থানা ঘেরাও, চাপে মুক্ত ৮৮ শিক্ষার্থী রিমান্ডে ২২ জন * ঢাবি, রাবিতে বিক্ষোভ * নতুন তিনটিসহ ২৬ মামলা

ক্রাইমবার্তা রিপোট:আন্দোলনের সময় আটককৃতদের মুক্তির দাবিতে থানা ঘেরাও করে শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবার তারা শাহবাগ থানার সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করে। এরপর শাহবাগ এবং তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা থেকে মোট ৮৮ শিক্ষার্থীকে মুচলেকা নিয়ে অভিভাবকদের কাছে দেয়া হয়। এদের মধ্যে ৩৭ জনকে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা পুলিশ এবং ৫১ জনকে শাহবাগ থানা থেকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।

এদিকে ছাত্রছাত্রীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে মঙ্গলবারও ঢাকা এবং রাজশাহীসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল ও মানববন্ধন হয়েছে। সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। সংঘর্ষের আশঙ্কায় মঙ্গলবার চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

এর আগে সোমবার নীলফামারীর আর্মি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বাউস্ট) ছুটি ঘোষণা করা হয়। এছাড়া ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় একদিন এবং ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় দু’দিনের জন্য বন্ধ। এ দিন রাজধানীসহ দেশের কোথাও সহিংসতার খবর পাওয়া যায়নি। ঢাকায় শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফিরে গেছে। যানবাহন চলাচল প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। ২৯ জুলাই বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। সেই ঢেউ লেগেছিল দেশের অন্য শহরেও। মঙ্গলবার সেই অশান্ত পরিস্থিতি প্রায় নিয়ন্ত্রণে আসে।

জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের ছাত্র তারিকুল ইসলাম, ওমর ফারুক এবং জবাইদুল হক রনিকে রাতভর নির্যাতনের পর শাহবাগ থানায় সোপর্দ করার প্রতিবাদে থানা ঘেরাও করে রাখে তার সহপাঠীরা। আন্দোলনের সময় ৪৮ জনকে আটক করা হয়। সব মিলে সংখ্যা দাঁড়ায় ৫১। এদের মুক্তির দাবিতে মঙ্গলবার বেলা আড়াইটা থেকে সাড়ে ৩টা পর্যন্ত থানা ঘেরাও করে বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা।

এ সময় থানা এলাকায় উত্তেজনা দেখা দেয়। পরে থানা পুলিশ আটক এই তিন ছাত্রসহ মোট ৫১ জনকে ছেড়ে দিলে পরিস্থিতি শান্ত হয়। আটক ছাত্রদের ছেড়ে দিলে সহপাঠীরা তাদের গলায় ফুলের মালা দিয়ে মিছিল করতে করতে চলে যায়। একইভাবে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা থেকে আন্দোলনের সময় আটক ৩৭ জনকে ছেড়ে দেয় পুলিশ।

রোববার বিক্ষোভকালে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী আটক হয়েছিল শাহবাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে। ওইদিন ৪৮ জনকে আটক করা হয়েছিল। মোট ৫১ জনের কাছ থেকে মুচলেকা রেখে কাউকে অভিভাবক আবার কাউকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টরের মাধ্যমে ছেড়ে দেয়া হয়েছে বলে জানান ওই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহাবুবুর রহমান।

তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় ৩৭ ছাত্রকে আটক করে রাখা হয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা দেয়া হয়নি। মঙ্গলবার সকালে অভিভাবকদের জিম্মায় তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে। পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

জানা গেছে, বিক্ষুব্ধ স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা সোমবারই ক্লাসে ফিরেছে। মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও ক্যাম্পাসে ফিরে যায়। সন্তানরা ক্লাসে ফিরলেও অভিভাবকদের মধ্যে ছিল আতঙ্ক। এ দিন রাজধানীতে যানবাহন চলাচল করেছে। তবে আগের দিনের মতো বাস কম ছিল সড়কে। এ কারণে নগরবাসীকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ ছিল বেশি। ব্যাগসহ তরুণদের সন্দেহ হলেই রাজধানীর মোড়ে মোড়ে অবস্থান নেয়া পুলিশ তল্লাশি করেছে।

রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের বাসে তুলতে অস্বীকৃতি জানাতে দেখা গেছে। বিক্ষোভের দিনগুলোয় রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে হামলা ও মারধরের প্রতিবাদে এ দিনও রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ও কারওয়ান বাজারে সাংবাদিকরা মানববন্ধন করেন।

সোমবার ঢাকার শাহবাগ, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, রামপুরার আফতাবনগরসহ কয়েকটি স্থানে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। পুলিশ ও একদল যুবক ওই হামলায় অংশ নেয়। ঘটনাস্থল ও এর আশপাশ থেকে শিক্ষার্থীদের আটক করা হয়েছিল।

শনিবার ধানমণ্ডি-সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা হয়। ওই ঘটনার প্রতিবাদে রোববার সামনে চলে আসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তারা পরপর দু’দিন ঢাকার বিভিন্ন স্পটে সহিংস প্রতিবাদ জানান। তারাও অবশ্য পুলিশ এবং একদল যুবকের হামলার শিকার হন। ওই সহিংস বিক্ষোভে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এমন পরিস্থিতিতে আজ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের নিয়ে বৈঠকে বসছেন শিক্ষামন্ত্রী।

২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর রোডে শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী বাসচাপায় নিহত হয়। এতে ১৫ জন আহত হয়। এর প্রতিবাদে গড়ে ওঠা আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা নৌমন্ত্রীর পদত্যাগ, নিরাপদ সড়ক এবং নিহত দুই শিক্ষার্থীর ঘাতক বাসচালকের ফাঁসিসহ ৯ দফা দাবি উত্থাপন করে। শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে এরই মধ্যে সরকার অন্তত ১৫টি পদক্ষেপ নিয়েছে। পদক্ষেপের অংশ হিসেবে সর্বশেষ সড়ক দুর্ঘটনার দায়ী চালকের শাস্তি বাড়িয়ে সোমবার মন্ত্রিসভায় এ সংক্রান্ত আইনের খসড়া অনুমোদন দেয়া হয়।

যুগান্তরের প্রতিনিধিরা মঙ্গলবার রাজধানীর বিক্ষোভপ্রবণ স্পটগুলো সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন। তারা প্রত্যেকটি স্পটে স্বাভাবিক পরিস্থিতি দেখেছেন। তবে প্রত্যেক স্পটেই বাড়তি পুলিশ মোতায়েন ছিল। কোথাও পুলিশের সঙ্গে অচেনা যুবকদের অবস্থানও দেখা গেছে। সন্দেহভাজনদের দেখলেই পুলিশ তল্লাশি করেছে। এক্ষেত্রে স্কুলব্যাগ নিয়ে চলাচলকারীরা বেশি তল্লাশির মুখে পড়ে। এমন একটি ঘটনা ঘটে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে।

দনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সামনে তল্লাশিকালে পুলিশ ২ জনকে আটক করে। তাদের মধ্যে মাহমুদুল আমিরের ব্যাগে বই না থাকায় ও আচরণ ভালো নয় বলে তৌহিদুল ইসলাম নামে আরেক শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়। পরে দু’জনের বাবা-মা এসে মুচলেকা দিলে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে। ছাত্রসহ সন্দেহভাজনদের ব্যাগ ও শরীর তল্লাশির ঘটনায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ক্লাসে যেতেও ভয় পাওয়ার কথা জানিয়েছেন তারা।

শিক্ষার্থী মাহমুদুল আমির জানান, কলেজ থেকে বের হয়ে নাশতা খেতে যাচ্ছিলেন। তখন তাকে আটক করা হয়। আর তৌহিদুল জানান, পিকআপে চড়ে কলেজে যাচ্ছিলেন। শনিরআখড়ার পুলিশ গাড়ি থামিয়ে তাকে আটক করে।

নতুন আতঙ্ক ও ভোগান্তি : শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফিরলেও নতুন করে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নয়া ভোগান্তি। ইয়াসিনুর রহমান নামে কেরানীগঞ্জের এক ছাত্র জানান, তিনি এবং তার কলেজ পড়ুয়া ভাই দারুণ ভোগান্তিতে পড়েন। তিনি ধানমণ্ডি এলাকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। কিন্তু বাসে তাকে নিতে চায়নি ড্রাইভার। পরিষ্কার বলা হচ্ছে, স্টুডেন্ট নেব না। তার ভাইও একইভাবে বাসে উঠতে গিয়ে বাধার মুখে পড়েন। এভাবে রাজধানীর আরও কিছু এলাকা থেকে শিক্ষার্থীদের বাসে নেয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

অন্যদিকে বিভিন্ন কলেজ ও স্কুলের সামনে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, তারা আতঙ্কে আছেন। কয়েকজন অভিভাবক জানান, নিরাপদ সড়কের দাবিতে তাদের সন্তানরা অংশ নিয়েছিল। এখন যদি চিহ্নিত করে তাদের সন্তানদের হয়রানি করা হয়, তা নিয়ে টেনশনে আছেন। কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, তারা আতঙ্কে আছেন। কেননা কলেজের সামনে পুলিশ মোতায়েন আছে। যেহেতু আন্দোলনে তারা ছিলেন, এখন চিহ্নিত করে গ্রেফতার বা হয়রানি করা হয় কিনা- সেই ভয়ে আছেন।

২৬ মামলা : এদিকে গত কয়েকদিনের ঘটনায় মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ২৬টি মামলা দায়ের হয়েছে। মামলাগুলোর মধ্যে রোববার পর্যন্ত পুলিশের ওয়ারী বিভাগে ২টি, মিরপুর ও উত্তরা বিভাগে ৩টি করে, রমনা ও মতিঝিল বিভাগে ৬টি করে আছে।

এছাড়া তেজগাঁও, লালবাগ ও গুলশান বিভাগে একটি করে মামলা হয়েছে। মঙ্গলবার বাড্ডা, ভাটারা এবং শাহবাগ থানায় আরও একটি করে মামলা হয়েছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে শাহবাগ থানার মামলায় আসামি অজ্ঞাত।

Please follow and like us:

Check Also

ঈদে স্ত্রীর জন্য মাংস কিনতে না পারায় দিনমজুর স্বামীর আত্মহত্যা

জামালপুরের বকশীগঞ্জে স্ত্রীর জন্য মাংস কিনতে না পেরে চিঠি লিখে আত্মহত্যা করেছেন হাসান আলী (২৬) …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।