ছাত্রলীগ-যুবলীগের সশস্ত্র হামলায় রক্তাক্ত মাহমুদুর রহমান

* সর্বত্র নিন্দার ঝড়
স্টাফ রিপোর্টার ও কুষ্টিয়া সংবাদদাতা : কুষ্টিয়ায় একটি মানহানি মামলায় জামিন নিতে গিয়ে ছাত্রলীগ যুবলীগ ক্যাডারদের সশস্ত্র হামলার শিকার হয়েছেন আমার  দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, জনপ্রিয় কলামিস্ট ও সাবেক জ্বালানী উপদেষ্টা প্রকৌশলী মাহমুদুর রহমান। হামলায় তার মাথা ও মুখ প্রচন্ডভাবে জখম হয়েছে। গতকাল রোববার বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিটে আদালতের বারান্দা থেকে বের হয়ে প্রাইভেট কারে ওঠার পর তিনি এ হামলার শিকার হন। এ সময় সেখানে কুষ্টিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাসির উদ্দীন, আদালতের পরিদর্শক মনির উজজামানসহ বিপুলসংখ্যক পুলিশ নীরবে দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের উপস্থিতি ও সহায়তায় সরকারদলীয় সন্ত্রাসীরা মাহমুদুর রহমানের উপর নির্মমভাবে হামলা চালায় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়। হামলায় বিএফইউজে মহাসচিব এম আব্দুল্লাহসহ প্রায় ৫ জন আহত হয়েছেন। এছাড়াও মাহমুদুর রহমানের গাড়ীসহ দুটি গাড়ী ভাংচুর করা হয়েছে। আহত মাহমুদুর রহমানকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। তিনি ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে জানা গেছে। মাহমুদুর রহমানের উপর হামলার ঘটনায় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ছাত্রশিবির বিএফইউজে, ডিইউজে, ড্যাব, সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। প্রতিবাদে আজ জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএফইউজে ও ডিইউজে। 
এর আগে বেলা সাড়ে ১১টায় বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা ও টিউলিপ সিদ্দিককে নিয়ে কটূক্তি করে বক্তব্যে দেওয়ায় আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ইয়াসির আরাফাত ওরফে তুষারের দায়ের করা মানহানি মামলায় জামিন মঞ্জুর করেন আদালত। বেলা সাড়ে ১১টায় কুষ্টিয়া জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতের বিচারক এম এম মোর্শেদ ১০ হাজার টাকা জামানতে স্থায়ীভাবে এই জামিন মঞ্জুর করেন। ২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে মামলা করেন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ইয়াসির আরাফাত। ওই মামলায় ওয়ারেন্ট জারি করেন আদালত। গতকাল রোববার সকাল সাড়ে ১০টার আদালতে জামিন নিতে যান মাহমুদুর রহমান। আদালতে দাঁড়িয়ে জামিন চাইলে বিচারক জামিন মঞ্জুর করেন।
এদিকে মাহমুদুর রহমান জামিন নিতে আসছেন এমন খবর পেয়ে আগে থেকে আদালত চত্বরে ছাত্রলীগ সভাপতি ইয়াসির আরাফাত ও সাধারণ সম্পাদক সাদ আহমেদের নেতৃত্বে অর্ধশতাধিক ছাত্রলীগ ক্যাডার লাঠিসোঁটা নিয়ে আদালত চত্বরে অবস্থান নেন। এ ছাড়া সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতারাও কালো পতাকা মিছিল করেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে জামিন হলেও হামলার ভয়ে আদালতের এজলাসে অবস্থান নেন মাহমুদুর রহমান। এ সময় বিপুলসংখ্যক পুলিশ সেখানে অবস্থান নেন। জামিন মঞ্জুর হওয়ার পর, কোর্ট ইন্সপেক্টর তাকে সাদা গাড়ি দিয়ে পৌঁছে দেয়ার প্রস্তাব করেন। মাহমুদুর রহমান নিজের গাড়ি আছে উল্লেখ করে প্রস্তাব প্রত্যাক্ষান করলেও নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে সাদা গাড়িতেই উঠতে বাধ্য করা হয়। পরে পুলিশ মাহমুদুর রহমানকে বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিটে একটি সাদা রঙের প্রাইভেট কারে উঠে রওনা হন। গাড়িতে ওঠার পরপরই আচমকা তার ওপর প্রথমে স্যান্ডেল ছুড়ে মারেন ছাত্রলীগের এক কর্মী। এরপর চারদিক থেকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু হয়ে যায়। এ সময় গাড়ির কাচ ভেঙে কয়েকটি ইট তার মাথায় ও মুখে লাগে। এতে তার গাল, কপাল ও মাথার পেছনে কেটে যায়। হামলার মধ্য থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে গাড়ি থেকে বের করে আইনজীবীরা একটি চেম্বারে নিয়ে যান। এ সময় বিভিন্ন শ্লোগান দিয়ে ওই আইনজীবীর চেম্বারে হামলা চালানো হয়। হামলাকারীদের বেশ কয়েকজনের মুখ গামছা দিয়ে বাঁধা ছিল।
পরে রক্তাক্ত অবস্থায় আদালতের বারান্দায় বসে মাহমুদুর হামলার প্রতিবাদ করেন। তিনি বলেন, এখানে প্রয়োজনে জীবন দেব। দেশের জন্য, ইসলামের জন্য জীবন দেব। আদালতের ভেতর হামলার জন্য পুলিশকে দোষারোপ করে তিনি বলেন, নিরাপত্তা দেওয়ার কথা বলে পুলিশ আমাকে গুন্ডাদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। পরিকল্পিতভাবে আমার ওপর হামলা হয়েছে। এর জন্য একদিন তাদেরও আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। এ সময় সদর থানার ওসি নাসির উদ্দিন তাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলে তাকে বলেন, হামলার সময় কোথায় ছিলেন। আপনারা তো আমাকে মার খাওয়ালেন। হাসপাতালেও নিয়ে যাচ্ছেন না। আমার সারা মুখ থেকে রক্ত ঝরছে, আমি যন্ত্রণায় দাঁড়াতে পারছি না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি নাসির উদ্দিন বলেন, কিছু বুঝে ওঠার আগেই আচমকা মাহমুদুর রহমানের ওপর হামলা হয়েছে। তবে পুলিশ না থাকলে আরও বড় ধরনের বিপদ হতে পারত। হামলার বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ইয়াসির আরাফাত ওরফে তুষার গণমাধ্যমকে বলেন, আমি যেহেতু মামলার বাদী। তাই শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করেছি। কিন্তু কে বা কারা হামলা করেছে সেটা জানা নেই।
মাহমুদুর রহমানের সাথে ছিলেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব এম আবদুল্লাহ। তিনি বলেছেন, জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে ছাত্রলীগ কর্মীরা মাহমুদুর রহমানের উপর হামলা চালিয়েছে। তিনি জানান, ৫০০ ধারার একটি মানহানি মামলায় জামিন নিতে মাহমুদুর রহমান কুষ্টিয়া আদালতে আসেন। শুনানি শেষে আদালত জামিন মঞ্জুর করেছেন। এই মামলার বাদী হলেন কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি তুষার। শুনানি শুরু হওয়ার আগ থেকেই ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা লাঠিসোটা নিয়ে আদালত ভবন ঘেরাও করে আছে। এ সময় মাহমুদুর রহমান কয়েকবার আদালত ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।
জানাগেছে পুলিশের সেল্টারে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা লাঠিসোটা নিয়ে আদালত প্রাঙ্গণ ঘেরাও করে রাখে। এ ব্যাপারে বার বার কুষ্টিয়ার এসপি সহ পুলিশ কর্মকর্তাদের সহযোগিতা চেয়েও ব্যর্থ হন সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ। আব্দুল্লাহ বলেন, আমরা এ পরিস্থিতি ম্যাজিস্ট্রেটকে জানালে, তিনি আমাদেরকে তার কক্ষে বসতে দিয়েছেন। আমরা দীর্ঘক্ষণ ম্যাজিস্ট্রেটের কক্ষে বসে ছিলাম। বেলা পৌনে ৫টার দিকে আদালত কক্ষ ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ছাত্রলীগ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। এতে রক্তাক্তভাবে আহত হন সাংবাদিক মাহমুদুর রহমান।
সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ কুষ্টিয়ার সদস্য সচিব এ্যাড, শামীম উল হাসান অপু জানান, মানহানির একটি মামলায় জামিন নিতে রোববার কুষ্টিয়া সদর জুডিশিয়াল ম্যাজেস্ট্রেট আদালতে আত্মসমর্পণ করেন মাহমুদুর রহমান। উভয় পক্ষের শুনানির পর বিচারক এম এম মোর্শেদে জামিন আদেশ দেন। দুপুর ১টার দিকে তিনি সঙ্গীদের সাথে আদালত থেকে বের হওয়ার মুহূর্তে আদালত ভবনের প্রতিটি প্রবেশ দ্বারে ছাত্রীলীগের নেতাকর্মীরা আটকে দেয়। এসময় তিনি পুনরায় আদালতের এজলাসে আশ্রয় নেন। বিকালে আদালত থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তার উপর হামলা ঘটনা ঘটেছে।
ছাত্রলীগের হামলার আগে অবরুদ্ধ অবস্থায় কুষ্টিয়া আদালত ভবনে এক ফেসবুক লাইভে আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেন, পুরো আদালত পাড়া জুড়ে ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা মহড়া দিচ্ছে। তাদের দাবি কি সেটাও বুঝা যাচ্ছে না। একটাই বুঝছি তারা আমাকে এখান থেকে বের হতে দিতে রাজিনা। মাহমুদুর রহমান বলেন, আমি এই অভিজ্ঞতায় আশ্চর্য হইনি। বাংলাদেশে গণমানুষের কোনো অধিকার নেই, সংবাদপত্রের কোনো স্বাধীনতা নেই। সেটার সর্বোৎকৃষ্ট প্রমাণ আমরা আজ কুষ্টিয়াতে পেলাম।
তিনি বলেন, এরকম দৃশ্য মনে হয় কুষ্টিয়াতে আজ পর্যন্ত কেউ দেখেনি। কারণ এখানে আমাদের যে আইনজীবী আছেন তারা প্রত্যেকেই বললেন, এটা তাদের জন্য একটা নতুন অভিজ্ঞতা। আমি এখানে এসেছিলাম একটা মানহানি মামলায় হাজিরা দিতে। আপনারা জানেন যে, মানহানি মামলায় ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে জামিন দিতে হয়। এটাই আইন। এই আইন ভেঙে আমার জামিন বাতিল করার কোনো সুযোগ নেই। তাই ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আমাকে জামিন দিয়েছেন। কিন্তু জামিন দেয়ার পর থেকে তারা আমাকে বের হতে দিচ্ছেনা। এর পেছনের সকল ইন্ধন হচ্ছে এখানকার ওসি এবং এসপির। তাদের ইন্ধনে এই কাজ হচ্ছে। কারণ ওসি-এসপি তারা দেখেও না দেখার ভান করছে।
এমনকি আমাদের সামনে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব ওসিকে ডাকলেন। ওসি সামান্য সৌজন্য দেখিয়েও আসেনননি। বরং তিনি বলে দিলেন, আসতে পারবেন না। বাংলাদেশ আজ কোন রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। আপনারা বুঝতে পারছেন এই দেশের জনগণ যদি লড়াই করে সরকারকে প্রতিহত না করে, তাহলে মানুষের মুক্তি আসবেনা। আপনার জানেন আমি পাঁচ বছর জেলে ছিলাম। আমার নামে ১২৫টি মামলা। আমি ৩৮দিন পুলিশের রিমান্ডে ছিলাম। সেই রিমান্ডে আমাকে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে। আল্লাহ আমার হায়াত এখনও রেখেছেন তাই আমি বেঁচে আছি। ততদিন ন্যায়ের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে আমি লড়াই করে যাব। আপনার দোয়া করবেন আমাদের জন্য যাতে আমরা আজকে বের হতে পারি। যদি জীবিত এখান থেকে রেব হতে না পারি তবে দোয়া করবেন মাগফেরাতের জন্য। আপনাদেরকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

Check Also

স্বাধীনতার ৫৩ বছরে আজ প্রশ্ন উঠছে গণতন্ত্র কোথায়: মঈন খান

ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য বিরোধী দলের রুদ্ধে এক লাখ মামলা দেওয়া হয়েছে ও তাদের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।