে পাঠানো হয়। তার সরকার বাক স্বাধীনতা কেড়ে নেয়, মানহানির অভিযোগে সাংবাদিক ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের বড় অঙ্কের অর্থদণ্ড দেয়া হয়। ২০১৫ সালে, নাশিদকে ১৩ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়, যে বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলো প্রচুর সমালোচনা করে। পরে ব্রিটেনে আশ্রয় নেন নাশিদ।

উন্নয়নকে সূচনা হিসেবে দেখছে চীন

সিঙ্গাপুরের এস রাজারত্নম স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ভারত-চীন বিশেষজ্ঞ মহালক্ষ্মী গণপাথী বলেন, “২০১১ সাল পর্যন্ত মালদ্বীপে চীনের এমনকি কোন দূতাবাসই ছিল না। ২০১৮ সালে এসে পুরো ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অন্যতম বড় শক্তি হিসেবে আবীর্ভূত হয়েছে তারা।”

ডিসেম্বরে ইয়ামিন যখন বেইজিং সফর করেন, তখন দুই দেশ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করে, যেখানে মালদ্বীপের রফতানির (প্রধানত মাছ) উপর অধিকাংশ শুল্ক মওকুফ করা হয়। অন্যদিকে, অর্থ, স্বাস্থ্যসেবা এবং পর্যটনসহ চীনের পণ্য ও সেবার জন্য মালদ্বীপের বাজার খুলে দেয়া হয়।

চীন এরইমধ্যে মালদ্বীপের প্রধান পর্যটনের উৎসে পরিণত হয়েছে। তাদের খরচেই মূলত মালদ্বীপের অর্থনীতি সচল রয়েছে। এছাড়া বিমানবন্দর সম্প্রসারণ, হাউজিং উন্নয়ন এবং অন্যান্য প্রকল্পে শত শত মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে বেইজিং।

ভারত মহাসাগর ও মধ্য এশিয়ার প্রাচীন বাণিজ্য রুট দিয়ে চীনের “ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড” প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো মালদ্বীপ। এই্ প্রকল্পের অধীনে বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং এশিয়া, আফ্রিকা এবং ইউরোপে চীনের প্রভাব বিস্তারের জন্য বন্দর, রেলওয়ে এবং সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।

এই প্রকল্পের অধীনে দরিদ্র দেশগুলোকে যে বিশাল অঙ্কের ঋণ দিচ্ছে চীন, সেগুলো পরিশোধের সামর্থ্য নিয়ে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। শ্রীলংকা ও পাকিস্তানে যে বন্দর গড়ে তুলেছে চীন, এরইমধ্যে দীর্ঘ মেয়াদের জন্য সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে চীন।

Please follow and like us:

Check Also

বেইজিং ঘনিষ্ট মুইজ্জুর জয়: ভারত থেকে আরও দূরে সরবে মালদ্বীপ

মালদ্বীপে দীর্ঘদিন ধরে থাকা ভারতের প্রভাব কমাতে ‘ইন্ডিয়া আউট’ স্লোগান দিয়ে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।