নৌকা দেখলেই ছুটে যান বানভাসিরা ত্রাণের জন্য হাহাকার ‘নাওতে থাকি নাওতে খাই, কেউ হামার খোঁজ না নেয়’ * ১০ লাখ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত, এ পর্যন্ত প্রাণহানি ৭১ * গোখাদ্যের অভাবে লোকসানে গরু বিক্রি * পানি নামছে ধীরগতিতে * এ মাসের শেষে ফের বন্যার আশঙ্কা উত্তরে

ক্রাইমবার্তা রিপোটঃ  ‘৮ দিন হইলো নদীত বাড়ি ভাঙ্গি গেইছে, নিরুপায় হয়া ব্যাটা, ব্যাটার বউ আর ছোট দুকনা ছাওয়া নিয়ে নাওতে থাকি নাওতে খাই। মেম্বর-চেয়ারম্যান কেউ হামার খোঁজ না নেয়।’ কথাগুলো বলছিলেন কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার রমনা ইউনিয়নের খরখরিয়া এলাকার মৎস্যজীবী সুনীল চন্দ্রের স্ত্রী যাত্রী বালা।

এভাবেই সীমাহীন দুঃখ-কষ্টে দিন কাটছে বানভাসি মানুষের। বিভিন্ন স্থানে ত্রাণের জন্য হাহাকার দেখা দিয়েছে। ত্রাণের আশায় নৌকা দেখলেই ছুটে যান তারা। অনেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানিতে দাঁড়িয়ে থাকেন।

সরকারিভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আশ্রয় কেন্দ্রে ত্রাণ বিতরণ করা হলেও বাঁধে বা উঁচু স্থানে আশ্রয় নেয়া কিংবা বন্যায় পানিতে আটকে পড়া মানুষ ত্রাণ পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও বলছেন তারা পর্যাপ্ত ত্রাণ বরাদ্দ পাচ্ছেন না। গবাদিপশু ও গোখাদ্য নিয়েও চরম বিপাকে পড়েছেন বন্যার্তরা।

অনেকে কোরবানির ঈদের জন্য লালনপালন করা গরু লোকসানে বিক্রি করে দিচ্ছেন। এদিকে প্রকৃতির ডাক এলেই চরম ভোগান্তিতে পড়েন বানভাসি নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা। অনেকে পানিতেই সারছেন প্রাকৃতিক কাজ। ফলে ডায়রিয়াসহ নানা পানিবাহিত রোগবালাই ছাড়িয়ে পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এদিকে বন্যার পানিতে ডুবে ছয় জেলায় আরও ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বন্যায় ৭১ জনের প্রাণহানি হল। বিভিন্ন জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১০ লাখ পরিবার।

এদিকে পানি নামা অব্যাহত থাকায় বিভিন্ন জেলায় বন্যার উন্নতি হচ্ছে। বন্যাপ্রবণ দুই অববাহিকা ব্রহ্মপুত্র-যমুনা এবং মেঘনায় এই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কিন্তু এরপরও এখনও ২৫ জেলা কমবেশি বন্যাকবলিত। বিশেষ করে উত্তরের বিভিন্ন জেলায় এখনও বড় ধরনের বন্যা চলছে। নদীগুলোর নাব্য কমে যাওয়ায় বানের পানি নামার হার আগের তুলনায় কম।

ফলে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে ধীরগতিতে। উত্তরের জেলাগুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম নীলফামারীতে বন্যার পানি অনেকটাই নেমে যায়। কিন্তু দু’দিন ধরে ভারতের সিকিমে বৃষ্টি হওয়ায় তিস্তায় পানিপ্রবাহ বেড়ে গেছে। এতে ডালিয়া পয়েন্টে রোববার পানি আবার বিপদসীমার উপরে চলে গেছে। ফলে ওই জেলার নিুাঞ্চল নতুন করে আবারও বন্যার কবলে পড়েছে। অপরদিকে টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী ও মুন্সীগঞ্জসহ মধ্যাঞ্চলের জেলাগুলোয় বন্যা পরিস্থিতি অবনতির দিকে।

আবহাওয়া ও বন্যা বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, আগামী কয়েকদিন ভারতের মেঘালয়, আসাম ও ত্রিপুরায় ব্যাপক বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস নেই। ফলে উত্তরের জেলাগুলোয় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত থাকবে। কিন্তু বানের সেই পানি নেমে আসছে মধ্যাঞ্চলে। এ কারণে এই অঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। সার্বিক পরিস্থিতিতে আরও এক সপ্তাহ উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা বন্যার পানির নিচে থাকবে।

বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম রোববার  বলেন, পলিমাটি জমে নদ-নদীর বিশেষ করে যমুনার তলদেশ অনেকটাই ভরাট হয়ে গেছে। বিভিন্ন স্থানে পানি নামার চ্যানেল বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বানের পানি আশানুরূপ হারে নামছে না।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের আবহাওয়া বিভাগগুলোর পূর্বাভাস অনুযায়ী ২৮-২৯ জুলাইয়ের দিকে নেপাল-বিহার থেকে শুরু করে ত্রিপুরা পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ ও রাজ্যে ভারি বৃষ্টিপাত হতে পারে। এর পরিমাণ ১০০ থেকে ২০০ মিলিমিটার। সাধারণত একদিনে ৫০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি হলে তা স্থানীয় বন্যায় পরিণত হয়। সেই হিসাবে চলমান বন্যার পানি না নামতেই যদি ফের ভারি বৃষ্টি হয়, তাহলে সেটা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবেই আবির্ভূত হতে পারে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র (এফএফডব্লিউসি) জানিয়েছে, ব্রহ্মপুত্র-যমুনার পানি নেমে আসায় ঢাকার চারপাশের নদনদীতে পানিপ্রবাহ বাড়ছে। তবে এগুলোয় এখনও পানি বিপদসীমার নিচে আছে।

রোববার পর্যন্ত বন্যায় আক্রান্ত জেলাগুলোর মধ্যে আছে- কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁ, টাঙ্গাইল, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, চাঁদপুর, নেত্রকোনা, সিলেট, সুনামগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার। এছাড়া চট্টগ্রাম, বান্দরবান, কক্সবাজার, শেরপুর জেলা বন্যায় আক্রান্ত হয়। এফএফডব্লিউসির মতে, ২৪ ঘণ্টায় বগুড়া, জামালপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, সিলেট, টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও মুন্সীগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি একই অবস্থায় থাকতে পারে।

এফএফডব্লিউসির দেয়া বুলেটিনে বলা হয়, ১৪ নদ-নদীর পানি ২১ স্টেশনে বিপদসীমার উপরে প্রবাহিত হয়েছে। তবে বিপদসীমার উপরে প্রবাহিত নদী ও স্টেশনের সংখ্যা আরও বেশি বলে যুগান্তর প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন।

ক্ষতিগ্রস্ত ১০ লাখ পরিবার : ভয়াবহ বন্যায় দেশের ১৩ জেলার ১০ লাখ পরিবার ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বানের পানিতে ডুবে গেছে এসব জেলার ৯৭ হাজার ৯৯৯ হেক্টরের বেশি ফসলি জমি। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধসহ কাঁচা-পাকা মিলে ৬ হাজার ১২ কিলোমিটার রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যাকবলিত এসব জেলার ৩ হাজার ৪২০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স কো-অর্ডিনেশন সেন্টারের (এনডিআরসিসি) সর্বশেষ প্রতিবেদনে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম সূত্র বলছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বন্যাজনিত কারণে এ পর্যন্ত ৭১ জনের মৃত্যু হয়েছে।

দ্রুত ত্রাণ পাঠানোর সুপারিশ : বন্যাকবলিত দেশের বিভিন্ন এলাকায় দ্রুত ত্রাণসামগ্রী পাঠানোর সুপারিশ করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। রোববার জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত কমিটির বৈঠকে এ সুপারিশ করা হয়। কমিটির সভাপতি এবি তাজুল ইসলাম এতে সভাপতিত্ব করেন। কমিটির সদস্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান, সোলায়মান হক জোয়ার্দার (ছেলুন), মো. আফতাব উদ্দিন সরকার, মীর মোস্তাক আহমেদ রবি, জুয়েল আরেং, মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী এবং কাজী কানিজ সুলতানা বৈঠকে অংশ নেন।

ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

কুড়িগ্রাম ও চিলমারী : বন্যা পরিস্থিতির সামান্য উন্নতি হলেও এখনও পানিতে ভাসছে গোটা চিলমারী। উপজেলার ৬ ইউনিয়নে প্রায় দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দি। বাড়িতে পানি ওঠায় বানভাসি মানুষ পরিবার-পরিজন ও গরু-ছাগল নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সরেজমিন উপজেলার রমনা ইউনিয়নের খরখরিয়া ভরটত্মপাড়ায় দেখা যায়, নৌকায় রান্না করছেন মৎস্যজীবী সুনীল চন্দ্রের স্ত্রী যাত্রী বালা। তিনি বলেন, ‘৮ দিন হইলো নদীত বাড়ি ভাঙ্গি গেইছে, নিরুপায় হয়া ব্যাটা, ব্যাটার বউ আর ছোট দুকনা ছাওয়া নিয়ে নাওতে থাকি নাওতে খাই। মেম্বর-চেয়ারম্যান কেউ হামার খোঁজ না নেয়।’ একই এলাকার পাউবো বাঁধে আশ্রয় নেয়া লাল চরণ, পূর্ণিমা ও সুরবালাসহ অনেকে জানান, ৮ দিন ধরে পাউবো বাঁধে আশ্রয় নিয়ে থাকলেও তারা সরকারি কোনো ত্রাণ পাননি। একই কথা জানান সাতঘরিপাড়া এলাকায় পাউবো বাঁধে আশ্রয় নেয়া নছমান বেওয়া ও রফিয়াল হক।

রানীগঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল ইসলাম মঞ্জু জানান, তার ইউনিয়নে পানিবন্দি রয়েছে ৭ হাজার পরিবার। অথচ তিনি ত্রাণ পেয়েছেন দুই দফায় মাত্র ১৮.৮ টন চাল, যা ১ হাজার ৮৮০টি পরিবারের মাঝে বিতরণ করেছেন।

বকশীগঞ্জ (জামালপুর) : বকশীগঞ্জে নৌকা দেখলেই ত্রাণের আশায় ছুটে আসেন বানভাসিরা। অনেক নারী-পুরুষ আবার ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানিতেই দাঁড়িয়ে থাকছেন ত্রাণের আশায়। স্থানীয়দের অভিযোগ, সরকারিভাবে বরাদ্দ দেয়া ত্রাণ চাহিদার চেয়ে অনেক কম। বন্যায় উপজেলার প্রায় সোয়া লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বসতভিটা, ফসলি জমি, হাটবাজার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানিতে তলিয়ে গেছে। দেড় শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে কমপক্ষে ৭৫টি পরিবারের বসতবাড়ি। তারা এখন খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন। রাস্তাঘাট-ব্রিজ, কালভার্ট ভেঙে যাওয়ায় এবং বেশির ভাগ সড়ক পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় উপজেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বন্যাকবলিত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি ও শুকনা খাবারের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।

রোববার বেলা ২টার দিকে উপজেলার সদর ইউনিয়নের সদর সূর্যনগর পূর্বপাড়া গ্রামের শাহীনের মেয়ে সুজনী আক্তার (১১) ও একই গ্রামের সোলায়মানের মেয়ে সাথী আক্তার (১০) বাড়ির পাশে ভেলা নিয়ে খেলতে গিয়ে পানিতে ডুবে মারা যায়। একই দিন সকালে উপজেলার মেরুরচর ইউনিয়নের রবিয়ারচর গ্রামে বৃদ্ধ আবদুল শেখ (৭৫) পানির স্রোতে তলিয়ে গিয়ে মারা যান। এদিন সাধুরপাড়া ইউনিয়নের কুতুবেরচর গ্রামে ইয়াসিন আলীর শিশু ছেলে স্বাধীন (৪) পানিতে ডুবে মারা গেছে। এছাড়া শনিবার সন্ধ্যায় উপজেলার নিলাক্ষিয়া ইউনিয়নের কুশলনগর গ্রামের সামের আলীর ছেলে রাহাদ (৯) পানিতে ডুবে মারা যায়। একই দিনে সদর ইউনিয়নের ঝালরচর গ্রামে রাজা বাদশা (৫৫) নিজ বাড়িতে সাপের কামড়ে মারা যান। এদিকে বানের পানিতে নিখোঁজ ব্যবসায়ী সুজন মিয়ার লাশ উদ্ধার হয়েছে।

মৌলভীবাজার : প্রতিবারের মতো এবারও কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে জেলার খামারিরা গরু মোটাতাজাকরণের প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। গরুর খাবারের জন্য অনেকেই জমিতে ঘাস চাষ করেন। কিন্তু বন্যায় তাদের সব ঘাস প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে। খাদ্য সংকটের কারণে লোকসান দিয়ে অনেকেই এখন গরু বিক্রি করে দিচ্ছেন। সদর উপজেলার শেরপুর, আখাইলকুড়া, চাঁদনীঘাট ও কমলগঞ্জ উপজেলার একাধিক খামারি বলেন, কোরবানিতে গরু বিক্রি করে পুরো বছরের লোকসান পুষিয়ে ওঠার একটা সুযোগ থাকে। কিন্তু এবার সম্ভব হচ্ছে না। বন্যায় সম্পূর্ণ ঘাস নষ্ট হয়ে গেছে। বিকল্প কোনো খাদ্যও নেই। জেলা প্রাণিসম্পদ অফিস সূত্রে জানা যায়, জেলায় বন্যায় ১৪৬ একর ঘাসের জমি ও ৩৫.৫ টন গোখাদ্য বিনষ্ট হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ৩ হাজার ৭৭৩টি গরু, ১৩৪টি মহিষ, ১৯১টি ছাগল, ১৩৮টি ভেড়া, ২১ হাজার ৯৩৮টি মোরগ ও ২৬ হাজার ৭৩টি হাঁস।

দেওয়ানগঞ্জ (জামালপুর) : ‘গলাপানি ভাঙ্গি আইছি তাও কোনডা পাইলাম না, কয়ডা চাইল আছিল তাও ইন্দুরে খাইছে। এখন কি খাইয়ে থাকুম।’ কথাগুলো বলছিলেন ৭০ বছরের বৃদ্ধ ছলিমা বেওয়া। তার বাড়ি চুকাইবাড়ী দক্ষিণ বালুগ্রামে। বৃদ্ধা আরও বলেন, ‘চারবার বাড়ি নদী ভাঙছে, সন্তানরা ভাত দেয় না। এ বাড়ি ও বাড়ি চেয়ে চিমটে দিন চলে। বাঁধের উপর থাকা ঘরত পানি ওঠায় ভাঙাচুরা রেল বগিতে উঠছি।’ এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন অপর বৃদ্ধ হাছিনা। তার বাড়ি দেওয়ানগঞ্জ ইউনিয়নের খড়মা মধ্যপাড়া গ্রামে। হাছিনা বলেন, ‘ঘরে বানের পানি ওঠায় রাস্তাত সন্তানদের নিয়ে আছি। মেম্বারদের হাতপা ধরছি, তাও কোনোকিছু পাই নাই।’ আজ কী খেয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগের দিন রাতত মুড়ির গুঁড়া খাইছি, রোববার দুপুর পর্যন্ত কোনোটাই খাই নাই। রোববার সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বাহাদুরাবাদ, চিকাজানী, দেওয়ানগঞ্জ ও চুকাইবাড়ী ইউনিয়নের বানভাসি মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে গবাদিপশু নিয়ে সড়ক, বাঁধ, রেলস্টেশন ও ব্রিজসহ বিভিন্ন উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন। পৌর এলাকাসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুকনো খাবার, রান্না খাবার বিতরণ করা হলেও বিভিন্ন উঁচু স্থানে আশ্রয় নেয়া বানভাসি কিংবা বন্যায় পানিতে আটকে পড়া মানুষ ত্রাণ পাচ্ছেন না।

গোলাপগঞ্জ (সিলেট) : বন্যার পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হলেও এখনও পানিবন্দি উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের ২০-২৫টি গ্রামের মানুষ। তাদের অনেকের ঘরে হাঁটুপানি। এসব এলাকার কর্মজীবী লোকজন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তাদের হাতে কাজ নেই, ঘরে চাল নেই, পকেটে নেই টাকাও। ফলে পরিবার-পরিজন নিয়ে অনেকে দিনযাপন করছেন অর্ধাহারে-অনাহারে।

ভূঞাপুর (টাঙ্গাইল) : বন্যাকবলিত এলাকায় বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট রয়েছে। ফলে বন্যাকবলিত এলাকায় পানিবাহিত রোগব্যাধির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মহিউদ্দিন জানান, বন্যাকবলিত এলাকায় ৮টি টিম করে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে।

শেরপুর : ব্রহ্মপুত্রের শাখা মৃগী নদীর পানির প্রবল চাপে সদর উপজেলার বেতমারি-ঘুঘুরাকান্দি ইউনিয়নের বেতমারি বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। এতে বেতমারি, চরখারচর, ঘুঘুরাকান্দিসহ আশপাশের ৫ গ্রামের ৩০ হাজার মানুষ নতুন করে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। রোববার বিকালে শ্রীবরদী উপজেলার ঝগড়ার চর এলাকায় বন্যার পানিতে কলার ভেলা নিয়ে খেলা করার সময় পানিতে ডুবে কবিতা নামে ৯ বছরের এক শিশু মারা গেছে।

গাইবান্ধা : রোববার বিকালে উপজেলার খোলাহাটী ইউনিয়নের আনালেরতাড়ী গ্রামের আশরাফ আলীর ছেলে রিপন মিয়া কলাগাছের ভেলায় চড়ে রাস্তায় আসছিল। এ সময় বৈদ্যুতিক তারে স্পৃষ্ট হয়ে রিপন আহত হয়। পরে তাকে গাইবান্ধা জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

কালকিনি (মাদারীপুর) : বন্যার পানিতে ডুবে জিসান চাপরাসী (১) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। শনিবার সন্ধ্যায় হাসপাতালে নেয়ার পথে সে মারা যায়। সে উপজেলার শিকারমঙ্গল এলাকার কামাল চাপরাসীর ছেলে।

চরভদ্রাসন (ফরিদপুর) : উপজেলার চরহরিরামপুর ইউনিয়নের ছমির বেপারী ডাঙ্গী গ্রামের কামাল খানের মেয়ে তাকিয়া আক্তার (২) বসতবাড়ির আঙিনায় পানিতে ডুবে মারা গেছে।

সরিষাবাড়ী : জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে বন্যার পানিতে ডুবে ইরান নামে তিন বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। শনিবার সন্ধ্যায় পৌর কামরাবাদ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। সে কামরাবাদ গ্রামের সাখাওয়াত হোসেনের ছেলে।

কলমাকান্দা (নেত্রকোনা) : কলমাকান্দায় বন্যার পানিতে ডুবে জুবায়ের মিয়া (৫) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। রোববার দুপুরে বাড়ির সামনে বন্যার পানিতে ভাসমান অবস্থায় তার লাশ পাওয়া যায়। শিশুটি উপজেলার কৈলাটি ইউনিয়নের রানীগাঁও গ্রামের মজিবুর মিয়ার ছেলে।যুগান্তর

Please follow and like us:

Check Also

পৃথিবীর যেসব দেশে তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রিরও উপরে

জলবায়ু পরিবর্তনের চরম ভয়াবহতার সাক্ষী হতে যাচ্ছে সারাবিশ্ব। প্রতিদিনই একটু একটু করে বৈরি হচ্ছে আবহাওয়া, …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।