অবশেষে ব্যাংকঋণের সুদহার এক অঙ্কে

ক্রাইমবার্তা রিপোটঃসরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংকেরই ঋণের সুদের হার অবশেষে এক অঙ্কে নামিয়ে আনা হলো। বেসরকারি ব্যাংকগুলো ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দেবে।

সরকারি ব্যাংকগুলোও এক অঙ্কে সুদ নেবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। আগামী ১ জুলাই থেকে এই হার কার্যকর হবে। গতকাল বুধবার আলাদা বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত  নেওয়া হয়।

বেসরকারি ব্যাংক পরিচালকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) নেতারা গতকাল এক জরুরি সভায় ১ জুলাই থেকে ব্যাংকঋণের ক্ষেত্রে ৯ শতাংশের বেশি সুদ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। একই সঙ্গে তিন মাস মেয়াদি আমানতের ওপর ৬ শতাংশের বেশি সুদ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁরা।

পাশাপাশি সরকারি ব্যাংকগুলোও ১ জুলাই থেকে ঋণের সুদের হার কমানোর বিষয়ে গতকাল অর্থ মন্ত্রণালয়ে বৈঠক করেছে। বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী জানান, সরকারি ব্যাংকগুলোকে ঋণের সুদের হার ১০ শতাংশের কাছাকাছি রাখতে বলা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর প্রতিনিধিদের ডেকেছিলাম। তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করেছি।

তাঁরা আমানত সুদের হার বাড়াবেন না। আমরা চাই প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী ঋণের সুদের হার নামিয়ে আনতে। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন যে ঋণের সুদের হার বেশি হলে বিনিয়োগ হয় না। ’ সরকারি আমানতের ওপর বেশি সুদ না দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংকে আমানত রেখে মুনাফা করতে পারবে না। এই অর্থ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেওয়া হয় তাদের ব্যয় নির্বাহ করার জন্য। মুনাফা করার জন্য নয়। ’

বিএবির সভায় সংগঠনটির প্রেসিডেন্ট ও এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম মজুমদার সভাপতিত্ব করেন। সভায় বেশির ভাগ ব্যাংকের পরিচালকরা উপস্থিত ছিলেন। সভায় মো. নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার আলোকে আমরা ব্যাংকের সুদের হার সিঙ্গল ডিজিটে নামিয়ে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছি। এরই মধ্যে কয়েকটি ব্যাংক আগামী জুলাই থেকে ঋণের সুদের হার সিঙ্গল ডিজিটে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই ব্যাংকগুলো যদি পারে আমরা কেন পারব না?’ ব্যাংক পরিচালকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আজকে এই সভায় আপনারা সিদ্ধান্ত নেন যে আপনারা আমানতের ক্ষেত্রে ৬ শতাংশের বেশি সুদ দেবেন না। একই সঙ্গে ঋণের ক্ষেত্রে ৯ শতাংশের বেশি সুদ নেবেন না। ’ উপস্থিত ব্যাংক পরিচালকরা এ প্রস্তাবে সমর্থন জানান। এ সময় মো. নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, ‘সিঙ্গল ডিজিট বলতে বোঝায় ৯ শতাংশ। তাই কেউ ৯.৯৯ শতাংশ সুদও আরোপ করতে পারবেন না। ৯ শতাংশের মধ্যেই থাকতে হবে। ’

ঋণের সুদের হার কমানোর যৌক্তিকতা তুলে ধরে বিএবি সভাপতি বলেন, ‘১৩-১৪ শতাংশ যদি সুদের হার হয় তবে কত শতাংশ মুনাফা করলে একজন ব্যবসায়ী ঋণ শোধ করতে পারবে? দেশে এমন কোনো ব্যবসা নাই যেখানে ১৪-১৫ শতাংশ মুনাফা হবে। ’ নিজের গার্মেন্ট ব্যবসার উদাহরণ দিয়ে নাসা গ্রুপের কর্ণধার নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, ‘আমি মাসে কয়েক শ কোটি টাকার গার্মেন্ট রপ্তানি করি। সব খরচ দিয়ে ২ শতাংশও মুনাফা করতে পারি না। তাহলে ঋণের সুদ পরিশোধ করব কিভাবে? ঋণের আসল টাকাই বা পরিশোধ করব কিভাবে? তাই বলছি, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থে আমাদের ঋণের সুদের হার কমিয়ে আনতে হবে। এটা এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ’ তিনি আরো বলেন, ‘চড়া সুদে ঋণ নিয়ে কেউ পরিশোধ করতে পারবে না। আপনারা মামলা-মোকদ্দমা করে টাকা আদায় করতে পারবেন না। পরে আপনাদের ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে যাবে। ওই ঋণগুলো আবার অবলোপন করতে হবে। অবলোপন না করলে ব্যাংকই বিপদে পড়ে যাবে। ’

ঋণের সুদের হার কমানোর জন্য আমানতের সুদের হার কমানোর প্রস্তাব করেন বিএবির প্রেসিডেন্ট। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে মূল্যস্ফীতি ৫.৮ শতাংশ। আমানতের সুদের হার মূল্যস্ফীতির কম হওয়া উচিত নয়। এ কারণে আমরা আগামী ১ জুলাই থেকে আমানতে ৬ শতাংশ সুদ নির্দিষ্ট করে দেব। এটা তিন মাস মেয়াদি আমানতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। বেশি মেয়াদের আমানতের ক্ষেত্রেও ক্রমান্বয়ে সুদের হার কমিয়ে আনতে হবে বলে তিনি জানান। বর্তমানে আমানতে ৯ থেকে ১১ শতাংশ পাওয়া যাচ্ছে। ’

সভায় ব্যাংকের আমানতের সুদের হার কমানো হলেও অন্যান্য লিজিং কম্পানি বেশি সুদ অফার করছে উল্লেখ করে এর থেকে সুরক্ষার কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, এমন প্রশ্ন তোলেন বিএবির অন্যান্য নেতা। এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিজাম চৌধুরী বলেন, ‘আমরা এই প্রস্তাবে একমত। কিন্তু কোনো ব্যাংক যদি অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামে তাহলে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে? সেটা পরিষ্কার করতে হবে। ’ ইউনিয়ন ব্যাংকের পরিচালক জিয়াউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আপনারা ব্যাংকের পরিচালকরা সবাই-ই ব্যবসায়ী। ঋণের সুদের হার কম না থাকলে কিভাবে আপনারা বিনিয়োগ করবেন? বিনিয়োগ না হলে দেশে কর্মসংস্থান হবে না। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে না। আমি মনে করি, বিএবি যে প্রস্তাব করেছে তা সঠিক আছে। আমি এর সঙ্গে একমত পোষণ করি। ’ সাউথইস্ট ব্যাংকের পরিচালক আজিম উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা যারা ব্যবসা করি এবং ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত তারা সত্যিকার অর্থে শাঁখের করাতে পড়ে গেছি। ব্যাংক রক্ষা করব, না আমাদের ব্যবসা রক্ষা করব?…আমরা সবাই উপলব্ধি করি, সুদের হার কমাতে হবে। কিন্তু ঋণের সুদ কমাতে গেলে আমানতের সুদও কমাতে হবে। এখানে আমানত ও ঋণের সুদের হারের ব্যবধান (স্প্রেড) বিবেচনায় নিয়ে এ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ’ ব্যাংক এশিয়ার চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ চৌধুরী বলেন, ‘বাইরের দেশগুলোতেও ঋণের সুদের হার অনেক কম। আমাদের বড় সমস্যা হয়ে গেছে খেলাপি ঋণ। এমন অনেক ব্যবসায়ী আছে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে সব পণ্য ছাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এটা কিভাবে বন্ধ করা যায়, সরকারের সাহায্য নিয়ে সেই চেষ্টা করতে হবে। ’

বিএবির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই হার কত দিন বহাল থাকবে সে প্রশ্নের জবাবে বিএবির প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘আমরা শুরু করি। পরে সময় গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ’ তিনি বলেন, সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব ব্যাংক এমডিদের। তাঁরা যদি এটা ঠিক মতো বাস্তবায়ন না করেন তবে তাঁদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

জানা গেছে, ইসলামী ব্যাংক, এসআইবিএল, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক আগামী জুলাই থেকে বিনিয়োগে মুনাফার হার সিঙ্গল ডিজিটে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে তড়িঘড়ি করে জরুরি সভা ডেকে ঋণের সুদের হার সিঙ্গল ডিজিটে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয় বিএবি। গতকাল গুলশানের জব্বার টাওয়ারে বিএবির কার্যালয়ে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।

নির্বাচনের বছরে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে ঋণের সুদের হার সিঙ্গল ডিজিটে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই। গত ১৪ মার্চ আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী এ সিদ্ধান্ত জানানোর পর থেকেই ঋণের সুদের হার সিঙ্গল ডিজিটে আনতে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন অর্থমন্ত্রী। সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হলে ঋণের সুদের হার কমিয়ে আনা হবে বলে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন বিএবির নেতারা; এ লক্ষ্যে ব্যাংকগুলোকে নানা সুযোগ-সুবিধা অর্থমন্ত্রী দিয়েছেনও।

গত ১ এপ্রিল সোনারগাঁও হোটেলে অর্থমন্ত্রী, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও বিএবির এক ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে ব্যাংকের তারল্য সংকট মোকাবেলায় ব্যাংকের নগদ জমার বাধ্যবাধকতা (সিআরআর) ১ শতাংশ কমিয়ে ৫.৫ শতাংশ করিয়ে নেন বিএবির নেতারা। এর দুই দিন আগে বিএবির সভায় অর্থমন্ত্রী বেসরকারি ব্যাংকের তহবিল বাড়াতে সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে জমা রাখার বিধান করার বিষয়ে সম্মত হন। সম্প্রতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবনায় ব্যাংকের করপোরেট কর ২.৫ শতাংশ করে কমিয়ে আনার প্রস্তাবও করেন অর্থমন্ত্রী। এর সব কিছুরই উদ্দেশ্য ছিল ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমানো। গত এপ্রিলে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেনও পরবর্তী দু-এক মাসের মধ্যেই ঋণের সুদের হার সিঙ্গল ডিজিটে নেমে আসবে। কিন্তু দাবি অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হলেও ঋণের সুদের হার কমিয়ে আনতে গড়িমসি করছিল ব্যাংকগুলো। এ নিয়ে কালের কণ্ঠে একাধিক প্রতিবেদনও ছাপা হয় গত মে মাসের শেষ দিকে। অবশেষে জুলাই থেকে ঋণের সুদের হার সিঙ্গল ডিজিটে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিল বিএবি।

এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন ব্যাংক খাত বিশ্লেষকরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমানতের সুদের হার ৬ শতাংশে নিয়ে আসার প্রস্তাব করা হয়েছে ঋণের সুদ কমানোর জন্য। কেননা ৬ শতাংশে তহবিল সংগ্রহ না করতে পারলে তো ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়া যাবে না। এখানে তো সরকার কোনো ভর্তুকি দেবে না। এটা করতে হবে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যয় কমিয়ে। আমি এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু দেখতে হবে ব্যাংকগুলো যেটা বলছে সেটা শুধু কাগজে-কলমেই থাকে কি না। ব্যাংকগুলো সত্যিকার অর্থে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দিচ্ছে কি না এটা বাংলাদেশ ব্যাংককে তদারকি করতে হবে। ঋণের সুদের হার কমালেও অন্যান্য সার্ভিস চার্জ বাড়িয়ে দিচ্ছে কি না সেটাও দেখতে হবে। ’.kalerkantho.com

Please follow and like us:

Check Also

পৃথিবীর যেসব দেশে তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রিরও উপরে

জলবায়ু পরিবর্তনের চরম ভয়াবহতার সাক্ষী হতে যাচ্ছে সারাবিশ্ব। প্রতিদিনই একটু একটু করে বৈরি হচ্ছে আবহাওয়া, …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।