ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন পরিবারতন্ত্রের শেষ পেরেক ব্যাংকিং খাতে এক পরিবার থেকে ৪ পরিচালক, মেয়াদ ৯ বছর * কতিপয় ব্যবসায়ীর চাপের কাছে সরকারের নতিস্বীকার

মনির হোসেন ও হামিদ বিশ্বাস

প্রকাশ : ০৯ মে

অ-অ+

পরিচালকদের নজিরবিহীন সুযোগ দিয়ে ব্যাংক কোম্পানি আইন আবারও সংশোধন করছে সরকার। সংশোধনী কার্যকর হলে যে কোনো বেসরকারি ব্যাংকে এক পরিবার থেকে চারজন পরিচালক হতে পারবেন। পরিচালক পদের সময়কাল হবে তিন মেয়াদে টানা নয় বছর। কেউ চাইলে তিন বছর বিরতি দিয়ে আমৃত্যু পরিচালক পদে থাকতে পারবেন। সরকারি এ সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করছেন অর্থনীতিবিদ ও অভিজ্ঞ ব্যাংকাররা। তাদের মতে, এ সিদ্ধান্ত অসুস্থ রাজনীতির বহিঃপ্রকাশ। দুর্বৃত্তদের অর্থনীতি দিয়ে রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে এটা তারই প্রমাণ। এ সিদ্ধান্তের ফলে ব্যাংকে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। বাড়বে কুঋণ। বিশৃংখল হবে পুরো ব্যাংকিং খাত। সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

সোমবার সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার সাপ্তাহিক বৈঠকে ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ সংশোধিত ২০১৭’র খসড়া নীতিগত অনুমোদন দেয়া হয়। সংশোধিত আইনে কোনো ব্যাংকে একই পরিবারের পরিচালক সংখ্যা ২ জন থেকে বাড়িয়ে ৪ জন করা হয়েছে। এটি চূড়ান্ত অনুমোদনের পর বিল আকারে জাতীয় সংসদে পেশ করা হবে। সেখানে পাস হলেই আইনটি কার্যকর হবে।

১৯৯১ সালে ব্যাংক কোম্পানি আইন পাস হওয়ার পর থেকে বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পরিচালকদের মেয়াদ সম্পর্কিত ধারাটি পাঁচবার সংশোধন করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৩ সালে ধারাটি সংশোধন করা হয়। জানা গেছে, বিদ্যমান ব্যাংক কোম্পানি আইনে ব্যাংকের পর্ষদে পরিচালকের সংখ্যা ৩ জন স্বতন্ত্র পরিচালকসহ মোট ২০ জন থাকতে পারবে। আইনটিতে এ উপধারার ব্যাখ্যা দেয়া আছে এভাবে, পরিবারের সদস্য হিসেবে স্বামী বা স্ত্রী, পিতা, মাতা, পুত্র, কন্যা, ভাই ও বোন এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল সবাই অন্তর্ভুক্ত হবে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকার যেভাবে ব্যাংকিং আইন সংশোধন করতে যাচ্ছে তা বঙ্গবন্ধুর সুষম অর্থনীতির চিন্তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাদের মতে, এ ধরনের সিদ্ধান্ত ব্যাংকিং খাতের জন্য আত্মঘাতী। এ সিদ্ধান্তের মানে হল কতিপয় ব্যবসায়ীর চাপের কাছে সরকার নতিস্বীকার করেছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, এ ধরনের সিদ্ধান্ত অসুস্থ রাজনীতির বহিঃপ্রকাশ। রাজনীতি যে দুর্বৃত্তদের অর্থনীতি দ্বারা প্রভাবিত, এটাই তার প্রমাণ। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর সুষম অর্থনীতির সঙ্গে এটি সম্পূর্ণ বিপরীত। এতে ব্যাংকে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে।

তিনি আরও বলেন, সারা দেশের মানুষ তাদের সঞ্চিত অর্থ, আমানত হিসেবে ব্যাংকে জমা রাখে। আর ব্যাংকে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে পুরো দেশের মানুষের সম্পদ কয়েকটি পরিবার মিলে লুটেপুটে খাবে। এর মাধ্যমে তারা ফুলে-ফেঁপে উঠে সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করবে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, পাকিস্তান আমলে আমরা ২২ পরিবারের কথা জানি। এই ২২টি পরিবার দ্বারা ব্যাংক ও আর্থিক খাত নিয়ন্ত্রিত হতো। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ২২টির জায়গায় হয়তো ৫০টি পরিবার হবে। এরাই পুরো অর্থ ব্যবস্থা জিম্মি করে সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করবে।

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ আরও বলেন, একাধারে দীর্ঘদিন কেউ পরিচালক থাকলে, তিনি কায়েমি স্বার্থের দ্বারা আক্রান্ত হবেন। তার মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠা আশা করা যায় না। ফলে ব্যাংকের সুশাসন কোনো পর্যায়ে দাঁড়াবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ইব্রাহিম খালেদের মতে, এ সিদ্ধান্তে শেয়ারবাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সরকার অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতির কথা বললেও এ আইন তার পরিপন্থী। তিনি আরও বলেন, এ ধরনের সিদ্ধান্ত দেশের জন্য দুঃখজনক। কারণ পরিচালকদের পরিবারকে সুবিধা দিতে গিয়ে সাধারণ গ্রাহকের ক্ষতি করা হচ্ছে। এতে ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা নষ্ট হবে। লুটপাট আরও বাড়বে।

জানা গেছে, ব্যাংকিং খাতের অসাধু পরিচালকদের লুটপাটের বিষয়টি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত। এদের অনেকেই কোনো নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে দীর্ঘদিন থেকে গ্রাহকের অর্থ লুটপাট করছেন। বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকও। কিন্তু পরিচালকদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে শক্ত কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। সেদিক থেকে কিছু লোকের কাছে দেশের ব্যাংকিং খাত ছিল জিম্মি।

বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালক, মালিকদের ইশারায় ঋণ দেয়া হয়। আবার ঋণ দেয়া বন্ধ করা হয়। যাকে পছন্দ ঋণ দেন। আবার যাকে অপছন্দ তাকে ঋণ দেয়া থেকে বিরত থাকেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিজের পছন্দের লোককে ঋণ দেয়া হয়। একই ব্যক্তি নামে-বেনামে বারবার ঋণ নিচ্ছেন। এসব ঋণের বেশিরভাগই আর ফেরত আসছে না। হয়ে যাচ্ছে খেলাপি। এরপর অবলোপন।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ৬ লাখ ৩০ হাজার ১৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৯৩ হাজার ৪৫০ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছেন ব্যাংক মালিকরা, যা বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ১৫ শতাংশ। তিনটি ক্যাটাগরিতে তারা ঋণ নিয়েছেন। এসব ক্যাটাগরি হল- নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ, পরিচালক নিজে গ্যারান্টার হয়ে ঋণ বিতরণ এবং সমঝোতার মাধ্যমে এক ব্যাংকের পরিচালকের অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ। অর্থাৎ বিতরণকৃত ঋণ কোনোভাবে পরিচালকদের নিয়ন্ত্রণেই থাকছে। এ ছকেই তারা লুটপাট করে থাকেন। সংশোধিত আইন কার্যকর হলে এ ধরনের ঘটনা আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা আছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সোমবার যুগান্তরকে বলেন, এ সিদ্ধান্তের মানে হল, কতিপয় ব্যবসায়ীর চাপের কাছে সরকারের নতি স্বীকার। এর মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে ব্যাংকিং খাতে পরিবারতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হল।

তিনি বলেন, এ ধরনের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত কেন নেয়া হল তা আমার বুঝে আসে না। মির্জ্জা আজিজ বলেন, এ সিদ্ধান্তের ফলে ব্যাংকের খেলাপি আরও বাড়বে। পরিচালকরা আরও লুটপাট করবেন। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। ফলে সিদ্ধান্তটি কারও কাম্য ছিল না।

তিনি বলেন, শুনেছি বাংলাদেশ ব্যাংকও এর বিরোধিতা করেছিল। এরপরও কার স্বার্থে এ আইন সংশোধন করা হচ্ছে, তা মন্ত্রণালয় ভালো বলতে পারবে। এখন ব্যাংকিং খাতের ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা দেখার জন্য অপেক্ষার পালা।

সোমবারের বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের বলেন, বর্তমানে বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালকরা ৩ বছর করে দুই মেয়াদে টানা ৬ বছর পরিচালক থাকতে পারেন। দুই মেয়াদ শেষে ৩ বছর বিরতি দিয়ে আবারও ৩ বছরের জন্য পরিচালক হতে পারেন। আইন সংশোধন হলে ৩ বছর করে, তিন মেয়াদে টানা ৯ বছর তারা পরিচালক থাকতে পারবেন। আবার ৯ বছর মেয়াদ শেষে ৩ বছর বিরতি দিয়ে পুনঃনিয়োগের সুযোগ পাবেন।

তিনি বলেন, ৩ বছর বিরতি দিয়ে আমৃত্যু পরিচালক থাকতে আইনে কোনো বাধা নেই। ব্যাংক মালিকদের দাবি ছিল, যারা ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন, তাদের যেন ভূমিকা রাখার সুযোগ থাকে। এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই বাংলাদেশ ব্যাংকও সম্মতি দিয়েছে। এছাড়া বর্তমানে এক ব্যাংকে একই পরিবার থেকে দু’জনের বেশি পরিচালক করার সুযোগ নেই। ওই ধারা সংশোধন করে একই পরিবার থেকে চারজন পরিচালক করার সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে বলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান।

এ ব্যাপারে অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংক কোম্পানি আইন পরিবর্তন করে পরিচালকদের মেয়াদ বাড়ানো সমর্থনযোগ্য নয়। এর মাধ্যমে ব্যাংকিং খাত ক্ষমতাসীন দল ও জোটের দীর্ঘস্থায়ী নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে।

তিনি বলেন, এমনিতে ক্ষমতাসীন দলের লোকজনদের ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। সেখানে পরিচালকদের মেয়াদ টানা ৯ বছর এবং একই পরিবারের চারজনকে পরিচালক করার বিষয়টি মোটেও ঠিক হয়নি। এতে ব্যাংকিং সেক্টরে একদিকে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে, অন্যদিকে কায়েমি স্বার্থবাদীরা আরও শক্ত অবস্থান গড়ে তুলবে। ফলে ব্যাংক খাতের মন্দ ঋণ আরও বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।যুগা

Please follow and like us:

Check Also

কারিগরি বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যানকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে যা বললেন ডিবির হারুন

ভুয়া সনদ সরবরাহে জড়িত থাকার অভিযোগে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের পদ থেকে সদ্য অব্যাহতি পাওয়া …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।