খুলনায় ১৪টি গায়েবি মামলার আতংকে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা

ক্রাইমবার্তা রির্পোটঃগত ১৪ জুলাই ফুলতলা উপজেলার নিজ বাড়ি থেকে গ্রেফতার হন সদর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য মাওলানা রফিকুল ইসলাম। এরপর থেকে তিনি খুলনা জেলা কারাগারে বন্দি। গত ১৮ সেপ্টেম্বর তার বিরুদ্ধে আবারও মামলা করেছে ফুলতলা থানা পুলিশ। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়েছে, তিনিসহ অন্যান্য আসামিরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ককটেল নিক্ষেপ করেছেন। ফুলতলা থানার এস আই ইউসুফ শেখের করা মামলাটিতে ২০ নম্বর আসামি করা হয়েছে রফিকুল ইসলামকে। মামলার ৪৯ আসামিরা সবাই স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মী।

মাওলানা রফিকুল ইসলামের ভাতিজা মো. হিরণ দাবি করেন, জেলখানায় বসে পুলিশকে ককটেল মারবে কিভাবে? রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করতেই এই ‘গায়েবী’ মামলা দায়ের করা হয়েছে। ওইদিন এমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি।

গত ২১ সেপ্টেম্বর ডুমুরিয়া থানায় মামলা করেন গোয়েন্দা পুলিশের এস আই লুৎফর রহমান। মামলার এজাহারে বাদি উল্লেখ করেন, ‘২০ সেপ্টেম্বর ভোর ৪টা ৪৫ মিনিটে ডুমুরিয়ার টোলনা দক্ষিণপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠের উত্তর পাশের পুকুরপাড়ে বসে ২০০/২২০ আসামি সরকার পতন ঘটানোর লক্ষ্যে বৈঠক করছিলেন। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌছালে তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে ককটেল ছুড়ে মারে।’

মামলায় জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ও সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মিয়া গোলাম পারওয়ার, উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদকসহ ৬১ জনকে আসামি করা হয়। এর মধ্যে ৪০ নম্বর আসামি করা হয়েছে মালেক সরদারকে। মালেক সরদারের পরিবারের সদস্যরা জানান, একদিন আগেই চিকিৎসার জন্য ভারত গেছেন মালেক সরদার। তিনি এখনো ভারতে অবস্থান করছেন। তার পাসপোর্ট কাস্টমসের সিল দেখলে সেটা প্রমাণ হবে।

গত ২০ সেপ্টেম্বর রাতে দৌলতপুর থানা বিএনপির শীর্ষ ২৮ নেতাসহ অজ্ঞাত ১৪০/১৫০ জনের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করেন দৌলতপুর থানার এস আই মিঠুন রায়। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, ‘২০ সেপ্টেম্বর ভোর ৫টা ৫০ মিনিটে ১৪০/১৫০ জন আসামিরা নতুন রাস্তার মোড়ে পুলিশ বক্সের সামনে উপস্থিত হয়ে রাস্তা অবরোধ করে গাড়ি ও ভাংচুরের চেষ্টা করছে। তাদের বাধা দেয়া পুলিশের ওপরও তারা হামলা করে।’ মামলার প্রধান আসামি মহানগর বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক অধ্যক্ষ তারিকুল ইসলাম বলেন, বিএনপির সিনিয়র নেতারা ভোর ৫টায় লাঠিসোটা নিয়ে দোকান ভাংচুর করতে যাবে, এ কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সম্পূর্ণ কাল্পনিক গল্প সাজিয়ে এই মামলা করা হয়েছে। সারাদেশেই এমন ‘গায়েবী’ মামলা করে বিএনপিকে ভয় দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।

শুধু ফুলতলা, ডুমুরিয়া ও দৌলতপুর থানাতেই নয়; গত কয়েকদিনে খুলনা মহানগরী ও জেলার ৮টি থানায় ১৪টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। প্রতিটি মামলারই বাদি পুলিশ। মামলার বিবরণও প্রায় কাছাকাছি। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সহ¯্রাধিক নেতাকর্মীকে। এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, মহানগর বিএনপির সহ-সভাপতি মুশাররফ হোসেন, যুগ্ম সম্পাদক তারিকুল ইসলাম, বিভিন্ন থানার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারাও রয়েছেন।

মামলার এজাহার ও বিএনরি দপ্তর থেকে দেখা গেছে, খুলনা মহানগরীতে সদর থানায় দু’টি, দৌলতপুর থানায় একটি, লবণচরা থানা ও আড়ংঘাটায় একটি করে মামলা হয়েছে। এর মধ্যে সদর থানায় ১৩ ও ১৮ সেপ্টেম্বর দু’টি মামলা হয়েছে। এই দু’টি মামলায় ১০ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অজ্ঞাত পরিচয় আসামি করা হয়েছে আরও ৮০/৯৫ জনকে।

এছাড়া ২০ সেপ্টেম্বর দৌলতপুর থানায় ২৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত পরিচয় ১৫০ জনের বিরুদ্ধে, ২১ সেপ্টেম্বর লবণচরা থানায় ৪৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত পরিচয় আরও ১৫/২০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। লবণচরা থানার মামলাটি জামায়াত, মহানগর ও জেলা বিএনপি নেতাদেরও আসামি করা হয়েছে। আড়ংঘাটা থানার মামলায় আসামি হয়েছে দুই জন।

এছাড়া গত ১৪ আগস্ট কয়রা থানার মদিনাবাদ মডেল প্রাইমারী স্কুল মাঠে নাশকতার পরিকল্পনার অভিযোগে ২১ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ২০/২৫ জনের বিরুদ্ধে ডিবি’র ইন্সপেক্টর ইজাজুর রহমান বাদি হয়ে মামলা দায়ের করেন। মামলার আসামী মধ্যে ইসহাক ঢালী ওই সময় সৌদী আরবে হজ্বব্রত পালনে ছিলেন। ১৬ সেপ্টেম্বর কয়রা থানায় ব্রিজ ভাঙ্গার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ৩১ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত পরিচয় ১১০/১২০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এর মধ্যে আটক করা হয়েছে ৫ জনকে। ১৮ সেপ্টেম্বর ফুলতলা উপজেলায় ৪৯ জনের নাম উল্লেখ করে আরও অজ্ঞাত ১০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। একই অভিযোগে মামলা করা হয় রূপসা উপজেলায়। সর্বশেষ গত ২১ সেপ্টেম্বর ডুমুরিয়া থানার এস আই আবু সাদেকের করা মামলায় ৬১ জনের নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয়েছে ১০০ জনকে।

খুলনা জেলা বিএনপির সহ-দপ্তর সম্পাদক রফিকুল রহমান বাবু বলেন, গায়েবী এসব মামলায় এ পর্যন্ত রূপসা উপজেলার ১৭ জন, ফুলতলার ৫ জন ও কয়রা উপজেলার  ৮ জন নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে। অন্যরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

খুলনা মহানগর বিএনপি সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু অভিযোগ করেন, রাজনৈতিকভাবে চাপে রাখতেই এসব মামলা করা হচ্ছে। অদ্ভুত ও হাস্যকর ঘটনা উল্লেখ করে মামলা করায় নেতাকর্মীরা এটাকে গায়েবী মামলা বলে তাচ্ছিল্য করছে। এসব মামলা করে বিএনপিকে চাপে রাখা যাবে না।

তবে বিএনপির এই অভিযোগ সত্য নয় বলে দাবি করেছেন খুলনার পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহ। তিনি বলেন, পুলিশ যা করছে, নিয়মমাফিক করছে। আইনের মধ্য থেকেই করছে। কাউকে হয়রানিমূলক মামলা বা গ্রেফতার করা হচ্ছে না।

এ ব্যাপারে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত উপ-কমিশনর সোনালী সেন বলেন, নতুন করে কোনো নাশকতার মামলা হয়নি। যা হচ্ছে নিয়মিত মামলা। হয়রানির উদ্দেশ্যে কাউকে মামলা দেয়া বা আটকের অভিযোগ সত্য নয়।

Please follow and like us:

Check Also

কলারোয়া  উপজেলা জামায়াতের প্রথম সভাপতি আবুল কাশেমের ইন্তেকালঃ বঙ্গবন্ধু বিশেষ সুপারিশে  যিনি কারা মুক্ত হন

সাতক্ষীরা সংবাদদাতাঃ কলারোয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান, উপজেলা জামায়াতের প্রথম সভাপতি বাংলাদেশ পরিবহন মালিক সমিতির …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।