পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে নৈসর্গিক সৌন্দর্য হারাতে বসেছে সুন্দরবন #কার্যকরী পদক্ষেপ না নিলে ৫০ বছরের হারিয়ে যাবে ৭৫ শতাং সৌন্দর্য

আবু সাইদ বিশ্বাসঃ সুন্দরবন ফিরেঃ গ্রীণ হাউজ ইফেক্ট ও পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে সুন্দরবন সংলগ্ন অঞ্চলে পানিতে লবণক্ষতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে মিঠা পানির উৎস। সুন্দর বনের সুন্দরী গাছের বংশ বৃদ্ধ চরম আকারে হ্রাস পাচ্ছে। প্রতি নিয়ত সুন্দরবনের মুল্যবান গাছ উজাড় হওয়াতে হালকা বনের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। চোরাকারবারীদের হাতে সুন্দরী গাছ চরম আকারে হ্রাস পাচ্ছে। এর সাথে নতুন করে যোগ হয়েছে বাগেরহাটের রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন। সব মিলিয়ে সুন্দরবন তার নৈসর্গিক সৌন্দর্য হারাতে বসেছে। পরিবেশবিদ ও জীববিদদের মতে দ্রুত কার্যকরি পদক্ষেপ না নিলে আগামী ৫০ বছরের মধ্যে হারিয়ে যাবে সুন্দরবনের ৭৫ শতাং সৌন্দর্য।
সুন্দরবন। শুধু বাংলাদেশই নয়, বিশ্ব ঐতিহ্যের একটি নিদর্শন। বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় অঞ্চল গঙ্গা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীত্রয়ের অববাহিকায় অবস্থিত এ অপরূপ সৌন্দর্যের বনভূমি। এর বিস্তৃতি বাংলাদেশের সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলা এবং ভারতের উত্তর চব্বিশ পরগনা ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনাজুড়ে। এটিই পৃথিবীর সববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন। ১০ হাজার বর্গকিলোমিটারজুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশে, আর বাকি অংশ ভারতে। সুন্দরবন ১৯৯২ সালের ২১ মে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট এবং ১৯৯৭ সালে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভ করে। সবচেয়ে ভয়ংকর তথ্য হচ্ছে, গত ২৫ বছরে সুন্দরবনের প্রধান সম্পদ সুন্দরী গাছ যে পরিমাণে কমেছে, তা প্রায় ৫৪ হাজার হেক্টরের সমান হবে। গাছ কমতে থাকায় সুন্দরবনের ভেতরে ঘন বনের পরিমাণ গত ২৫ বছরে কমেছে ২৫ শতাংশ বলে বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশ।
যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা ইউএসএইড ও জন ডি রকফেলার ফাউন্ডেশনের আর্থিক সহায়তায় এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা উইনরক ইন্টারন্যাশনালের তত্ত্বাবধানে সম্প্রতি ‘সুন্দরবনের পর্যটন, ঘূর্ণিঝড় থেকে বসতবাড়ি সুরক্ষা এবং আহরিত সম্পদের আর্থিক মূল্যায়ন’ শিরোনামে একটি গবেষণা করে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৮৯ সালে সুন্দরী গাছ বনের ১ লাখ ৬৬ হাজার ৬৪৫ হেক্টরজুড়ে ছিল। ২০১৪ সালে তা কমে গিয়ে ১ লাখ ১২ হাজার ৯৯৫ হেক্টর হয়। সুন্দরীর পাশাপাশি গেওয়া গাছও দিন দিন কমছে। ১৯৮৯ সালে বনের ১ লাখ ৩২ হাজার ৪৭৭ হেক্টরজুড়ে ছিল এ গাছ। ২০১৪ সালে তা অর্ধেকে নেমে ৭৪ হাজার ১৭০ হেক্টরে পরিণত হয়। বনের ঘনত্ব ও গাছপালার পরিমাণ নির্ধারণ করার জন্য গবেষকরা ১৯৮৯ সাল থেকে পাওয়া সুন্দরবনের স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেণ করে দেখেন, ১৯৮৯ সালে সুন্দরবনের ঘন বনের পরিমাণ ছিল প্রায় ৬৩ শতাংশ। ২০১৪ সালে তা হয় ৩৮ দশমিক ১৮ শতাংশ। ১৯৮৯ সালে সুন্দরবনের জলাধার ছিল ২৯ শতাংশ এবং খালি ভূমি ছিল ২ দশমিক ৬০ শতাংশ। কিন্তু নদীভাঙনের কারণে তা বেড়ে জলাধার হয় ৩২ শতাংশ ও খালি ভূমি হয় ৮ শতাংশ। সুন্দরী গাছ মূলত বনের ভেতরে মিঠাপানির এলাকায় বেশি হয়। কিন্তু লবণাক্ততার পরিমাণ বাড়ছে। বন থেকে এ গাছই চুরি হয় বেশি। এমন হলে সুন্দরবন হারাবে তার জীববৈচিত্র্য ও মূল বৈশিষ্ট্য। পাশাপাশি ঘন বনের পরিমাণ কমে যাওয়ায় সুন্দরবনে হালকা বনের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে।
সুন্দরবনের ৪ শতাধিক নদী, হাজার হাজার খালের অসহণীয় লবণাক্ততা, সিডর-আইলাসহ মানুষ্য সৃষ্টি নানা রকম দুর্যোগে গত ৪০ বছর ধরে নীরবে ধ্বংস হচ্ছে সুন্দরবন। এদিকে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন এভাবে চলতে থাকলে আগামী ৫০ বছরের মধ্যে হারিয়ে যাবে সুন্দরবনের ৭৫ শতাংশ। বর্তমানে সুন্দরবনে ঢুকলেই চোখে পড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপক প্রভাব। ২০০৭ সালের সিডর ও ২০০৯ সালের আইলার ক্ষত এখনো মোছেনি সুন্দরবনের বুক থেকে। বনের অনেক জায়গায় পরে আছে সুকনো ও আধমরা সুন্দরী, গেওয়া, বাইনসহ নানা রকম গাছ। যে গাছগুলো দক্ষিণাঞ্চলের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে সবসময় দাড়িয়ে থাকত মাথা উচু করে, কিন্তু সিডর ও আইলা কেড়ে নিয়েছে ওদের ডালপাতা, কিছু গাছ উপরে পরেছে, আর কিছু শুকিয়ে গেছে। এই আধমরা গাছগুলির প্রাণ ফিরিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করে হলেও প্রতিকুল জলবায়ু, সমুদ্রের পানি বৃদ্ধি, অনেক খাল ও নদী শুকিয়ে যাওয়ার ফলে মিষ্টি পানির প্রবাহ কমে যাওয়া, কিছু নদীতে আবার লবন পানির প্রবাহ আশঙ্কাজনক ভাবে বেড়ে যাওয়া, বায়ুমন্ডলে কার্বনের পরিমান বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে তা সফল হয়নি। তাই গাছগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে আর সুন্দরবন হারাচ্ছে তার স্বাভাবিকতা।
পরিবেশবিদ ও জীববিদদের মতে, সুন্দরবন সমুদ্র উপকুলবতী নোনা পরিবেশের একটি বড় অখন্ড ম্যানগ্রোভ বন।সারা পৃথিবীর ৩টি ম্যানগ্রোভ বনের মধ্যে সুন্দরবনের অবস্থান সবচেয়ে মর্যাদা সম্পন্ন ।
বন বিভাগের পরিসংখ্যন অনুযায়ী এর মধ্যেই সুন্দরবনের পশ্চিম বন বিভাগের সবচেয়ে গহিনে অবস্থিত মান্দারবাড়িয়া ক্যাম্প সমুদ্রবক্ষে হারিয়ে গেছে। যার অবস্থান ছিল বঙ্গপসাগর থেকে মাইল কয়েক দূরে। মান্দারবাড়িয়ায় ছিল একটি মিষ্টি পানির পুকুর, যার পানি খেয়ে হাজার হাজার জেলে, বনরক্ষী, বাওয়ালী, মৌয়ালসহ ওই এলাকার বাসিন্দারা মিষ্টি পানির অভাব পূরণ করত। সুন্দরবনে মাছ ধরতে আসা জেলেদের মতে মান্দারবাড়িয়ার মিষ্টি পুকুরসহ সেখানকার ১৫-২০কি.মি. এলাকা সমুদ্রগর্ভে ডুবে গেছে। আমাবস্যা ও পুর্ণিমান জোয়ারে সুন্দরবনের বিস্তৃীর্ণ অঞ্চল ভেসে গেলেও পথ না থাকায় ভাটার সময় সে পানি আর নামতে পারে না, যার ফলে সৃষ্ট হয় ভয়ঙ্কর লোনা পানির জলাবদ্ধতা। এর কারণে স্বভাবতই ম্যানগ্রোভ গাছ শ্বাস ছাড়তে না পেরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে সুন্দরবনের অতন্দ্র প্রহরী সুন্দরী গাছ। দুবলোর চর,আলোরকোল,মেহের আলীর চর,হিরোণপয়েন্ট সহ কয়েকটি চরে শত শত গাছ মারাগেছে পরিবেশ বির্পয়ের কারণে। বনবিভাগের কয়েকটি আশ্রায় কেন্দ্র নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে।
বন রাণীর আদরের ধন গাজী, কালু, চম্পাবতী, মৌয়াল, বাওয়ালী, সুন্দরী, কুমির, বানর , হরিণ, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, বনমোরগসহ হাজার প্রজাতীর প্রাণী আজ হুমকির মুখে। বন বিভাগের এককর্মকর্তা জানান, “প্রায় ৪০বছর ধরে সুন্দরবনের এ ধ্বংসাত্মক প্রবনতা লক্ষ্য করা যায় তবে তখন এ প্রবণাবনতা ছিল ক্ষীণ। সুন্দরী গাছের প্রায় সবই কালো হয়ে মারা যাচ্ছে। তিনি আরো বলেন, বনের প্রায় ৭৩ শতাংশ গাছই সুন্দরী গাছ। বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ৫০ বছরে সুন্দরবনের ৭৫ শতাংশ ভূমিই গাছশূন্য মরুভূমিতে পরিনত হবে।” সুন্দরী গাছের এ অকাল মৃত্যুর জন্য বিশেষজ্ঞরা এখানকার নদী ও বঙ্গপসাগরের পানির উচ্চতা বাড়াকে দায়ী করেন। নদী বিশারদ ড. আইনুন নিশাতের মতে, ফারাক্কা বাধের পরই প্রথম খুলনা, বাগেরহাট, ও সাতক্ষিরা ১৯৭৫সালের পর থেকেই নিয়মিত বেড়ে চলেছে সুন্দরবনের লবণাক্ততা এবং নদীর পানিতে উচ্চমাত্রার এলকোহল পাওয়া গেছে। দুবলার চর সংলগ্ন নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যায়াতে শত শত নৌকা নদীর মাঝখানে আটকে যেতে দেখা যায়। এমনকি এর প্রতিবেদক ও পায়ে হেটে নদীটি পার হয়। সাগরের বুকে ছোট নদী গুলোর একই অবস্থা। উপকুলীয় শ্যামনগর,কালিগঞ্জ,আশাশুনির নিন্ম অঞ্চলে দিন দিন লবণক্ষতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
রামপাল কয়লা ও তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র্র্র নিয়ে মিথস্ক্রিয়া থাকলেও ইউনেস্কোর দেওয়া রিপোর্টের পর তা অনেকখানি চুপসে গেছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, এ তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ফলে সুন্দরবনের যে ক্ষতি হবে, তা অপূরণীয়। সচেতানা
এবিষয়ে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইফতেখার হোসেন জানান, সুন্দরবন আমাদের সকলের সম্পদ। দেশের সম্পদ। বিশ্বের ঐহিত্য। এবন রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সকলের। সুন্দরবন রক্ষায় জনসচেতনা বৃদ্ধির পাশা পাশি চোরাকারবারী রোধ করতে প্রশাসক বদ্ধ পরিকর। সুন্দর বনের কোন সম্পদ যেন অপচয় না হয় সেদিকে আমাদের লক্ষ্য রয়েছে।

Check Also

বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে: স্মৃতিসৌধে পরিদর্শন বইয়ে রাষ্ট্রপতি

মহান স্বাধীনতা দিবসে ঢাকার সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের প্রতি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।