রোহিঙ্গা গণহত্যার ভিডিও, বিচার দেবে কে?

ক্রাইমবার্তা ডেস্ক রিপোট:রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা নিয়ে এই প্রথম একটি ভিডিওচিত্র পেলাম। এই ভিডিওচিত্র বিশ্ব বিবেককে কতটা নাড়া দেবে, এ নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। নাড়া দেওয়া যদি প্রতিবাদ ও নিন্দা জানানোর মধ্যে সীমিত থাকে, তাহলে নাড়া যে দেয়নি, তা বলা যাবে না। আর কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া ভিন্ন কথা। মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক উত্তরণ-প্রক্রিয়ার অর্থ এই হতে পারে না যে রাষ্ট্র হিসেবে সে কোনো গুরুতর অপরাধ করলেও তাকে দায়মুক্তি ভোগ করতে দিতেই হবে। বিশ্ব এ পর্যন্ত যা করেছে ও বলেছে, এতে মিয়ানমারের আধাসামরিক সরকার যে খুব বিচলিত বোধ করছে, এর কোনো লক্ষণ নেই।22

রোম সংবিধির আওতায় আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত (আইসিসি) করা হয়েছিল ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত রাষ্ট্রের বিচার করার জন্য। মিয়ানমার আইসিসির সদস্যরাষ্ট্র নয়। কিন্তু তাকে বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব। ২০০৮ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সংসদ বন্যাদুর্গত মানুষকে ত্রাণ দিতে বিদেশিদের ঢুকতে না দেওয়ার কারণে মিয়ানমারকে আইসিসির কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর সপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। তখন একজন জেনারেল প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এখন সে পরিস্থিতি নেই। কিন্তু এবারের অভিযোগ অত্যন্ত গুরুতর এবং এখন তার অকাট্য প্রমাণ মিলছে। এটা অবাক করা বিষয় যে, ইইউর মুখপাত্র এখন এক বিবৃতিতে রাখাইন রাজ্যের সহিংসতার তদন্তে মিয়ানমার সরকারের তদন্ত কমিটি গঠনের পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে ওই বিবৃতি এটাও বলেছে, রাখাইনে মানবাধিকার পরিস্থিতির গুরুতর অবনতি ঘটেছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও গোষ্ঠী একজন সাবেক জেনারেলের নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিটি কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে, এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে। কিন্তু এটা তাঁকে বিচলিত করছে না।
যুক্তরাজ্যের দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট পত্রিকায় প্রকাশিত প্রায় ৫ সেকেন্ডের একটি ভিডিও সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, সারি সারি লাশ পড়ে আছে। ওসমান গনি নামের একজন শিক্ষক তাঁর মুঠোফোনে ওই ভিডিওটি ধারণ করেছেন। ওসমানের দাবি, তাঁর ভিডিওচিত্রটি ৩০০ মানুষকে হত্যার সাক্ষ্য বহন করছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী তাদের হত্যা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ওই শিক্ষক আরও যে অভিযোগটি করেছেন তা সত্য হলে বিষয়টি স্মরণকালের ইতিহাসে গণহত্যার ইতিহাসে অধিকতর বর্বরতা দেখানোর ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যুক্ত করবে। ওই শিক্ষক আন্তর্জাতিক মিডিয়ার কাছে দাবি করেছেন, বহু রোহিঙ্গাকে হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছুড়ে হত্যা করার পরে লাশ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এ পর্যন্ত যেসব স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণ করেছে, এতে দেখা যায়, গত নভেম্বরে রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলোতে ১ হাজার ২৫০টি অবকাঠামো ধূলিসাৎ করা হয়েছে। মিয়ানমারের নোবেলজয়ী ‘গণতন্ত্রকন্যা’ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তাঁর দেশকে অপবাদ দেওয়ার জন্য দোষারোপ করেছেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত হবে বিষয়টিকে কেবল পাল্টাপাল্টি বিবৃতি ও তদন্ত চালানোর মধ্যে সীমিত না রাখা। বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে তুলে ধরতে হবে। মিয়ানমারের সুপ্রিম কোর্ট বা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়ে সেখানকার নাগরিকদের যে আস্থা রয়েছে, এটা ধরে নেওয়ার কোনো যৌক্তিক কারণ দেখি না। আর গণহত্যা বা এথনিক ক্লিনজিং যা-ই বলা হোক না কেন, আসলে কোনটি সত্য, তা বিতর্কের বিষয়।
মিয়ানমারে কোনো গণমাধ্যম বা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। আর মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ বিশ্ববাসীর আস্থা অর্জনে এ পর্যন্ত যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তা যথেষ্ট নয়। বিচারব্যবস্থা ও স্বচ্ছতা নিয়ে দেশটির আচার-আচরণ এখনো সামরিক ঘেঁষা রয়ে গেছে। সেটা থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। সারা বিশ্ব যেখানে নিন্দায় উচ্চকিত, সেখানে তারা নিজ থেকে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের দরকার মনে করেনি। সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতিকে দিয়ে তদন্ত করানোর চেয়ে তারা একজন সাবেক জেনারেলকে দিয়ে তদন্ত করাকে সমীচীন ভেবেছে।
এ সপ্তাহে তারা ইন্দোনেশিয়াকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। মিয়ানমার আশা করছে, জাকার্তার প্রতিনিধিদল সরেজমিনে পরিস্থিতি দেখে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে বিশ্বকে খোলাখুলি মত দেবে। তবে ইন্দোনেশিয়ার বিশিষ্ট ইসলামি নেতা দীন সামশুদ্দীন রোহিঙ্গাদের বাঁচাতে ওআইসি এবং আসিয়ানের মাধ্যমে উদ্যোগ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধন সংঘটনের প্রতিবাদে কুয়ালালামপুরে এক শোভাযাত্রায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্টকেও রাজধানী জাকার্তায় অনুরূপ শোভাযাত্রা বের করার পরামর্শ দিয়েছেন। যদিও নাজিব রাজাকের শোভাযাত্রা তাদের আসন্ন নির্বাচনের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে সমালোচনা আছে। তবে এ নিয়ে বিতর্ক সামান্য যে, সেখানে যা ঘটে গেছে তা গণহত্যা ধরনের কিছু। প্রশ্ন হলো, বিশ্ব সংঘ হিসেবে জাতিসংঘ কী করবে?
ইইউ, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীনসহ ১০ দেশের রাষ্ট্রদূতদের সামরিক হেলিকপ্টারে এবং নিবিড় নজরদারিতে রাখাইন দেখিয়ে আনার মধ্য দিয়ে কি কোনো উন্নতি ঘটেছে? এসব দেশ বলেনি, মিডিয়া ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো যা বলছে তা ঠিক নয়। কিন্তু তাতে লাভ কী? তারা যথারীতি নীরব থেকেছে আর এতে লাভ হচ্ছে মিয়ানমারের। রোহিঙ্গাদের বিষয়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে পদ্ধতিগত নিপীড়ন বন্ধে গত বছরই সাত নোবেলজয়ী বিবৃতি দিয়েছিলেন। সু চি একজন নোবেলজয়ী হয়ে উদ্বেগ প্রশমনে তাঁদের রাখাইনে আমন্ত্রণ জানাতে অপারগ থাকছেন। আমরা বিশ্বাস করি, সু চির হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটছে। কিন্তু তিনি তাঁর দেশের বিরাজমান পরিস্থিতিতে বৃহত্তর স্বার্থে হয়তো সরব হতে পারছেন না। তাঁকে তৃতীয় বিশ্বের কোনো এক আটপৌরে নেতা-নেত্রীর মতোই সত্যকে লুকানো চেষ্টা করতে দেখা গেছে।
সুতরাং এখন দরকার নতুন ও অকাট্য সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে আইসিসির কাঠগড়ায় মিয়ানমারকে দাঁড় করানো। সু চিকে ডি ফ্যাক্টো বলা হলেও সামরিক বাহিনীর কাঠামো কিন্তু তা সমর্থন করে না। সুতরাং আইসিসিতে অং সান সু চি যাবেন না। যাবেন প্রকৃত সামরিক শাসক, যাঁদের হুকুমে গণহত্যা বা অ্যাটেম্পটেড জেনোসাইডের ঘটনা ঘটেছে। আমরা বিশ্বাস করি, বর্মি গণতন্ত্রকন্যা হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালিয়ে গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংস এবং নারী ও শিশুদের পাইকারি হত্যার নির্দেশ দেননি। এটা তাঁর অজ্ঞাতসারে ঘটেছে কিন্তু এখন তাঁকে তার দায় বহন করতে হচ্ছে। আমাদের এই বিশ্বাস কখনো ভুল প্রমাণিত হলে আমরা বেদনায় নীল হব।
২০১৩ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে জাতিসংঘের মানবাধিকার-বিষয়ক হাইকমিশনার নাভি পিল্লাইয়ের মুখপাত্র রুপার্ট কোলভিল জেনেভা থেকে আমাদের একটি সাক্ষাৎকার দেন। তিনি বলেছিলেন, ফৌজদারি অপরাধের দায় থেকে ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপ্রধান, সাংসদ, জনপ্রতিনিধি বা উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের কেউই শুধু পদমর্যাদার কারণে রেহাই পেতে পারেন না।
রোম সংবিধির ২৭ অনুচ্ছেদ বলেছে, সরকারি পদমর্যাদায় একজন ব্যক্তি রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান, কোনো সরকার কিংবা সংসদের সদস্য, একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি কিংবা একজন সরকারি কর্মকর্তা যা-ই হোন, সংবিধির আওতায় ফৌজদারি দায়দায়িত্ব থেকে কোনোভাবেই তিনি রেহাই পেতে পারেন না। জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে যদি দায়মুক্তি নিশ্চিত করাও থাকে, তাহলেও আইসিসি তার এখতিয়ার খাটাতে পারবে।
১০ দেশে আইসিসি এ পর্যন্ত প্রাথমিক তদন্ত করছে। আরও ১০টি দেশের ওপর তদন্ত চলমান রয়েছে। ৫টি দেশের বিচার চলছে। মামলা হয়েছে ২৬টি। ৯ জন দোষী সাব্যস্ত ও ১ জন খালাসও পেয়েছেন। সুতরাং সু চির কথামতে, রাখাইনে ‘আইনের শাসন’ চললে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা ছাড়া পাবেন। সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, আইভরি কোস্ট, কঙ্গো, মালি ও উগান্ডা নিজেরাই তাদের মামলাগুলো আইসিসিতে পাঠিয়েছে। আর লিবিয়া ও সুদানের ক্ষেত্রে প্রস্তাব পাস হয়েছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে। সবার চোখের সামনে, যে যুগে নাগরিকেরা নিজেরাই একজন করে ভার্চ্যুয়াল তদন্ত কমিটি হতে পারে। যখন জীবন্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ চোখের সামনে ভেসে বেড়ায়, তখন তদন্ত কমিটির নামে কালক্ষেপণ করতে দেওয়া কেন। মিয়ানমারকে আইসিসিতে দাঁড় করানো যতটা না জরুরি, রোহিঙ্গাদের স্বার্থে, তার থেকে বেশি বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটির জন্য আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের অলিন্দ খুলে দেওয়ার জন্য। বর্মি শাসকদের যাঁরাই এই ঘৃণ্য অপরাধ করেছেন, তাঁদের বিচারে নিরাপত্তা পরিষদ সরব না হলে তাঁরা বৈষম্যমূলক আচরণ করবেন বলেই গণ্য হবে।
কঙ্গোর বিদ্রোহী নেতা টমাস লুবাঙ্গা আইসিসিতে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ বহুসংখ্যক ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে বর্তমানে কয়েকজনের বিচার চলছে। গিনি ও হন্ডুরাসের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আইসিসির প্রসিকিউটর দ্বারা প্রাথমিক পরীক্ষা চলেছে। এসবই আমরা দেখেছি ও দেখছি। কিন্তু রোহিঙ্গাদের নির্মূল করার যে দৃশ্যমান পরিকল্পনা আমরা দেখছি, তা বন্ধ না হলে বিশ্বকে আরও বেশি উগ্রপন্থার দিকে ঠেলে দিতে পারে।

Check Also

মালয়েশিয়ার পাম তেলে ইইউ’র নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের শ্রমবাজারে অশনি সংকেত

বন উজাড়, কার্বন নির্গমনের ঝুঁকি এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্টগত কারণ দেখিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়ার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।