অপমানিত কিশোরীর ছবি’ ফেসবুকে, পরে আত্মহত্যা # কলারোয়ায় পুলিশ-জনপ্রতিনিধি মুখোমুখি # জড়িত অভিযোগে আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক সহ গ্রেপ্তার ৪

বেঁধে ইউপি কার্যালয়ে নিয়ে পেটায় চেয়ারম্যান
ক্রাইমবার্তা রিপোট:সাতক্ষীরার কলারোয়া ফিরেঃ সালিসের নামে মারধর ও ছবি ফেসবুকে দেয়ার ঘটনায় অপমান সইতে না পেরে এক কিশোরীর আতœহত্যা। এ ঘটনায় উত্তাল এখন সাতক্ষীরা। আন্তজার্তিক গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে বিষয়টি।আর ফেসবুক ব্যবহারকারী মেয়েটির সেই দুর্গতির ছবি তুলে ফেসবুকে প্রকাশ করেছেন।এ ঘটনার পরদিনই আত্মহত্যা করে ষোল বছর বয়সী দরিদ্র কিশোরীটি। আফরোজার পিতা নেই, অত্যন্ত দরিদ্র তার পরিবার, সেখানে তার মা ও এক ভাই আছে। দুজনকেই কাজ করতে হয় সংসার চালানোর জন্য।
এঘটনায় পুলিশ ও স্থানীয় সরকার দলী লোকজন মারমুখি অবস্থানে। পুলিশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে স্থানীয় আ’লীগ। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় পুলিশ স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানসহ চার জনকে গ্রেপ্তার করেছে। ঘটনাটি সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার সোনাবাড়িয়া ইউনিয়নের।22
মনিরুল ইসলাম সোনাবাড়িয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। গ্রেপ্তার হওয়া অন্য ব্যক্তিরা হলেন চৌকিদার ইসমাইল হোসেন, জয়দেব কুমার দাশ ও মুঠোফোন রিচার্জ ব্যবসায়ী হাসান আলী।
সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলায় তরুণ-তরুণীকে বেঁধে ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে নিয়ে পেটানোর পর মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে বলে অভিযোগ উঠে।
আত্মহত্যা করা মেয়েটির নাম আফরোজা খাতুন (১৬)। সে সোনাবাড়িয়া গ্রামের নূর আহম্মদের মেয়ে। আফরোজার ভগ্নিপতি আরিফুল ইসলাম বলেন, আফরোজা মুঠোফোন রিচার্জ করতে শুক্রবার দুপুরে সোনাবাড়িয়া বাজারের একটি দোকানে গেলে স্থানীয় ছাত্রলীগের লোকজন তাকেসহ অপর এক তরুণকে আটক করে তাদের মধ্যে সম্পর্কের অভিযোগ তোলে। তাদের দুজনকে ওই দোকানে আটকে রেখে ইউপি চেয়ারম্যানকে খবর দেয় লোকজন। চৌকিদার ইসমাইল হোসেন অন্যদের সহায়তায় তাদের দুজনকে পিছমোড়া করে বেঁধে ইউপি কার্যালয়ে নিয়ে যান। সেখানে চেয়ারম্যান ও অন্যরা লাঠি দিয়ে ছেলেটিকে পেটান এবং মেয়েটিকে চড়-থাপ্পড় মারেন। পরে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
আরিফুল বলেন, ক্ষোভে ও লজ্জায় শনিবার দুপুরে আফরোজা গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে। এ ঘটনায় ওই দিন সন্ধ্যায় আফরোজার ভাই ইব্রাহিম খলিল ইউপি চেয়ারম্যানসহ সাতজনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন।
অভিযোগের বিষয়ে চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম বলেন, চৌকিদার ইসমাইল হোসেনসহ কয়েকজন একটি ছেলে ও একটি মেয়েকে তাঁর কাছে নিয়ে আসেন। তিনি তাদের বকাবকি করে ছেড়ে দেন।
তবে চৌকিদার ইসমাইল হোসেন বলেন, ঘটনা জানার পর চেয়ারম্যান তাঁকে ছেলে ও মেয়েটিকে বেঁধে নিয়ে আসতে বলেন। ইউনিয়ন পরিষদে নিয়ে আসার পর চেয়ারম্যান তাদের মারধর করে ছেড়ে দেন।
কলারোয়া থানার ওসি এমদাদুল হক শেখ বলেন, মামলার পর চারজনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে।
কলারোয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এমদাদুল হক শেখ বলেন, আপত্তিকর সম্পর্কের অভিযোগ তুলে গত শুক্রবার সোনাবাড়িয়া ইউনিয়নের আফরোজা খাতুন (১৬) নামের এক কিশোরী ও এক কিশোরকে আটক করে দড়ি দিয়ে বেঁধে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান এস এম মনিরুল ইসলামের কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সালিসের নামে চেয়ারম্যান তাদের বকাবকি ও মারধর করেন। এই অপমান সহ্য করতে না পেরে শনিবার কিশোরীটি আত্মহত্যা করে। এ ঘটনায় ওই দিনই কিশোরীর ভাই ইব্রাহিম খলিল বাদী হয়ে সাতজনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন ।
কিশোরীর ভগ্নিপতি আরিফুল ইসলাম আরো জানান, তাঁর শ্যালিকা আফরোজা শুক্রবার বিকেলে সোনাবাড়িয়া বাজারের একটি দোকানে ফ্ল্যাক্সিলোড করতে যায়। এ সময় স্থানীয়রা আরেকটি ছেলেসহ কিশোরীটিকে আটক করে আপত্তিকর সম্পর্কের অভিযোগ তোলে। পরে তাদের বেঁধে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে নিয়ে গেলে চেয়ারম্যান দুজনকে মারধর করে ছেড়ে দেন। পরের দিন শনিবার দুপুর ১২টার দিকে তাঁর শ্যালিকা আত্মহত্যা করে।
তবে সোনাবাড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম তাঁর বিরুদ্ধে আনা মারধর করার অভিযোগ অস্বীকার করেন। তাঁর দাবি, স্থানীয় চৌকিদার ইসমাইল হোসেনসহ কয়েকজন এক ছেলে ও এক মেয়েকে তাঁর কাছে নিয়ে আসে। তিনি তাদের বকাবকি করে ছেড়ে দেন।
আর চৌকিদার ইসমাইল হোসেনের ভাষ্য, আপত্তিকর সম্পর্কের ঘটনাটি জানানোর পর স্থানীয় চেয়ারম্যান তাঁকে ছেলে ও মেয়েটিকে বেঁধে তাঁর কাছে নিয়ে যেতে বলেন। ছেলে-মেয়ে দুটিকে ইউপি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়ার পর চেয়ারম্যান ছেলেটিকে মারধর করেন আর মেয়েটিকে বকাবকি করে ছেড়ে দেন।
ওদিকে ইউপি চেয়ারম্যান, দুজনকে মারধর করেন, পলাশকে জরিমানা করেন এবং মেয়েটিকে ছেড়ে দেন। এই ঘটনার পর থেকেই আফরোজা মুষড়ে পড়ে বলে জানান তার মা আনোয়ারা খাতুন।
চেয়ারম্যানের ওই শালিসে উপস্থিত ছিলেন এমন দুএকজনের সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করলে তারা বক্তব্য দিতে অস্বীকৃতি জানান।
স্থানীয় সাংবাদিকরা বলছেন, ঘটনাটির সাথে স্থানীয় চেয়ারম্যানের নাম জড়িয়ে থাকায় কেউ কোন কথাবার্তা বলতে চাইছে না।
কলারোয়ার সাংবাদিক পলাশ চৌধুরী জানাচ্ছেন, প্রতি শুক্রবার ও শনিবার সোনাবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদে বিভিন্ন অভিযোগের শালিস মিমাংসা করেন চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম।
এসব শালিসের কার্যপ্রনালী নথিভূক্ত করবার নিয়ম থাকলেও আফরোজা খাতুনের ওই শালিসটির ক্ষেত্রে তা হয় নি।
সোনাবাড়িয়া গ্রামের আফরোজা খাতুনের পরিবারের সদস্যরা জানান, আফরোজা খাতুন নিজ বাড়িতে দর্জির কাজ করতেন। গত শুক্রবার দুপুরে কাজের ফাঁকে বাড়ির পাশে সোনাবাড়িয়ায় হাসানের দোকানে যান মোবাইল ফোনে রিচার্জ করতে। তাঁরা জানান, এ সময় পলাশ নামের এক যুবক আসে হাসানের কাছে তার পাওনা টাকা নিতে। এ সময় পলাশ ও আফরোজাকে একটি ঘরে ঢুকিয়ে দেয় হাসান ও তার বন্ধু হাফিজ। এ সময় বাইরে থেকে দরজা আটকে দেয় তারা। পরে চিৎকার দিয়ে লোক জড়ো করা হয়।
পরিবারের সদস্যরা আরো জানান, বিষয়টি ইউপি চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলামকে টেলিফোনে জানানো হয়। চেয়ারম্যান পলাশ ও আফরোজাকে ধরে আনতে বলেন। হাসান ও হাফিজ দুজনকে বেঁধে নিয়ে যায় ইউনিয়ন পরিষদে।
পরিবারের সদস্যরা আরো জানান, এরপর বিচারের নামে মেয়েটিকে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করেন চেয়ারম্যান মনিরুল। তিনি তাঁর গায়ে হাত তোলেন। বলেন, ‘তুই তো আমার মতো মানুষের সাথে প্রেম করবি। ওর সাথে গেলি কেন?’ আফরোজা চেয়ারম্যানকে জানায়, সে কারো সঙ্গে অসামাজিক কাজে লিপ্ত হয়নি। একপর্যায়ে মীমাংসা করে দেওয়ার কথা বলেন চেয়ারম্যান মনিরুল। এ জন্য পলাশের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ আদায় করে তাঁকে নির্দোষ বলে ছেড়ে দেন। আর আফরোজাকে নানাভাবে অপমানিত করে মারধর করে বাড়ি পাঠিয়ে দেন চেয়ারম্যান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আফরোজার চাচা দীন মোহাম্মদ, আবদুল হাকিম ও আবদুর রাজ্জাক আফরোজাকে ফের মারধর করেন।
মনিরুল সোনাবাড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান হয়েছেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়।
কলারোয়া উপজেলা চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমেদ স্বপন জানান, ইউপি চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম সম্পূর্ণ ষড়যন্ত্রের শিকার। সম্প্রতি কলারোয়ায় পুলিশের নামে চাদাবাজির অভিযোগে সোনাবাড়িয়ায় সর্বস্তরের জনসাধারণের এক সমাবেশ হয়। এই সমাবেশে স্থানীয় সংসদ সদস্য, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাধারণ সম্পাদক, চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলামসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। একারণেই পুলিশ অতিউৎসাহী হয়ে তাকে এই মামলায় আসামী করে গ্রেপ্তার করেছে।
তালা-কলারোয়ায় সংসদ সদস্য এড. এুস্তফা লুৎফুল্লাহ বলেন, চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলামকে যে মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে মো. ইব্রাহিম খলিলের দায়ের করা ওই মামলার এজাহারেই তাকে আসামী করার মত তেমন কোন উপাদান নেই। তারপরও তাকে সম্পূর্ণ হয়রানী করতেই আসামী করা হয়েছে এবং গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এদিকে সোনাবাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এসএম মনিরুল ইসলামকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে রোববার কলারোয়ায় প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

Please follow and like us:

Check Also

কলারোয়া  উপজেলা জামায়াতের প্রথম সভাপতি আবুল কাশেমের ইন্তেকালঃ বঙ্গবন্ধু বিশেষ সুপারিশে  যিনি কারা মুক্ত হন

সাতক্ষীরা সংবাদদাতাঃ কলারোয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান, উপজেলা জামায়াতের প্রথম সভাপতি বাংলাদেশ পরিবহন মালিক সমিতির …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।