খালের মাটি না কেটে শুধু ছাটাই করেই বিল উত্তোলন ঝালকাঠিতে ক্ষুদ্রাকার পানি সম্পদ সেক্টর প্রকল্পের খাল খননে দুর্নীতি-লুটপাট, তদন্তের দাবি এলাকাবাসীর

ক্রাইমবার্তা রিপোট:রহিম রেজা, রাজাপুর (ঝালকাঠি) প্রতিনিধি14
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও ইফাদের অর্থায়নে অংশগ্রহন মূলক ক্ষুদ্রাকার পানি সম্পদ সেক্টর প্রকল্পের আওতায় ঝালকাঠিতে মোট ৩ পর্যায়ে আনুমানিক ৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। প্রতিটি পর্যায়ের কাজে ব্যাপক দূর্নীতি ও লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। আগামী ৩০ মার্চের মধ্যে তৃতীয় পর্যায়ের সকল কাজ সম্পাদন করে খালের পরিমাপ করার নির্দেশনা থাকলেও অধিকাংশ প্রকল্পের কাজে এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন হয়নি। ২০১০ সাল থেকে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের মেয়াদ চলতি বছরের জুন মাসে শেষ হবার কথা রয়েছে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল (এলজিইডি) ইউনিয়ন পর্যায়ে পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতির মাধ্যমে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ঝালকাঠি এলজিইডি সূত্রে জানাযায়, প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে জেলা সদরের কেওড়া, কীর্ত্তিপাশা, বিনয়কাঠি ইউনিয়নে, রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া ইউনিয়নে, নলছিটি উপজেলার দপদপিয়া, কুশাঙ্গল, রানপাশা ও মোল্লারহাট ইউনিয়নে প্রকল্পের কাজ গুলো বাস্তবায়ন হয়। ইতিমধ্যেই কেওড়া ইউনিয়নের সারেংগল পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতির এ কাজে ব্যাপক অণিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এলাকাবাসি জানিয়েছে এ সমিতির সভাপতি শেখ মো. মজিবুর রহমান তার সমিতি সংলগ্ন একটি খালসহ অধিকাংশ খাল না কেটেই বিল উত্তোলন করেন। কেওড়ার মেম্বর উজ্জল জানান, এই খাল কাটার এলসিএস কমিটির অনেকের কাছ থেকে অগ্রিম চেকে স্বাক্ষর নেয়া হয়েছে। ভয়ে কেহ প্রতিবাদ করতে সাহষ পায়নি। এভাবে প্রথম দ্বিতীয় পর্যায় কাজের দুর্নীতির তদন্ত হলেই থলের বিড়াল বেড়িয়ে আসবে বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। এলাকাবাসি জানায় নির্দেশনা অনুযায়ী খাল কাটা মাটি কোথায় রাখা হয়েছে তা তদন্ত হলেই দুর্নীতির প্রমান পাওয়া যাবে। এই প্রকল্পের প্রকল্প সহায়তাকারি মো. দেলোয়ার হোসেন জানান, তৃতীয় পর্যায়ে ১৭টি প্রকল্পে ৩টি ইউনিয়নে মোট ২৬ কিলোমিটার খাল কাটার জন্য ১ কোটি ৯২ লাখ ৮৭ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি রক্ষনাবেক্ষনের জন্য অতিরিক্ত আরো ২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। সদর উপজেলার বিনয়কাঠি, কীর্ত্তিপাশা ও রাজাপুরের সাতুরিয়া ইউনিয়নে ১৭টি প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নাধীন। ১৪ টি প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এরমধ্যে ৩ টি প্রকল্পের কাজ এখনো শেষ হয়নি। এরমধ্যে সদর উপজেলার বিনয়কাঠি ইউনিয়নে ৬টি খালে ৭ কিলোমিটার খনন করতে ৮৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের ৮০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কীর্ত্তিপাশা ইউনিয়নের ৬টি খালে ১১ কিলো মিটার খনন করতে ৫৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এই কাজে ২০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। রাজাপুরের সাতুরিয়া ইউনিয়নে ৪টি খালে ৮ কিলোমিটার খনন কাজে ৫৪ লাখ ৮৭ হাজার টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এই কাজের অগ্রগতি ৩০ ভাগ। প্রকল্পের নির্দেশনানুযায়ী জানা গেছে, এ প্রকল্পের সার্বিক উদ্দেশ্য হচ্ছে টেকসই কৃষি ও মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে সরকারের দারিদ্র হ্রাসকরণ উদ্যোগকে সহায়তা করা। দরিদ্র জনগোষ্ঠিকে বিশেষ বিবেচনায় রেখে ইউনিয়ন পর্যায়ের উপপ্রকল্প এলাকার সকল শ্রেনী ও পেশার জনগণের দ্বারা এই প্রকল্প পরিচালিত হবে। একটি টেকসই ক্ষুদ্রাকার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রচলন করাই হচ্ছে এ প্রকল্পের লক্ষ্য। কিন্তু সঠিক ভাবে এ কাজের তদারকী না হওয়ায় এবং কাজ সম্পাদন না করে লুটপাটের কারনে সরকারের অগ্রাধিকার ভিত্তিক এ প্রকল্পটি ভেস্তে যেতে বসেছে। নীতিমালা অনুযায়ী প্রতিটি প্রকল্প ইউনিয়ন ভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি বাস্তবায়ন করছে। এই সমতির আওতায় কর্মএলাকার হতদরিদ্রদের নিয়ে ২৫ জন করে একাধিক এলসিএস কমিটি মাঠ পর্যায়ে খাল খনন করবে। কিন্তু বাস্তবের সাথে কোন মিল নেই। সম্প্রতি তৃতীয় কিস্তির ১৭ টির অধিকাংশ প্রকল্প সরেজমিনে অনুসন্ধানে দূর্নীতির চিত্র উঠেছে এসেছে। গত ১৬ এপ্রিল বিনয়কাঠি ইউনিয়নে গিয়ে দেখাযায় কাগজে কলমে থাকলেও বাস্তবে সমিতির অফিস বা সাইনবোর্ড বলতে কিছুই নেই। প্রকল্পের অধিকাংশ খাল গুলোই না কেটে পাড় ছেটে সৌন্দর্য্য বর্ধণ করা হয়েছে। আসছে আগামী জুনে বিল পাবার আশায় এমন ভাবে পাড় ছেটেছে দেখলে মনে হয় খাল কেটে চওড়া করা হয়েছে। এসব সমিতির সভাপতিরা শতভাগ কাজ সম্পাদনের দাবি করলেও বাস্তবে দুপাড়ে মাটির কোন অস্তিত্ব নেই। দেখা যায় জেলার বাহিরের কিছু শ্রমিক খালের নরম মাটি তুলে পাড়ে উঠিয়ে রেখে খাল কাটার দাবি করছে। প্রকল্পের নীতিমালা অনুযায়ী এলাকার হতদরিদ্রদের নিয়ে খাল কাটার কথা। কিন্তু সমিতির সভাপতি সম্পাদকরা যশোর, ঝিনাইদাহ, সাতক্ষিরা থেকে আনা শ্রমিকদের দিয়ে চুক্তিতে কিছু অংশে নামমাত্র কাজ করাতে দেখা গেছে। এতে একদিকে এলাকার শ্রমিকরা বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে পানির চাপ বেশি থাকায় খালে দ্রুত পানি উঠে ভরে যাচ্ছে। এ সুযোগে খাল কাটার কাজ সম্পাদন দেখিয়ে এলজিইডির অসাধু কর্মকর্তাদের সহায়তায় সমিতির কর্তাব্যাক্তিরা বরাদ্দ টাকা উত্তোলন ও ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। এবিষয়ে বিনয়কাঠির বহরমপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা একরাম আলী মৃধা বলেন, আমরা এলাকাবাসি জানতে চেয়েছি এ কাজে কত টাকা বরাদ্দ, কি জন্য এ কাজ করা হচ্ছে। এর উত্তরে কমিটির লোকজন বলেছে, আপনাদের জমি আবাদের জন্য সেচ সুবিধা দিতে খাল কাটা হচ্ছে। এ জন্য উপর থেকে খাইতে খাইতে এখন লামছাম কিছু টাকা আইছে। তা দিয়েই যে টুকু কাজ হয়। এতে বাঁধা বিঘœ করলে আপনাগো খাল হবেনা। এ মুক্তিযোদ্ধা প্রশ্ন রেখে বলেন, সরকারের প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষক ও কৃষি কাজের সুবিধার্থে এ অর্থ বরাদ্দ দিলেও এভাবে লুটপাট হলে দেশের উন্নতি কেমনে হইবে। শুনেছি এ ইউনিয়নে ৭ কিলোমিটার খাল খননের কথা থাকলেও বাস্তবে খাল কাটাই হয়নি। কিছু নরম কাঁদা মাটি উঠিয়ে পাড় ছাটাই করা হযেছে। একই গ্রামের নুরমোহাম্মদ বলেন সরকারি এ টাকায় খাল কাটা হচ্ছেনা। হচ্ছে পকেট ভর্তি আর লুটপাট। অর্থ লুটপাট করতেই পানির চাপ থাকা সত্বেও দায়সারা কাজ দেখিয়ে বরাদ্দ টাকা খেয়ে ফেলা হয়েছে। এক পর্যায়ে গ্রামের এক যুবক খালে নেমে পায়ে হেটে দেখিয়ে বলে খাল খননে কোন গভীরতা করা হয়নি। সাতক্ষীরার মাটি কাটার শ্রমিক হাসেম আলী বলেন, আমাদের ৩০ জন শ্রমিককে চুক্তিতে সমিতির লোকজন মাটিকাটার জন্য নিয়ে এসেছে। এজন্য প্রতিদিন জনপ্রতি ৪২০ থেকে ৪৫০ টাকা মজুরি দেয়া হয়। এ বিষয়ে আশিয়ার মুরাসাতা পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতির সভাপতি সৈয়দ জাকির হোসন জানান, আমাদের ৯০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আমরা ডিজাইন অনুযায়ী কাজ করেছি। আমাদের কাজ এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলীসহ স্থানীয় নির্বাহী প্রকৌশলী এবং সংশ্লিষ্ট সবাই দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, প্রকল্পের ডিজাইনে আছে পুরাতন খালে গভীর ৩ ফিট থেকে ৩.৫ ফিট করতে হবে। আর নীচের বেড হবে ৬ ফিট থেকে ৯.৫ ফিট। আমরা সেই ভাবেই কাজ করেছি। এলাকাবাসির অভিযোগ সঠিক নয়। গত ১৭ এপ্রিল কীর্ত্তিপাশা ইউনিয়নে গিয়ে একই চিত্র দেখা যায়। এ ইউনিয়নে ১০ ভাগ কাজও সম্পন্ন হয়নি। হিন্দু অদ্যুষীত এলাকাটিতে পেয়ারা ও সবজির ব্যাপক ফলন হয়। তাই এ প্রকল্পটি কৃষি আবাদে সেচের জন্য গুরত্বপূর্ণ বহন করে। কিন্তু খাল কাটর নামে প্রহসন হওয়ায় এলাকার কৃষকরা ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করে। কীর্ত্তিপাশা সদরের পেয়ার চাষী সমিরণ সরকার বলেন, খাল কাটার এই কার্যক্রমে কৃষক ও মৎস্যজীবীদের যে উপকারে আসবে তা না আসার কারন হলো খালের নীচে কোন ঠাই না করে দুপাশ ছাটার কারনে এই খাল জনগনের কোন উপকারে আসবেনা। যারা এ কাজের টেন্ডার পাইছে তাদেরই পকেট ভরবে। অন্য এক কৃষক সুখরঞ্জণ বলেন, যারা খাল কাটায় হেগই পেট ভরবে জনগনের কোন উপকার অইবেনা। এ বিষয়ে কীর্ত্তিপাশা ইউনিয়নের পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতির কার্যালয়ে গিয়ে কাউকে খুজে পাওয়া যায়নি। অফিস ছিল তালাবদ্ধ। তিন পর্যায়ে খালকাটা প্রকল্পের মধ্য থেকে শ্রেষ্ঠ সমবায়ী হতে যাচ্ছেন সারেংগল পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতির সভাপতি শেখ মজিবুর রহমান। নাম প্রকাশ প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক এলসিএস কমিটির সভাপতি ও সদস্যরা জানায়, তাদের কাছ থেকে সমিতি অগ্রিম চেকে স্বাক্ষর করিয়ে নিয়েছে। তাই এ কাজের বিল কখন কিভাবে উঠানো হয়েছে তা আমদের জানা নেই। আমারা কাগজে কলমেই এ কমিটির সভাপতি সদস্য। চলতি বছরে বর্ষা ও পানির চাপ বেশি থাকার সুযোগটি সমিতর নেতারা ভালভাবেই কাজে লাগাচ্ছে। ৩০ মার্চ কাজ সমাপ্তির কথা থাকলেও অধিকাংশ প্রকল্পেরই কাজ ডিজাইন অনুযায়ী সমাপ্তি হয়নি। এ বিষয়ে ঝালকাঠি এলজিইডি নির্বাহী প্রকৌশলী সেলিম সরকার জানান, তিন পর্যায়ে ৩৪ টি প্রকল্পে প্রায় ৩০ কোটি টাকা ৫১০ কিলো মিটার খাল খনন করা হয়েছে। ৩টি প্রকল্পবাদে অধিকাংশ কাজই সমাপ্তির পথে। বাহির থেকে শ্রমিক আনার বিষয়ে তিনি বলেন, এ জেলার বাহির থেকে শ্রমিক আনার কোন সুযোগ নেই। যদি এলাকাবাসি অভিযোগ করে তাহলে আইনানুগ ব্যবস্থা নিব। অফিসে কমিশন নেয়ার প্রসঙ্গে তিনি জানান, এ বিষয়ে আমার জানা নেই। পানির চাপ থাকায় কি ভাবে খালের মাটি কাটার পরিমাপ করবেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, পানির চাপ না কমলে পরিমাপ করা সম্ভব নয়। এলসিএস কমিটির সভাপতি সদস্যদের কাছ থেকে অগ্রীম চেকে স্বাক্ষর নেয়ার বিষয়ে তারা অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেব।

Please follow and like us:

Check Also

রাজাপুর আল- হেরা জামে মসজিদের কমিটি গঠন

সাদী হাসান, চাম্পাফুল প্রতিনিধিঃ কালীগঞ্জ উপজেলা রাজাপুর আল- হেরা জামে মসজিদে নতুন কমিটি গঠন করা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।