কাশ্মির এখন মৃত্যুপুরী

ক্রাইমর্বাতা ডেস্কিরেপাট:  পুরো ভারত এবং পুরো বিশ্ব থেকে যখন কাশ্মিরকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে, তখন সেখানকার পরিস্থিতি জানতে বুধবার শ্রীনগরে পৌঁছেছেন বিবিসি বাংলার শুভজ্যোতি ঘোষ। কিন্তু প্রথম ২৪ ঘন্টায় অনেক চেষ্টা করেও তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ স্থাপন করা যায়নি। অবশেষে বৃহস্পতিবার অল্প সময়ের জন্য তিনি কথা বলতে পেরেছিলেন লণ্ডনে সহকর্মীদের সঙ্গে। সেই কথোপকথনে কাশ্মীরের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন তিনি :

শ্রীনগরে পা রাখার পর ২৪ ঘন্টারও বেশি পেরিয়ে গেছে, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন মৃত্যু উপত্যকায় এসে পৌঁছেছি।

রাস্তাঘাটে এক শ’ গজ পরপরই সেনা চৌকি আর কাঁটাতারের ব্যারিকেড। রাস্তায় যত না সাধারণ মানুষ, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি সেনা আর আধা সেনা।

মানুষের ছোট ছোট কিছু জটলা। আমার হাতে বিবিসির মাইক দেখেই তারা এগিয়ে আসছেন কথা বলতে। ৩৭০ ধারা এবং কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা রাতারাতি বিলুপ্ত হওয়ার পর তারা কতটা বিক্ষুব্ধ, সেটা তাদের চেহারাতেই স্পষ্ট।

কেউ কেউ তো বলছেন, দশ মিনিটের জন্য কাশ্মীরে জারি করা কারফিউ তুলে নেয়ার হিম্মত দেখাক সরকার, তারপরই তারা দেখবে দলে দলে কত মানুষ রাস্তায় নামে এর প্রতিবাদ জানাতে।

সরকারও সেটা নিশ্চয়ই জানে, তাই তো গোটা কাশ্মীর উপত্যকা এখন নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় মুড়ে দেয়া হয়েছে।

ঝিলমের তীরে এখন যে স্তব্ধতা, সেটা যে ঝড়ের আগের, সেটা স্পষ্ট। কাশ্মিরে আমার এর আগেও আসা হয়েছে। বিভিন্ন ঘটনা-বিক্ষোভ-সংঘাতের খবর সংগ্রহ করতে।

কিন্তু এরকম অবস্থা আমি এর আগে কখনো দেখিনি। এর সঙ্গে যেন আগের কোনো কিছুর তুলনা চলে না।

কাশ্মির এখন যেন এক মৃত্যুপুরী। রাস্তাঘাটে কোনো লোকজন নেই।

পুরো রাজ্য জুড়ে আছে প্রায় আড়াই লাখ ভারতীয় সেনা। টানা কারফিউ জারি রয়েছে। দোকানপাট বন্ধ।

অনেকের বাড়িতেই খাবার ফুরিয়ে গেছে, রেশন ফুরিয়ে গেছে। কেনাকাটার জন্য তারা সাহস করে কেউ কেউ বেরুচ্ছেন, কিন্তু কিছু কেনার মতো কোন দোকান খোলা নেই।

ব্যাপক ধরপাকড়

শ্রীনগরের যেসব জায়গায় আমার যাওয়ার সুযোগ হয়েছে, তাতে মনে হয়েছে পুরো শহর জুড়ে একটা থমথমে পরিবেশ। চারিদিকে আতংক, ক্ষোভ।

রাজনীতিবিদদের প্রায় সবাই কারাগারে কিংবা গৃহবন্দী। গুপকার রোড, যেখানে থাকেন সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ বা মেহবুবা মুফতির মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিকরা, সেখানে কাউকে ঢুকতেই দেয়া হচ্ছে না।

বৃহস্পতিবার সকালে আমরা বার বার চেষ্টা করেও সেদিকে যেতে পারিনি। ডাল লেকের ধারে গভর্নর হাউস, সেদিকেও যেতে দেয়া হচ্ছে না। গুজবের শহর হয়ে উঠেছে শ্রীনগর। নানা জায়গায় বিক্ষোভ চলছে বলে শোনা যাচ্ছে। কিন্তু শ্রীনগরের কোথাও বিক্ষোভ আমাদের চোখে পড়েনি।

একটা ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে অনেক ট্যাক্সি চালক বসে ছিলেন। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তারা বললেন, এখানে কি করছেন। বেরামিতে যান। ওখানে দশ হাজার বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। লোকজন পথে নেমে বিক্ষোভ করছে।

কিন্তু এগুলো সব শোনা কথা, সত্যিই এরকম কিছু ঘটছে কীনা, তা যাচাই করার কোন উপায় নেই।

বিক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ

কাল যখন আমি এয়ারপোর্টে নামার পর গাড়ির দিকে যাচ্ছি, তখন কিছু লোক বোধহয় আমার বিবিসির পরিচয়পত্র দেখেছেন। তারা কথা বলতে এগিয়ে আসেন।

৩৭০ ধারা এবং কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের ঘটনায় এরা যেভাবে তাদের আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটালেন, সেটা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

তারা আমাকে বললেন, পার্লামেন্টে অমিত শাহ দাবি করেছেন যে কাশ্মীরের আশি শতাংশ মানুষ নাকি এটি সমর্থন করে। যদি তাই হবে, সরকার কেন মাত্র আট মিনিটের জন্য কারফিউ তুলে দিচ্ছে না। কারফিউ তুলে নিক, তারপর তারা দেখতে পাবে কীভাবে মানুষ রাস্তায় নামে প্রতিবাদ জানাতে।

তারা হাসপাতালে যেতে পারছে না। অন্তসত্ত্বা মায়েরা চিকিৎসা পাচ্ছে না। মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী কিনতে পারছে না। সব জায়গায় গিজ গিজ করছে সেনা।

মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ। ইন্টারনেট বন্ধ। ল্যান্ডলাইনও কাজ করছে না।

এদের কেউ কেউ আমাদের আর্জি জানালেন, দয়া করে কাশ্মীরের এই ছবিটা গোটা পৃথিবীকে জানান।

একটা বিষয় পরিস্কার। যেরকম বিপুল সংখ্যায় কাশ্মীর জুড়ে নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে, তার কারণে কেউ এখন রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করতে পারছে না। কিন্তু পরে পরিস্থিতি কি দাঁড়াবে, সেটা বলা মুশকিল।

অঘোষিত জরুরি অবস্থা

কাশ্মিরে এখন কার্যত একটা অঘোষিত জরুরি অবস্থা জারি রয়েছে।

এখানকার কোন নিউজ পোর্টাল রোববারের পর আর আপডেট করা হয়নি, কারণ ইন্টারনেট বন্ধ। আমি কয়েকটি সংবাদপত্র অফিসে গিয়েছিলাম। সেখানে কেউ নেই। কোনো পত্রিকা বেরুতে পারছে না।

দিল্লি বা জম্মু থেকে প্রকাশিত কিছু সংবাদপত্র এখানে এসেছিল আজ সকালে। নিমেষে সেগুলো উড়ে গেল। এগুলো কিন্তু তিন দিনের বাসী সংবাদপত্র। বলা হচ্ছে, এগুলোতে নাকি সেন্সরের কাঁচি পড়েছে জোরেশোরে।

তারপরও মানুষ এগুলো পড়ছে, যেহেতু আর কোনো জানার সূত্র নেই। বলা যেতে পারে কাশ্মীরে স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমের কন্ঠ একরকম রোধ করেই রাখা হয়েছে।

নিরানন্দ ঈদ

কদিন পরেই মুসলিমদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব, ঈদ উল আজহা। ভেড়ার পাল নিয়ে এসেছিলেন বহু ব্যবসায়ী, বিক্রির জন্য। হতাশ ব্যবসায়ীরা তাদের ভেড়ার পাল নিয়ে রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ভেড়া কেনার মতো কেউ নেই। কিনবেই বা কেন, বলছেন তারা। এরকম একটা পরিবেশে কে কোরবানি দেবেন, কার কাছে মাংস বিতরণ করবেন। কাশ্মীরের মানুষের ঈদের আনন্দ এবার মাটি, এক নিরানন্দ ঈদের অপেক্ষায় তারা।

শোনা যাচ্ছে, ঈদের সময় হয়তো কারফিউ শিথিল করা হতে পারে। কারও ধারণা ১৫ আগষ্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসের পর হয়তো কারফিউ উঠতে পারে।

কিন্তু কাশ্মীর এখন যে ভয়-ভীতি-আতংকের মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে, কোন কিছুতেই কারো কোনো আশা নেই, কারো কোনো ভরসা নেই।
সূত্র : বিবিসি

Check Also

উন্নত সমৃদ্ধ স্মার্ট সোনার বাংলা গড়ে তুলব: পরিদর্শন বইয়ে প্রধানমন্ত্রী

মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে ঢাকার সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।