মেয়ের পিতৃত্বের অধিকার পেতে সাতক্ষীরায় স্বামী ছাত্রলীগ নেতার চাঁদাবাজির শিকার স্ত্রী

নিজস্ব প্রতিনিধি: মেয়ের পিতৃত্বের অধিকার আদায় করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত তিন মাসের শিশু সন্তানসহ চাঁদাবাজির মামলায় গ্রেপ্তার হলেন মা মাছুরা খাতুন। গত দুই মাস যাবত স্বামী নাসিরের বাড়িতে ধরনা দিয়েও শেষ রক্ষা হলো না তার। নাসির ও তার পরিবারের সদস্যরা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। পরে আদালতে মাছুরার বিরুদ্ধে একটি চাঁদাবাজি ও মারামারির মামলা করেন নাসির। এই মামলার সূত্র ধরে শুক্রবার কালিগঞ্জ থানা পুলিশ মাছুরাকে তার শিশু কন্যাসহ নাসিরের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে।
কালিগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) জাহাঙ্গির হোসেন জানান, মাছুরার বিরুদ্ধে আদালতে চাঁদাবাজির মামলা হয়েছে। এই মামলার সূত্র ধরে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মাছুরা খাতুন শ্যামনগর উপজেলার চন্ডিপুর গ্রামের মাটি শ্রমিক আবুবকর সিদ্দিকের মেয়ে। অপরদিকে মো. নাসিরউদ্দিন কালিগঞ্জের দুদলি গ্রামের মো. বাসারতুল্লার ছেলে এবং কালিগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের বহিস্কৃত সাধারণ সম্পাদক। সে একজন ইয়াবা সেবী।
গ্রেপ্তারের মুহূর্তে মাছুরা কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, তিনি নাসিরের বিবাহিত স্ত্রী। বিয়ের পর প্রথম দফায় অন্ত:সত্ত্বা হলে জোর করে তার গর্ভপাত করানো হয়। দ্বিতীয় দফায় মাছুরা ফের অন্ত:সত্ত্বা হলে নাসির তাকে সাতক্ষীরার ভাড়া বাসায় রেখে পালিয়ে যায়। এরপর থেকে মাছুরা সংকটে পড়েন। নিরুপায় হয়ে তিনি বাপের বাড়ি চলে যান। তিন মাস আগে তিনি এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। সাংবাদিকদের তিনি জানান, নাসিরের কোনো খোঁজ না পেয়ে তিনি দুদলি গ্রামে তার বাড়িতে ওঠেন। এ সময় নাসিরের মা তাকে মারধর করে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় নাসির, তার ভাই শাহিন ও তাদের মা ঘরে তালা ঝুলিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। মাছুরা তার শিশুকে নিয়ে বাড়ির রান্নাঘরে আশ্রয় নেন। তিনি বলেন, সেখান থেকে নামানোর জন্য নাসিরের পরিবার নানা ষড়যন্ত্র করতে থাকে। এক সপ্তাহ আগে এক রাতে ওই বাড়িতে কয়েক ব্যক্তি হানা দিয়ে মাছুরাকে হত্যার চেষ্টা করে। খবর পেয়ে গ্রামবাসির তাড়া খেয়ে তারা পালিয়ে যায়। এ সময় তারা একটি সাইকেল ও একটি মোবাইল ফোন ফেলে যায়। মাছুরা জানান, তিনি বিষয়টি নিয়ে থানা পুলিশ করার চেষ্টা করেন নি। তবে দুদলি গ্রামের লোকজন এ ঘটনা সম্পর্কে অবহিত। তিনি বলেন, মেয়েটির পিতৃত্বের অধিকার আদায় করতে স্বামীর বাড়িতে ধর্ণা দিয়েছিলাম। অথচ এক মিথ্যা চাঁদাবাজির মামলায় আমাকে গ্রেপ্তার করা হলো। তিনি বলেন, এরপরও নাসিরের সাথে ঘর করতে চাই। তিনি বলেন, সাতক্ষীরা শহরের কাটিয়া পুলিশ ফাঁড়ির ইন্সপেক্টর বাহারুল ইসলামের সহযোগিতায় নাসিরের সাথে শরিয়ত মোতাবেক তার বিয়ে হয়। এখন নানা উছিলায় নাসির এই বিয়ে অস্বীকার করছে। এমনকি পিতৃত্বের দাবিও স্বীকার করছে না। তিনি এর প্রতিকার দাবি করেন।
পেছনের কথা: গত জানুয়ারি মাসে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে এসে মাছুরা সাংবাদিকদের বলেন, দুই পক্ষের অভিভাবকের অমতেই নাসিরের সাথে বিয়ে হয় তার। এরপর নাসির তাকে সাতক্ষীরায় এনে সাতক্ষীরার একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। নাসিরের সাথে কয়েকজন পুলিশ সদস্যের সুসম্পর্ক ছিল। সে নিজেই একজন ইয়াবাসেবী। ইয়াবা ও ফেন্সিডিল কেনাবেচাও করে। প্রায়ই রাতে তাদের বাসায় আসতো ফিরোজ ও আমিনুর নামের পুলিশের দুই সদস্য। সাথে থাকতো ইটাগাছার সাইফুল নামের আরও এক যুবক। তারা এক সাথে আমার ঘরে বসে ইয়াবা খেতো। পুলিশের সাথে চুক্তি করে সাধারণ মানুষকে ধরিয়ে আনতো। আমি আপত্তি জানাতাম। প্রতিবাদ করায় আমাকে মারধর করতো নাসির। জানাজানি করলে বলতো ‘তোর বাবার নামে মামলা দিয়ে জেল খাটাবো’। মাছুরা তার দেহের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন দেখান। মাছুরা জানান, তার পেটের প্রথম সন্তান সাড়ে চারমাস পর গর্ভপাতের মাধ্যমে নষ্ট করায় নাসির। দ্বিতীয় সন্তান পেটে আসার পর থেকে নাসির আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এরই মধ্যে সে অপর একটি মেয়ের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে। তাকে ঘরে নিয়ে আসতো। বোন পরিচয়ে ঘরে রাখতো। তার সাথে বসে ইয়াবা খেতো। আর আমি প্রতিবাদ করলে আমাকে মারপিট করতো। মাছুরা জানান পেটের সন্তান নষ্ট করে দেওয়ার জন্য আমাকে চলা কাঠ দিয়ে কোমরে আঘাত করেছে নাসির। তিনি জানান, তার গলায় ওড়না পেচিয়ে তাকে খুন করারও চেষ্টা করেছিল নাসির। কিন্তু প্রতিবেশিরা এসে তাকে রক্ষা করেন। মাছুরা জানান, এ ভাবে আরও চার নারীর সর্বনাশ করেছে নাসির। তাদের নাম জানান মাছুরা (প্রকাশ করা হলো না)। নতুন করে যে মেয়েটির সর্বনাশ করতে যাচ্ছে নাসির তারও নাম জানান তিনি।
মাছুরা জানান, আমাদের প্রথম বিয়ের স্ট্যাম্পে স্বাক্ষরযুক্ত কাগজপত্র চাইতাম আমি। কিন্তু নাসির দিতে চাইতো না। তিনি বলেন, সাতক্ষীরা শহরের কাটিয়ায় বাসা পাল্টালে বাড়িওয়ালা আমাদের দুইজনকে পুলিশে সোপর্দ করেন। সাতক্ষীরার কাটিয়া পুলিশ ফাঁড়ির পুলিশ পরিদর্শক মো. বাহারুল ইসলামের সহায়তায় ২০১৭ সালের ১ নভেম্বর শরীয়ত মোতাবেক মাছুরার সাথে নাসিরের বিয়ে পড়ান ম্যারেজ রেজিস্ট্রার মওলানা আবদুর রাজ্জাক। বিয়ের সেই নিকাহনামা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন মাছুরা। তিনি জানান, এখন তাকে রাস্তাঘাটে মারধর করার পরিকল্পনা করেছে নাসির। এরইমধ্যে তিন যুবককে পাঠিয়েছিল তার কাছে। কিন্তু মাছুরা পালিয়ে থেকে রক্ষা পান।
মাছুরা জানান, এতো সবের পরও আমি তার ঘর ছাড়তে চাইনা। আমি আইনগত সহায়তা চাই। আমি আমার মেয়ের পিতৃত্বের অধিকার চাই। এসব বিষয়ে জানতে মো. নাসিরউদ্দিনের সাথে যোগাযোগ করা হলে ২০১৮ এর ২১ জানুয়ারি তিনি বলেন, ‘আমার সাথে মাছুরার বিয়ের একটা ঝামেলা আছে সত্য। তবে সে বিষয়ে পরে বলবো। এক সপ্তাহ পর বাড়ি এসে বলবো। এখন ঢাকায় আছি’। সাংবাদিকদের তিনি আরও বলেন, ‘আমি মাছুরাকে তো পরিত্যাগ করিনি’।

Please follow and like us:

Check Also

ইমাম ও মুয়াজ্জিন কল্যাণ ট্রাস্টের আওতায় সুদমুক্ত ঋণ বিতরণ

রাকিবুল ইসলাম, আলিপুর,২৩শে এপ্রিল ২০২৪:সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসন ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন সাতক্ষীরার আয়োজনে ইমাম ও মুয়াজ্জিন …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।