কোটা সংস্কার আন্দোলন *আশ্বাস প্রত্যাখ্যান, আলটিমেটাম* ৩১ ঘণ্টা অচল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

* জাবি, জবি, রাবি, চবি, বাকৃবিসহ সবখানে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে * শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেয়ার আহ্বান ঢাবির শিক্ষক সমিতির * ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে মিছিলে হামলাসহ গুলির অভিযোগ * ৭ মে পর্যন্ত কর্মসূচি স্থগিত করেছে মূল কমিটি * আটককৃতদের মুক্তি, মামলার প্রস্তুতি * আন্দোলনকারীদের ওপর হামলায় উদ্বিগ্ন মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান * হল থেকে রাতে বেরিয়ে আসে শত শত ছাত্রী, সারা রাত টিএসসিতে অবস্থান * ১২ পুলিশসহ দু’শতাধিক আহত, একজন গুলিবিদ্ধ

ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোট : কোটা ব্যবস্থা পরীক্ষা-নিরীক্ষার সরকারি আশ্বাস প্রত্যাখ্যান করেছে আন্দোলনকারী চাকরি প্রত্যাশী ও শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। তারা ৬ দিনের মধ্যে দাবি মেনে নেয়ার জন্য সরকারকে আলটিমেটাম দিয়েছেন। ১৫ এপ্রিলের মধ্যে ৫ দফা দাবি মেনে না নিলে ১৬ এপ্রিল ‘চলো চলো ঢাকায় চলো’ কর্মসূচি নিয়ে ফের কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলবেন তারা। ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত তারা মাঠেই থাকবেন। এর অংশ হিসেবে আজ বেলা ১১টায় তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে ফের অবস্থান কর্মসূচি পালন করবেন। সোমবার রাত সাড়ে ৯টার পর এ ঘোষণা দেয়া হয়। তবে আন্দোলনের মূল কমিটির নেতারা ৭ মে পর্যন্ত কর্মসূচি স্থগিত করেছেন।

এর আগে সোমবার বিকালে আন্দোলনকারীদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের’ ২০ নেতা সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। ওই বৈঠকের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতেই নেতারা ৭ মে পর্যন্ত কর্মসূচি স্থগিতের ঘোষণা দেন। ক্যাম্পাসে ফিরে নেতারা সিদ্ধান্তের কথা জানালে প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনকারীরা তাৎক্ষণিকভাবে ওই ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করেন। একই সঙ্গে টিএসসি এলাকায় অবস্থান নেয়া আন্দোলনকারীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। শত শত আন্দোলনকারী নানা স্লোগান দিতে থাকেন। তারা কোটার ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে সোমবারই ঘোষণার দাবি তোলেন। নইলে ফিরে না যাওয়ার ঘোষণা দেন। এ পরিস্থিতিতে টিএসসিতে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া শুরু হয়। রাত সাড়ে ৯টার দিকে তা থেমে যায়।

রাত সাড়ে ৯টার পর ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত আলটিমেটাম দেন বিপাশা চৌধুরী নামে এক শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা তাদের সমাবেশের আশপাশে ঘোরাঘুরি করছেন। তাই পরিস্থিতি নিরাপদ মনে না করায় তারা সোমবার রাতের জন্য আন্দোলন স্থগিত করেন। যেহেতু সরকারের আশ্বাসে কোনো সাধারণ শিক্ষার্থী খুশি নন, তাই মঙ্গলবার (আজ) বেলা ১১টায় তারা ফের টিএসসি রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে অবস্থান নেবেন। এভাবে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত অবস্থান চলবে। পাশাপাশি সব কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন কর্মসূচি চলবে। এর মধ্যে দাবি মেনে না নিলে ১৬ এপ্রিল ‘চলো চলো ঢাকা চলো’ কর্মসূচি পালিত হবে।

আন্দোলনের কারণে সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ বিভাগে কোনো ক্লাস হয়নি। কার্যত প্রায় ৩১ ঘণ্টা ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অচল। কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে গড়ে উঠা এ আন্দোলন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ে। জাহাঙ্গীরনগর ও জগন্নাথ, চট্টগ্রাম, বরিশাল, ময়মনসিংহ, গোপালগঞ্জ, রংপুর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেন বলে খবর পাওয়া গেছে।

সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকেও কোটা ব্যবস্থা নিয়ে গড়ে উঠা আন্দোলন প্রসঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়। বৈঠকের পর মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের বলেন, কোটা ব্যবস্থা সম্পর্কে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে পরীক্ষার-নিরীক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়া বিকালে ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’র নেতাদের সঙ্গে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বৈঠক করেন। ওই বৈঠকের পর আন্দোলনকারীরা ১ মাসের জন্য কর্মসূচি স্থগিত ঘোষণা করেন। ক্যাম্পাসে ফিরে তারা সরকারের সঙ্গে আলোচনা এবং নিজেদের সিদ্ধান্তের কথা জানালেও সাধারণ শিক্ষার্থীরা তা মেনে নেননি। বরং আলোচনায় অংশ নেয়া নেতাদের সরকারের দালাল বলে উল্লেখ করে ‘এখনই’ কোটার বিষয়ে ঘোষণার দাবিতে টিএসসিতে অবস্থানের ব্যাপারে অনড় থাকেন।

এদিকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। সোমবার বিকালে সমিতির এক জরুরি সভা থেকে এ আহ্বান জানানো হয়। এছাড়া জাতীয় মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা ও আহতের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে ছাত্রলীগের তিন নেতা সোমবার রাতে পদত্যাগ করেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, সোমবারও ক্যাম্পাসে পুলিশ মোতায়েনের প্রতিবাদ এবং শিক্ষার্থীদের ওপর কাঁদানে গ্যাস ও টিয়ার শেল নিক্ষেপের ঘটনার বিচার ও ক্ষতিপূরণ চেয়ে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে অবস্থান নেন শত শত আন্দোলনকারী। তারা ক্যাম্পাসের প্রায় সবক’টি প্রবেশপথ বন্ধ করে দেন। অধিকাংশ বিভাগেই ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করেন শিক্ষার্থীরা। এছাড়া আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর টিয়ার শেল ছোড়ে। এর আগে রোববার রাতে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে পুলিশের ব্যাপক প্রতিরোধের মুখে আন্দোলনকারীরা পিছু হটতে বাধ্য হন। রাত ৪টার দিকে তারা কার্জন হলের দিকে অবস্থান নেন।

সোমবার দিনের শুরু হয় ছাত্রলীগের হামলার মধ্য দিয়ে। সকালে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ নেতাদের নেতৃত্বে একটি দল মিছিল নিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর আক্রমণ করে। এদের বেশিরভাগই বহিরাগত বলে দাবি করেন কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীরা। তখন আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে পুলিশ। এ সময় আন্দোলনকারীরাও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এতে ছাত্রলীগ পিছু হটতে বাধ্য হয়। এতে ছাত্রলীগের এক নেতাসহ উভয় পক্ষের বেশ কয়েকজন আহত হন। এদিকে ধাওয়া খেয়ে ছাত্রলীগ মধুর ক্যান্টিনে অবস্থান নেয়। তখন আন্দোলনকারীরা রাস্তায় বেরিয়ে দোয়েল চত্বর এলাকায় অবস্থান নেন। গুলির ঘটনায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা ভিসির পদত্যাগের দাবিতে মিছিল করেন। তখন পুলিশ তাদের ফের ধাওয়া দেয়।

এদিকে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে টিএসসিতে আন্দোলনকারীদের ভিড় বাড়তে থাকে। তারা রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে অবস্থান নিয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভ করতে থাকেন। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পয়েন্টে ব্যাপক পরিমাণে পুলিশ মোতায়েন ছিল। দুপুর ২টার দিকে আন্দোলনকারীরা টিএসসিতে থাকা পুলিশকে ধাওয়া দেন। এ সময় পুুলিশ পিছু হটে টিএসসি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। পরে তারা ব্যারিকেড দিয়ে এ এলাকার সব সড়কের যান চলাচল বন্ধ করে দেন। সোমবার বিকালে আন্দোলনকারীদের ২০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। পরে সেখান থেকে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা আসে। এ সময় টিএসসিতে অবস্থানরত শিক্ষার্থীরা ‘মানি না, মানব না’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন।

রাতের অবস্থান : আন্দোলনের নেতারা ফিরে আসার পর সমবেতদের কাছে আলোচনার সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন। পাশাপাশি তাদের দাবির যৌক্তিকতা পর্যালোচনা এবং কোটা ব্যবস্থা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সরকারকে ১ মাসের সময় দেয়া ও ৭ মে পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত করার সিদ্ধান্তের ঘোষণা করেন। কিন্তু সমবেতরা ওই ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করেন। তারা নেতাদের সরকারের ‘দালাল’ ও ‘ভুয়া, ভুয়া’ ধ্বনি তোলেন। পাশাপাশি অবস্থান না ছাড়ার ঘোষণা দেন।

আন্দোলনকারীরা এর আগে থেকেই মাথায় ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই’ লেখা কাপড় বেঁধে এবং একই লেখা সংবলিত টি-শার্ট পরে বিক্ষোভে অংশ নেন। এ সময় তাদের হাতে ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি। তারা বিক্ষোভ থেকে ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’র সুনির্দিষ্ট ৫টি দাবি তুলে ধরেন। দাবিগুলো হল- কোটা ব্যবস্থার সংস্কার করে ৫৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশে নিয়ে আসা; কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে খালি থাকা পদগুলোতে মেধাবীদের নিয়োগ দেয়া; কোনো ধরনের বিশেষ পরীক্ষা না নেয়া; সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সবার জন্য অভিন্ন বয়সসীমা এবং চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা সুবিধা একবারের বেশি ব্যবহার না করা।

শিক্ষার্থীদের দিকে গুলি ছোড়ার অভিযোগ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে : এদিকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে রোববার রাত ও সোমবার সকালে গুলি ছোড়ার অভিযোগ উঠে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। গুলিতে লোকপ্রশাসন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের আশিকুর রহমান পল্লব নামে এক ছাত্র আহত হন। তার বুকে গুলি লেগেছে বলে গোয়েন্দা সূত্র নিশ্চিত করেছে। গুলিবিদ্ধ পল্লব ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১০২ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন।

আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, রোববার রাত আড়াইটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসভবনের সামনে এবং সোমবার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে দ্বিতীয় দফা কার্জন হলে তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। এদের মধ্যে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পর্যায়ের একজন নেতা রয়েছেন বলেও জানান তারা। এ বিষয়ে ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইন বলেন, মিছিল থেকে কোনো গুলি ছোড়া হয়নি। এ কথার কোনো ভিত্তি নেই।

এর আগে দাবি আদায়ে রোববার দুপুর ২টা থেকে শত শত শিক্ষার্থী ঢাকায় শাহবাগ দখল করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় রাতভর চলে কর্মসূচি। রাতে একপর্যায়ে ৫টি ছাত্রী হল থেকে শত শত ছাত্রী গেট ভেঙে টিএসসিতে এসে কর্মসূচিতে যোগ দেন। সেখানে তারা সারা রাত অবস্থান করেন। একপর্যায়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগ কর্মীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। ওই রাতেই ভিসির বাসভবনে হামলার ঘটনা ঘটে। এছাড়া ভিসির বাসভবনের সামনে এক ছাত্রের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবরও পাওয়া গেছে। ওই ছাত্র ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বলে জানা গেছে। এ আন্দোলনে শুধু ঢাকাতেই দু’শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। ঢাকার বাইরেও আহত হয়েছেন অনেক শিক্ষার্থী। পুলিশ আহত হয়েছে ১২ জন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থান থেকে ২৫ জনকে আটক করা হয়েছে। রোববারে ঢাকার আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করে দেশব্যাপী বিভিন্ন স্থানেও আন্দোলন গড়ে উঠে। এসব বিষয়ই সোমবারে সারা দেশে আলোচনার কেন্দ্রে ছিল। এ নিয়ে বিএনপিসহ বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি মুখ খোলেন। অনেকেই শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে যৌক্তিক বলে উল্লেখ করেন।

হলের গেট ভেঙে রাতভর টিএসসিতে ছাত্রীদের অবস্থান : এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সমর্থন জানাতে রোববার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে ছাত্রীরা গেট ভেঙে বের হয়ে যান। তাদের অভিযোগ, ছাত্রলীগ তাদের ওপর হামলা করেছে। এতে তাদের অন্তত দশজন আহত হয়েছেন। টিএসসি থেকে পুলিশ সরে না যাওয়া পর্যন্ত তারা হলে ফিরে যাবেন না বলেও ঘোষণা দেন। পরে পুলিশ টিএসসি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এরপর সোমবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামালসহ সিনিয়র শিক্ষকদের হস্তক্ষেপে ৪টি হলের হাজারখানেক শিক্ষার্থী আবাসিক শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে হলে ফিরে যান। এছাড়া বাংলা একাডেমি থেকেও আন্দোলনকারী দুই ছাত্রীকে উদ্ধার করা হয়।

আটককৃতরা মুক্ত, মামলা হতে পারে : রাত সাড়ে ১০টার দিকে পুলিশের রমনা জোনের ডিসি মারুফ হোসেন সরদার যুগান্তরকে জানান, রোববারের পর থেকে যেসব শিক্ষার্থীকে আন্দোলনের কারণে আটক করা হয়েছিল তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে। অপরদিকে শাহবাগ থানার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে যুগান্তরকে বলেন, দু’দিনের ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো মামলা করা হয়নি। তবে একটি মামলা হতে পারে। এদিকে রোববারের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার সতর্ক অবস্থানে ছিল পুলিশ। দ্বিতীয় দিন সোমবার তারা অনেকটা কৌশলী ভূমিকায় ছিল। ভোর থেকে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা শাহবাগ থানায় অবস্থান নেন। সেখানে পুরো প্রক্রিয়াটি দেখভাল করেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ও কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) প্রধান মনিরুল ইসলাম। তার সঙ্গে ছিলেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার দেবদাস ভট্টাচার্য। তারা আন্দোলন দমন করতে পুলিশকে ৭টি ভাগে ভাগ করে সকাল থেকে নির্ধারিত স্থানে যাওয়ার নির্দেশ দেন। শাহবাগ থানা পুলিশ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

এছাড়া র‌্যাব-৩ এর একটি দল সকাল থেকে শাহবাগ এলাকায় অবস্থান নেয়। সকাল থেকে শাহবাগ মোড়ে রমনা জোনের এডিসি আজিমুল হক ও মতিঝিল জোনের এডিসি শিবলী নোমানের নেতৃত্বে পুলিশ অবস্থান নেয় শাহবাগ থানার সামনে। পুলিশ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সেখানে অবস্থান নিয়ে আন্দোলনকারীদের বিভিন্ন কৌশলে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয়।

এদিকে সোমবার সকাল থেকে ছাত্রলীগের বিভিন্ন ইউনিটের নেতাকর্মীরা মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে। এদিকে রোববারের ঘটনায় আটক ২৫ আন্দোলনকারীকে শাহবাগ থানায় আটক রাখা হয়েছে।

এদিকে রোববারের আন্দোলনের সময় পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষে আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়। আহতদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের এক ছাত্র পল্লবের মৃত্যু হয়েছে বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। সংঘর্ষের ঘটনায় ২৫ জনকে আটক করার কথা স্বীকার করেছে পুলিশ। তবে আন্দোলনকারীদের দাবি, পুলিশ ৪০ জনকে আটক করেছে। আটককৃতদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে বলে জানা গেছে।

এর আগে ১৭ ফেব্রুয়ারি কোটা সংস্কারের দাবিতে শাহবাগে মানববন্ধন করেন চাকরিপ্রত্যাশীরা। পরে আবার ২৫ ফেব্রুয়ারি মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দেন তারা ৩ মার্চের মধ্যে এ সমস্যার সমাধান দাবি করে। সমাধান না হওয়ায় আবার আন্দোলনে নেমেছেন তারা। এছাড়া ১ থেকে ৭ এপ্রিল ছিল ‘কোটা সংস্কার সচেতনতা সপ্তাহ’।

শিক্ষক সমিতির আহ্বান, কর্মসূচি : এদিকে সোমবার বিকাল ৪টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির জরুরি সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা থেকে সংবিধানের আলোকে কোটা সংস্কারের ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। এতে মধ্য রাতে ঢাবির ভিসি ভবনে বর্বরোচিত হামলা, ভাংচুর এবং সপরিবারে ভিসিকে হত্যার অপচেষ্টার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়। একই সঙ্গে অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে বিচারের দাবি জানান তারা।

এছাড়া সভায় যেসব শিক্ষার্থী কোটা সংস্কারের আন্দোলনে আহত হয়েছেন তাদের প্রতি সহানুভূতি জ্ঞাপন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনায় সুচিকিৎসার ব্যবস্থার দাবিও জানানো হয়। ভিসির বাসভবনে হামলার প্রতিবাদে সভায় ৩ দিনের কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে আছে- আজ বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে মানববন্ধন এবং দুপুর ১২টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত সিনেট ভবনে ভিসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সমবেদনা জ্ঞাপন। বুধবার ঢাবি পরিবারের সব সদস্য, দেশের সব গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা ও বিশিষ্ট ব্যক্তি, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, ঢাবি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনগুলোর সদস্যদের ভিসির ভবনে সংঘটিত তাণ্ডবলীলা প্রত্যক্ষ করার ব্যবস্থা গ্রহণ।

১২ এপ্রিল দুপুর ১২ থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত অফিসগুলোতে ১ ঘণ্টার কর্মবিরতি এবং শিক্ষকরা কালো ব্যাজ ধারণ করে শ্রেণীকক্ষে ভিসির ভবনে তাণ্ডবলীলার ভয়াবহতা বর্ণনা দেবেন। সভা থেকে ভিসি ভবনসহ প্রশাসনিক এবং আবাসিক এলাকাগুলোর নিরাপত্তা জোরদারের দাবি জানানো হয়।

তিন ছাত্রলীগ নেতার পদত্যাগ : কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদ জানিয়ে সংগঠনের তিন নেতা পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। তারা হলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস অনুষদের ট্যুরিজম বিভাগ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল্লাহ সাইফ, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক ছাত্রলীগের উপ-অ্যাপায়ন বিষয়ক সম্পাদক আছিবুর রহমান এবং ফলিত পরিসংখ্যান বিভাগ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শরীফ হাসান সুজন। পদত্যাগের ঘোষণা দেয়া নেতারা জানিয়েছেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে তারা এ সিদ্ধান্ত নেন।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের উদ্বেগ : সোমবার কমিশনের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশের হামলা ও আহত হওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এতে কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, ‘বাংলাদেশের সংবিধানে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হওয়া এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করার অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। ছাত্ররা একটি দেশের ভবিষ্যৎ। তাদের সম্মিলিত আন্দোলনকে অবমূল্যায়ন করা সমীচীন নয়। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা অনভিপ্রেত। কমিশন এ হামলার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে। এতে সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার ও আন্দোলনকারীদের দ্রুত আলোচনায় বসার আহ্বান জানাচ্ছি।’ তিনি এ ঘটনায় শান্তিপূর্ণ সমাধান হওয়া বাঞ্ছনীয় উল্লেখ করেন। পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসভবনে হামলার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বানও জানান।যুগান্তর।

Please follow and like us:

Check Also

বাংলাদেশি জাহাজ ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত ৮ জলদস্যু গ্রেফতার

বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ অপহরণে যুক্ত ৮ জলদস্যুকে আটক করেছে সোমালিয়ার পুলিশ। রোববার জাহাজটিকে মুক্তি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।