তুরস্ক কোন পথে ?

তুর্কিদের সামনে এখন দুটি পথ। হয় জেত না হয় হারো। চাইলেও জেতার জন্য যুদ্ধ করতে হবে, না চাইলেও। নতুবা হেরে গিয়ে শেষ হয়ে যেতে হবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ও উসমানীয় খলিফাদের ভাগ্য দুলছিল এমন এক সমীকরণের ওপর। শেষ পর্যন্ত হেরে যায় তারা। হেরে গিয়ে উসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রায় সব ভূমি হারায়, খালি কোন রকমে রক্ষা পায় মূলভূমি তথা অধুনা তুরস্ক।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী গত একশ’ বছরে তুরস্ক নানা ধরনের সমস্যা ও সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। দেশটির স্বাভাবিক প্রবাহ বারবার সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের কারণে বাধাগ্রস্থ হয়েছে। যা ২০০৩ সালের পর থেকে দেশটিতে তুমুল জনপ্রিয় ও উচ্চাভিলাষী নেতা এরদোগানের নেতৃত্বে কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করে। দেশটি অর্থনৈতিকভাবেও স্বনির্ভর হয়ে ওঠে এসময়ে।

তুরস্ক আবারও নতুন সংকটের মুখোমুখি। সেদিন তুর্কিরা পশ্চিমা বাহিনীকে সামরিক যুদ্ধে পরাজিত করেছিল। কিন্তু আজ ১০০ বছর পর তুর্কিদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া অর্থনৈতিক যুদ্ধ জয়ের ক্ষমতা কি আছে তাদের? নাকি অর্থনৈতিক নৈরাজ্যের মধ্য দিয়ে তুরস্ক নামক রাষ্ট্রটি আবার ভাগ হবে?

শুধু যুক্তরাষ্ট্র না, মুখে না বললেও যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, নেদারল্যান্ডসহ প্রায় সবগুলো পশ্চিমা দেশই তুরস্ককে একটি সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যারপরনাই খুশি।

তুরস্ক সরকার ও এরদোগান জোর গলায় বলছে তারা এ সংকট মোকাবেলা করতে সক্ষম। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে। অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পর্যদুস্ত সাধারণ তুর্কি জীবন। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে কয়েক বছরের মধ্যে তুরস্কের অর্থনীতি পুরোপুরি ভেঙে পড়বে। আর এটা হলে একটা সামাজিক নৈরাজ্য সৃষ্টি হবে। যা রাজনৈতিক নৈরাজ্যের মধ্য দিয়ে শেষ হতে পারে। যদি এমন কোন রাজনৈতিক নৈরাজ্য শুরু হয় তা কোথায় নিয়ে যাবে তুরস্ককে?

অনেকেই দুই কদম এগিয়ে এসে বলছেন এমনটা হলে তুরস্ক আসলে আরেক দফা ভাঙনের মুখে পড়তে পারে। অধিকাংশ বিশ্লেষক এমন ধারণাকে অমূলক বললেও আশংকা থেকে যায়।

এখন তুরস্ক যার মুখোমুখি, তা হচ্ছে ইন্টেলেকচুয়াল ওয়ার। তাদের পূর্বপুরুষ অটোমান সম্রাটদেরও এ যুদ্ধের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। প্রথম দিকে অটোমানরা জিতলেও পরে সম্মিলিত পশ্চিমা শক্তির কাছে হেরে যায়। আজকের তুরস্ক সেই তুলনায় দুর্বল, ক্ষীণকায়। মাত্র উত্থানশীল একটি রাষ্ট্র। তারা কীভাবে সম্মিলিত পশ্চিমা ইন্টেলেকচুয়াল ওয়ার মোকাবেলা করে টিকে থাকে সেটাই এখন দেখার বিষয়।

দুই. তুরস্কের সমস্যা বহুমুখী। দেশটিতে বেকারত্ব রয়েছে। তুর্কি-কুর্দি সংঘাত চলছে দীর্ঘ বছর ধরে। যা নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হচ্ছে এরদোয়ান সরকারকে। দেশব্যাপী অর্থনৈতিক নৈরাজ্য শুরু হলে এ সুযোগটা নেবে কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। আর তাদের এ সুযোগটা করে দেবে যুক্তরাজ্যের নেতৃত্বে পশ্চিমা শক্তি। এখানে তারা এক ঢিলে দুই পাখি মারবে। একদিক নতুন উদীয়মান শক্তি তুরস্ককে শেষ করে দিয়ে ইউরোপের প্রবেশপথ নিরাপদ রাখা। অপর দিকে কুর্দিদের দিয়ে একটি পুতুল রাষ্ট্র তৈরি করা। এ পুতুল রাষ্ট্রের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের তেলের রাজনীতি নিয়ে নতুন খেলা শুরু করবে যুক্তরাষ্ট্র।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এ খেলার সমীকরণ মেলানো ভাবনার চেয়েও কঠিন হবে।তাদের এই নতুন খামখেয়ালির বলি যদি হয় তুরস্ক তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে চীন-রাশিয়া কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? ইরানের ভাগ্যে কী ঘটবে? এসবের হিসেব বড় জটিল। যা নিয়ে এখনই স্পষ্ট করে কিছু বলা মুশকিল। তবে ভূ-রাজনীতির কথা বিবেচনা করলে তুরস্কের পতন তার প্রকৃত শত্রুরাও দেখতে চাইবে না। তুরস্কের পতন মানে নিজের ঘরে যুদ্ধ চলে আসা। তাই রাশিয়া-চীন কখনোই পরাজিত তুরস্ককে দেখতে চায় না।

এছাড়া সিরিয়া ইস্যুতে রাশিয়া-তুরস্ক মিলে যাওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে রাশিয়ার গুরুত্ব ব্যাপকভাবে বেড়ে গিয়েছে।ফলে রাশিয়ার জন্য নিজেদের স্বার্থেই একটি শক্তিশালী তুরস্ক কামনা করা ছাড়া অন্যথা নেই।

তুরস্ক আজ যে অর্থনৈতিক অবরোধের মুখোমুখি, রাশিয়া তার ভুক্তভোগী কয়েক দশক ধরে। ফলে আমরা দেখি তুরস্কের ওপর ট্রাম্পের নতুন অবরোধ আরোপের পর এরদোয়ান-পুতিনের ফোনালাপ।

দুই নেতার আলাপের পর পরই তুরস্ক-রাশিয়া ঘোষণা করেছে তারা ডলারের পরিবর্তে নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেন করবে। দেশ দুটিকে দেখে অন্যদেশও ডলার বর্জনের পথে যেতে পারে। চীন-ইরান নিজেদের স্বার্থেই এ কাজে শামিল হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।

এদিকে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো ডলারের পরিবর্তে নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্য করার কথা চিন্তা করছে।

মধ্যপ্রাচ্যে তুরস্কের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু কাতার ডলারের পরিবর্তে নিজস্ব মুদ্রায় তুরস্কে সরাসরি বিনিয়োগের অঙ্গীকার করেছে। এসবের ফলে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি। তুরস্ক নিজেদের অর্থনীতিকে বাঁচাতে বেশকিছু সংস্কার কাজও হাতে নিয়েছে।

তবে নব্য উন্মাদ ট্রাম্পের আক্রমণাত্মক আচরণের পাল্টা হিসেবে সংযত আচরণ করতে পারত অটোমানের উত্তরসূরীরা। এটা সবপক্ষের জন্যই মঙ্গলজনক হত। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা না করে যুক্তরাষ্ট্রের ইটের জবাবে পাটলেক ছোড়ার পথ নিয়েছে দেশটি। এর নেপথ্যেও আমরা দেখি দেশটির একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী এরদোগানের কর্তৃত্ববাদী সিদ্ধান্ত।

যুক্তরাষ্ট্রের বেশকিছু পণ্যে পাল্টা ভ্যাট বসিয়েছে গত এক দশকে ধীরে ধীরে গণতান্ত্রিক নেতার বেশ ছেড়ে সুলতান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোগান।

এরদোগান ও তার দেশের আচরণকে অনেকই বিপজ্জনক বলছেন। যুক্তরাষ্ট্রের মতো এক নম্বর শক্তির সঙ্গে সরাসরি লাগতে যাওয়ার আগে দেশটির উচিত নিজেদের শক্তির জায়গাটা তলিয়ে দেখা। এজন্য হয়তো তুর্কি জাতিকে চরম মূল্য দিতে হতে পারে। তবে কী হতে পারে বা পারে না তা নিয়ে চূড়ান্ত কথা বলার সময় এখনো আসেনি।

আমরা আপাতত লক্ষ্য রাখি, কোথাকার জল কোথায় গিয়ে গড়ায়। বঙ্গদেশের পররাষ্ট্র কর্তারা দিবাঘুম ভেঙে দুই দেশের দ্বন্দ্ব থেকে কিভাবে বাংলাদেশে লাভবান হতে পারে সেই চিন্তার ফুরসৎ পেলে বঙ্গবাসীর মধ্যে ধন্য ধন্য রব ওঠত।

লেখক: সরোজ মেহেদী, তুর্কি স্কলারশিপ ফেলো।

শিক্ষক, ভাষা-যোগাযোগ ও সংস্কৃতি বিভাগ, গণ বিশ্ববিদ্যালয়। ই-মেইল: saroujmahady@gmail.com

Please follow and like us:

Check Also

ইসরায়েলের অনুরোধে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক

ইরান থেকে ইসরাইলের উদ্দেশ্যে শতাধিক ড্রোন ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছে। এসব প্রতিহত করতে ইসরাইলের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।