যেভাবে ক্ষমতাধর হয়ে ওঠেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি গ্রেফতারকৃত ‘ক্যাসিনো সম্রাট ইসমাইল চৌধুরী

ক্রাইমবার্তা রিপোটঃ  ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। আজ ভোর ৫টার দিকে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের আলকরা ইউনিয়নের কুঞ্জুশ্রীপুর গ্রাম থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। সম্রাটের সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তার সহযোগী আরমানকেও। র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। র‌্যাব সূত্র জানায়, আজ রোববার তাকে আদালতে তোলা হবে।

র‌্যাব বলছে, চলমান ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানের ধারাবাহিকতায় সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

সূত্র জানায়, যুবলীগের প্রভাবশালী নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট চলমান ক্যাসিনো-জুয়াবিরোধী অভিযানের শুরু থেকে তাদের নজরদারির মধ্যেই ছিলেন। এই সময়ের মধ্যে তিনি বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও চালিয়েছিলেন। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার কারণে তিনি দেশ ছাড়তে পারেননি।

তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান পরিচালনার পর থেকেই সম্রাট কোথায় অবস্থান করছেন তা নিয়ে ধোঁয়াশা ছিল।

এর আগে, শনিবার রাজধানীর একটি অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সম্রাটের গ্রেপ্তারের  বিষয়ে বলেছিলেন, আপনারা শিগগিরই দেখতে পাবেন। সম্রাট হোক আর যেই হোক, অপরাধ করলে তাকে আমরা আইনের আওতায় আনবো। আপনারা সময় হলেই দেখবেন।

সম্প্রতি মতিঝিলের ইয়ংমেনস, ওয়ান্ডারার্স, মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া চক্র ও বনানীর  গোল্ডেন ঢাকা ক্লাবে র‌্যাব অভিযান চালিয়ে সেগুলো সিলগালা করে দেয়। এ অভিযানের ধারাবাহিকতায় দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্লাব ও জুয়ার আসরে অভিযান চালায় পুলিশ।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় মোহামেডান, আরামবাগ, দিলকুশা, ওয়ান্ডারার্স, ভিক্টোরিয়া ও ফকিরেরপুল ইয়ংমেনস ক্লাবে ক্যাসিনো ছিলো। এর মধ্যে ইয়ংমেনস ক্লাবে ক্যাসিনো চালাতেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। বাকি পাঁচটি ক্লাবে ক্যাসিনো চালাতেন সম্রাটের লোকজন। সম্রাট নিজে ক্যাসিনো দেখাশোনা না করলেও তার ক্যাসিনো চালাতেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাওসার এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলর এ কে এম মমিনুল হক ওরফে সাঈদ।

-0-=

ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের জন্ম ফেনীর পরশুরামে। ‘ক্যাসিনো সম্রাট’ রাজধানীর জুয়াড়িদের কাছে বেশ পরিচিত নাম। তার বাবা ফয়েজ আহমেদ ছিলেন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী। অনেক আগেই মারা গেছেন তিনি। মা বড় ভাইয়ের সঙ্গে ঢাকায় থাকেন। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের পর সম্রাটের পরিবারের সবাই গা ঢাকা দেন। সম্রাট থাকতেন মহাখালীর বাসায়।

দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সম্রাট সবার বড়। বাড়ি পরশুরামে হলেও সেখানে তাদের পরিবারের কেউ থাকেন না।

সাধারণত, ফেনীতে নিজের এলাকায় বিপুল সংখ্যক কর্মীদের নিয়ে সফর করেন সম্রাট। এছাড়া স্থানীয়ভাবে আর্থিক সহযোগিতা; বিশেষ করে স্থানীয় মসজিদ ও মাদরাসার বড় দাতা হিসেবে খ্যাতি রয়েছে তার।

অভিযোগে জানা যায়, সম্রাটের নেশা ও ‘পেশা’ জুয়া খেলা। তিনি একজন পেশাদার জুয়াড়ি। প্রতি মাসে অন্তত ১০ দিন সিঙ্গাপুরে যান জুয়া খেলতে। সেখানে টাকার বস্তা নিয়ে যান তিনি।

সম্রাট রাজনীতিতে প্রবেশ করেন ১৯৯০ সালে। তখন অবিভক্ত ঢাকা ছাত্রলীগের একজন নেতা ছিলেন তিনি। সেসময় দেশজুড়ে চলছিল স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন। সম্রাট রাজধানীর রমনা অঞ্চলে আন্দোলনের সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। একারণে তখন তাকে নির্যাতনসহ জেলও খাটতে হয় তাকে।

১৯৯১ সালে স্বৈরাচার এরাশাদের পতনের পর ক্ষমতায় আসে বিএনপি সরকার। সে আমলে সম্রাটের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করা হয়। এরপর ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তিনি যুবলীগের একজন প্রভাবশালী নেতা হিসেবে পরিচিতি পান।

১/১১’এর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের সময় সম্রাট যুবলীগের প্রথমসারির নেতা ছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পর নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় আসে। এরপর থেকেই রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশীল হতে থাকেন সম্রাট। দলীয়ভাবে পদোন্নতিও হয় তার। আওয়ামী লীগের বড় বড় সব অনুষ্ঠানে পরিচিত মুখ হিসেবে উপস্থিত থাকতেন সম্রাট। দলীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কর্মীদের নিয়ে শোডাউনও করতে দেখা যায় তাকে।

সম্রাটের নেতৃত্বাধীন ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগকে সেরা ঘোষণা করেন যুবলীগ বর্তমান সভাপতি মো. ওমর ফারুক।

জানা গেছে, সম্রাটের ফেনী ভ্রমণের সময় সফরসঙ্গী হিসেবে যুবলীগের আরেক নেতা আরমানুল হক আরমান তার সঙ্গে সবসময় থাকেন। তিনিও উঠে এসেছেন ফেনী থেকে।সম্রাটের আর্থিক লেনদেনগুলো করে থাকেন আরমান।

ঠিকাদার হিসেবেও পরিচিতি রয়েছে আরমানের। জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন প্রকল্পে ঠিকাদারি কাজ পাইয়ে দিতে তাকে সম্রাট সহযোগিতা করেন বলেও জনশ্রুতি আছে। এমনকি নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাকে ফেনীতে খালেদা জিয়ার পক্ষে প্রচারণা চালাতে দেখা গেছে বলে জানিয়েছেন ফেনী আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের একাধিক নেতা।

সম্রাটের বড় ভাই বাদল চৌধুরী ঢাকায় তার ক্যাসিনো ব্যবসা দেখাশোনা করতেন। ছোট ভাই রাশেদ ছাত্রলীগের রাজনীতি করেন। গেল ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার মতিঝিলে ক্লাব ব্যবসার আড়ালে অবৈধ ক্যাসিনো পরিচালনার অভিযোগে র‌্যাবের হাতে ধরা পড়েন যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। পরে ধরা পড়েন রাজধানীর টেন্ডার কিং আরেক যুবলীগ নেতা জিকে শামীমও।এ দুজনই অবৈধ আয়ের ভাগ দিতেন সম্রাটকে। তারা গ্রেফতার হওয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদে সম্রাটের অবৈধ ক্যাসিনো সাম্রাজ্য নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দেন।

টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগের কারণে যুবলীগ নেতা সম্রাটের নাম আলোচনায় আসে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর আসে, মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় যে ক’টি ক্যাসিনো চলছিল, তা থেকেও প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ চাঁদা যুবলীগ নেতা সম্রাটের কাছে যেত।

Please follow and like us:

Check Also

ঈদে স্ত্রীর জন্য মাংস কিনতে না পারায় দিনমজুর স্বামীর আত্মহত্যা

জামালপুরের বকশীগঞ্জে স্ত্রীর জন্য মাংস কিনতে না পেরে চিঠি লিখে আত্মহত্যা করেছেন হাসান আলী (২৬) …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।