অভয়নগরে জমে উঠেছে ঐতিহাসিক বার্ষিক দিঘিরমেলা : চলবে শুক্রবার পর্যন্ত

বিশেষ প্রতিনিধি (অভয়নগর) : পীর খানজাহান আলীর স্মৃতি বিজড়িত অভয়নগর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী বাশুয়াড়ী খানজাহান আলী দিঘির পাড়ে প্রতি বছরের ন্যায় এবারো বসছে বার্ষিক মেলা। গত শুক্রবার শুরু হওয়া মেলা চলবে আগামি শুক্রবার পর্যন্ত। সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, এবারের মেলা চৈত্র পূর্নিমা থেকে এখন পর্যন্ত জমে উঠছে দিন দিন। প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে ভোর রাত পর্যন্ত চলে এ মেলা। এখন মেলার মধ্যমা। এ সময় মেলা প্রাঙ্গনে লোকে লোকারান্য। যশোর-খুলনাসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে লাখো মানুষের ঢল নেমেছে মেলায়। মেলা প্রাঙ্গণে ঢুকতেই চোখে পড়ে অসংখ্য মিষ্টি ও হোটেল। দোকানদারের সাথে কথা বলে জানা গেছে মেলায় তারা হরেক রকমের মিষ্টির সমাগম ঘটিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে রসগোল্লা, জিলাপি, পানতোয়া, কচড়া, রাজভোগ, ছানাজিলাপি ইত্যাদি। এরপর রয়েছে মনিহারি পট্টি। সেখানে রঙ-বে-রঙের সাজে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার দেখা। চলছে কেনা-কাটা। এ পট্টিতে বিশেষভাবে বিকিকিনি হয় হরেক রকমের চুড়ি, গ্রামীন মেয়েদের সাজের বিশেষ উপকরণ। এছাড়াও চোখে পড়ে শিশু-কিশোরদের জন্য রয়েছে মনজুড়ানো সব খেলনা। রয়েছে বাঁশি, ভুভুজেলা, পাখি, ক্রিকেট ব্যাট, বল ইত্যাদি। দিঘির পশ্চিম পাড়ে বসেছে স্বল্পমূল্যে চোখ ধাঁধানো ডিজাইনের কাঠের আসবাবপত্র তথা ফার্নিচার। সেখানে নবদম্পতি ও মহিলাদের ঢের ভিড়। মেলার বিশেষ আকর্ষণ নাগর দোলা ও রাইডার। প্রতি বছর চৈত্র মাসের পূর্ণিমায় এ মেলা বসে। চলে ৭-৮দিন। মেলার সভাপতি ও ইউনিয়ন আ’লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শেখ ইদ্রিস আলী মেম্বর জানান, এলাকাবাসী ও স্থানীয় প্রশাসনের সার্বিক সহযোগিতায় এবারের মেলা আগামি কাল ৩০ মার্চ শুক্রবার শুরু হয়ে ৬ এপ্রিল শুক্রবার পর্যন্ত চলবে এ মেলা। তিনি আরো জানান, এবারের মেলাটি যশোর জেলার মাননীয় জেলা প্রশাসক মহোদয় কর্তৃক অনুমোদিত। আধ্যাত্মিক পীর ও আল্লাহর পেয়ারা ওলী খানজাহান আলী রহ. এর নিদর্শন এ দিঘি দেখতে উক্ত দিনগুলোতে দেখা মেলে হাজার হাজার মানুষের ভিড়। ভক্ত আর মেলা প্রেমীদের পদাভারে রোমাঞ্চিত হয় দিঘির পাড়। ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, ইসলামে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম ধর্মের আগমন ঘটে হিজরি ২য় শতক তথা সপ্তম খ্রিষ্টব্দে। তবে কোনো কোনো ঐতিহাসিক রাসুলের যুগেই ভারতীয় উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশে ইসলামের আগমন বলে ধারণা করেছেন। এসময় থেকে ইসলামের খেদমতে যারাই এ ভূখন্ডে আগমন করেছেন তাঁরা সবাই তাদের কিছু অলৌকিক নিদর্শন রেখে গেছেন ভবিষৎ প্রজন্মের জন্যে। তেমনি একটি নিদর্শন হলো অভয়নগর উপজেলার শুভরাড়া ইউনিয়নের বাশুয়াড়ির পীর খানজাহান আলীর দীঘি। এ উপজেলার দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে বাশুয়াড়ী খানজাহান আলী দিঘি অন্যতম। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও চৈত্র পূর্ণিমায় বসছে সেখানে বাৎসরিক মেলা। মেলায় সমাগম ঘটেছে আশেপাশের কয়েকটি জেলার মানুষের। ইতিহাস নন্দিত জননায়ক ও কামেল দরবেশ খানজাহান আলী জৌনপুর হতে যশোর আসেন। তিনি পায়গ্রাম কসবা হতে দলবল নিয়ে রাস্তা, দীঘি ও মসজিদ নির্মাণ করতে করতে পূর্বাভিমুখে অগ্রসর হতে থাকেন। কিছুদূর আসার পর ভৈরব পার হয়ে অভয়নগর উপজেলার শুভরাড়া ইউনিয়নের বাশুয়াড়ী গ্রামে বিশ্রামের জন্য আস্তানা ফেলেন। খানজাহান আলীর বিশ্রামেরও একটি উদ্দেশ্য থাকত। তার বিশ্রাম মানে দীঘি, রাস্তা ও মসজিদ ও নগর। যেখানে তিনি বিশ্রাম নিয়েছেন সে স্থান হয়ে উঠেছে ঐশ্বর্যময়। বাশুয়াড়ীতে তিনি উচু পাড় সম্বলিত ২৭৫ গজ দৈর্ঘ্য ও ২২৫ গজ প্রস্থের আয়তনে একটি বিশাল দীঘি খনন করেন। পাড়সহ দীঘির আয়তন প্রায় ৭০ বিঘা। দীঘির চর্তুপার্শ্বে পাড়ের উপর রোপন করেন প্রচুর বৃক্ষ। স্থাপন করেন ঘাট। দীঘির পশ্চিম পাড়ে রয়েছে ঈদের জামায়াতের জন্য সুউচ্চ মিনার সম্বলিত ‘ঈদগাহ’। কথিত আছে, তিনি একদিন একরাতের মধ্যে এ বিশাল দীঘি খনন করেন। পঞ্চাশ হাজার লোক দীঘিখননে অংশ নিয়েছিলেন। প্রতিবছর চৈত্রপূর্ণিমায় দীঘির চার পাশে বিশাল মেলা বসে। হাজার হাজার মানুষ পূণ্য অর্জনের জন্য এ দীঘিতে সমবেত হন।শুধু মুসলমান নয় বরং বিভিন্ন ধর্মের লোকজন খানজাহান আলীর উদ্দেশ্যে দীঘীতে মানতের মোরগ-মুরগী, কবুতর, হাঁস, দুধ ইত্যাদি নিক্ষেপ করেন। কিছু লোক ছেড়ে দেয়া মোরগ-মুরগী, ও কবুতর ধরার জন্য পানিতে নেমে সচকিত হয়ে থাকে। মেলা ছাড়াও প্রতিদিন খানজাহান পীরের নামে শত শত লোক শিরনি মানত করেন। জনশ্রুতি, পুকুরে প্রধান ঘাটে একটি পাথর ছিল। ভৈরব নদীর ¯্রােত-উজানের বিপরীত দিক হতে পাথরটি ভেসে এসেছিল। পাথরের ওজন ছিল ষাটমন। যে কেউ খাস দিলে হাত দিলে পাথরটি শোলার মতো হালকা হয়ে হাতে চলে আসত। কিন্তু বদ অন্তরে এক হাজার লোকও পাথরটি সামান্যও নড়াতে পারতো না। এলাকার বয়ঃজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিবর্গ জানান, একসময় পাথরটি ছিল এখন নেই। মানুষের পাপাচার সহ্য করতে না পেরে পাথরটি আত্ম গোপন করেছে। দীঘির পাড় বৃক্ষময় প্রকৃতি ও নীল সলিলের স্বচ্ছ পরিস্ফুটন অবাক করে দেয় প্রান আর মন। এখানে প্রতি বছরের ন্যায় এবারো বসছে ঐতিহ্যবাহী দীঘির মেলা। মেলার নিরাপত্তা নিয়ে কথা হয় স্থানীয় ইউপি মেম্বর ও বাশুয়াড়ি পুলিশ ফাঁড়ির কর্মকর্তারা জানান, এবারের মেলাকে ঘিরে বাশুয়াড়ি দীঘিরপাড় ও আশেপাশের এলাকায় শতভাগ নিরাপত্তার ব্যবস্থা রয়েছে। সাধারণ মানুষ নির্ভয়ে চলাচল করতে পারছে।

Please follow and like us:

Check Also

বাবার ইমামতিতে ছেলের জানাজা

চাঁদপুর শহরের হাজি মহসিন রোডের রেলওয়ে নূরানি জামে মসজিদের ইমাম ও খতিব মাও. আ ন …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।