মিট দ্য রিপোর্টার্সে আইনমন্ত্রী রায়ের পর্যবেক্ষণে ‘ইতিহাস বিকৃতি’ হয়েছে অসদাচরণ হয়েছে কিনা, তা ক্ষতিয়ে দেখার অবকাশ আছে * আপত্তিকর বক্তব্য চিহ্নিত করার কাজ চলছে। প্রধান বিচারপতি শপথ ভঙ্গ করেছেন: বিচারপতি মানিক

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে যে পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়েছে তাতে ‘ইতিহাস বিকৃতি’ হয়েছে বলে মনে করেন আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। রোববার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) আয়োজনে মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, দেশ একক কোনো ব্যক্তির নেতৃত্বে স্বাধীন হয়নি। এ বক্তব্যে যে ইতিহাস বিকৃতি হয়েছে, এর মধ্যে কোনো সন্দেহ নাই। এ ক্ষেত্রে বিচারকের অসদাচরণ কিংবা অন্য কিছু আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখার অবকাশ আছে।’ প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের দেখা করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘দেশ ও জনগণের স্বার্থে এ ধরনের আলাপ-আলোচনা চলতে পারে।’

ডিআরইউর সভাপতি শাখাওয়াত হোসেন বাদশার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন আইনমন্ত্রী। অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়টি ৭৯৯ পৃষ্ঠার। এ রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করতে গেলেও আগে পুরো রায় পড়ে আপত্তির জায়গাগুলো ‘আইডেনটিফাই’ (চিহ্নিত) করতে হবে। এরপর রিভিউ করার জন্য যে ‘গ্রাউন্ড’, সেগুলো তৈরি করতে হবে। তবে এ কাজটি আজ-কাল বা পরশুর মধ্যেই হয়ে যাবে এমনটি নয়। কারণ রায়টি আমরা ভীষণভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি। এ ছাড়া ওখানে (রায়) অনেক আপত্তিকর, অপ্রীতিকর ও অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা আছে। সেগুলো এক্সপাঞ্জ করতে হলেও আগে তা ‘আইডেনটিফাই’ (চিহ্নিত) করতে হবে। সে কাজটি চলছে।’ আইনমন্ত্রী বলেন, ‘এক্সপাঞ্জ করতে গেলেও আমরা সরাসরি এক্সপাঞ্জ করার দরখাস্ত দিতে পারি না। কারণ সুপ্রিমকোর্ট রুলস আছে। সুপ্রিমকোর্টের রুলস বলছে, এটা রিভিউর মাধ্যমেই কেবল এক্সপাঞ্জ করার দরখাস্ত দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে রিভিউর মাধ্যমে যদি এক্সপাঞ্জ করার দরখাস্ত দিতে হয়, তাহলে দুটোই একসঙ্গে দেয়ার চিন্তাভাবনা করতে হবে। এ বিষয়ে আমরা কোনো সিদ্ধান্তে না পৌঁছলেও এ নিয়ে কাজ চলছে।’

উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব সংসদে পাস হয়, যা ষোড়শ সংশোধনী হিসেবে পরিচিত। নয়জন আইনজীবীর রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০১৬ সালের ৫ মে সংবিধানের ওই সংশোধনী ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে রায় দেন। ৩ জুলাই আপিল বিভাগও ওই রায় বহাল রাখেন। যার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ পায় ১ আগস্ট। ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা দেশের রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি, সুশাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ের সমালোচনা করেন। আর এ নিয়ে এখন তুমুল বিতর্ক চলছে। এরই মধ্যে শনিবার রাতে সরকারের যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করেন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘আমি এখন পর্যন্ত সাক্ষাতের বিষয়বস্তু সম্পর্কে কিছুই জানি না। কিন্তু এটা ঠিক যে, নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আইন সভা- এ তিনটা হচ্ছে অনলি থ্রি অরগান অব দ্য স্টেট। সেই ক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে কিছু আলাপ-আলোচনা চলতেই পারে। দেশের স্বার্থে আমরা আলাপ-আলোচনা সব সময় চালিয়ে যাব।’ তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো পাওয়ার কনটেস্টে নামিনি যে, বিচার বিভাগের পাওয়ার আমার চেয়ে কম। পথ চলতে ভুল বোঝাবুঝি হতেই পারে। সেটা দেশের স্বার্থে যখনই নিরসন করা দরকার সরকার সেটাই করবে। আমি বলব, আলাপ-আলোচনার দ্বার সব সময়ই খোলা থাকবে। এটা বন্ধ হবে না।’

আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারাই (সাংবাদিক) দাবি তুলেছেন পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাস বিকৃতি করা হয়েছে। সেটা ঠিক করতে হবে। এখন রায়ের মধ্যে অপ্রাসঙ্গিকভাবে যদি ইতিহাস সম্পর্কে কিছু বলা হয়ে থাকে, যেটা আসল নয়, তবে কি যিনি বা যারা এটা করেছেন তাকে ধরিয়ে দেয়ার অধিকারটুকুও আমার নাই?’

এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, মন্ত্রী-এমপিরা প্রধান বিচারপতির অতীত নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। কেউ বলছেন উনি ‘রাজাকার’ ছিলেন। রিপোর্টারের প্রশ্নের ফাঁকেই আইনমন্ত্রী বলেন, ‘একটা মামলায় এজলাসে উনি বলেছিলেন- আমিও ‘পিস’ কমিটির মেম্বার ছিলাম।’ রায়ে কটূক্তি করার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে খতিয়ে দেখা হচ্ছে কিনা- এমন প্রশ্নে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আপনাদের একটা অনুরোধ করব, তিনটা অরগান- আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও আইন সভা, এর প্রতিটি অরগানের যিনি প্রধান ব্যক্তি তিনি কিন্তু গৌণ। মুখ্য হল তার চেয়ার। আমার মনে হয় এই চেয়ারের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা থাকতে হবে।’

আইনমন্ত্রী বলেন, রায়ের পর্যবেক্ষণে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি, তবে কোনো একক ব্যক্তির নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি বলে কথাটি আছে। ‘প্রথম কথা হচ্ছে- এ মামলায় এটা অপ্রাসঙ্গিক। দ্বিতীয়ত এটা ইতিহাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এবং ফাইনালি এটা ইতিহাস বিকৃত করার সমান। এটাকে আমি বিকৃত করলে একটা অপরাধ করব। এর ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনারা জানেন, আমাদের স্বাধীনতা কিন্তু রাতারাতি আসে নাই। স্বাধীনতার ঘোষণাটাও রাতারাতি হয় নাই। একটা রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন।’ এ সময় এক সাংবাদিক প্রশ্ন রাখেন, এটা অসদাচরণ কিনা? জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘এটা খতিয়ে দেখতে হবে। অসদাচরণ কিংবা অন্য কিছু কিনা, তা খতিয়ে দেখার অবকাশ আছে।’

বিচারপতির অসদাচরণের বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার ‘অথরিটি’ কে? এমন প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আমি বলব, এটার অথরিটি রাষ্ট্রপতি। তার কারণ হচ্ছে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সম্বন্ধে যদি বক্তব্য না থাকে, আর ষোড়শ সংশোধনীও যদি না থাকে তাহলে রাষ্ট্রপতি ছাড়া এটার আর কোনো গত্যন্তর নেই।’

অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী বিতর্কিত ৫৭ ধারা, বঙ্গবন্ধুর যেসব খুনি এখনও পলাতক আছে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা, সাংবাদিকদের নবম ওয়েজবোর্ড ও সাংবাদিক সাগর-রুনী হত্যার বিচার নিয়েও কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আমি আপনাদের সঙ্গে বেতন বাড়ানোর দাবির সঙ্গে একমত। বিষয়টি নিয়ে আমি তথ্যমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলব। তিনি বলেন, আগস্টের মধ্যেই আপনারা ৫৭ ধারার বিষয়ে জানতে পারবেন। আমিও চাই এ ধারায় কোনো সাংবাদিক হয়রানির শিকার না হন। ৫৭ ধারাকে আপনারা নিজেদের অপরাধের ধারা হিসেবে বিবেচনা করবেন না।

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি নূর চৌধুরী ও রাশেদ চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে আইনমন্ত্রী বলেন, আমরা অনেকদূর এগিয়েছি।

ঢাকা: প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিরুদ্ধে শপথ ভঙ্গের অভিযোগ এনেছেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি সামছুদ্দিন চৌধুরী মানিক।

রোববার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক আলোচনা সভায় ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে এ অভিযোগ আনেন তিনি। এ সভার আয়োজন করে বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট (একাংশ)।

ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে সামছুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি যে রায় লিখেছেন, সেটি পুরোপুরি তার মনগড়া, বিভ্রান্তিকর ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’

একই সভায় প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাকে সম্মানের সঙ্গে পদত্যাগ করার আহ্বান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক হাছান মাহমুদ।

তিনি বলেন, ‘এ দেশের মানুষ আপনাকে আর প্রধান বিচারপতি পদে দেখতে চায় না।’

চিত্রনায়ক ফারুকের সভাপতিত্বে এ সভায় আরও বক্তব্য দেন, আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজিত

Check Also

হাফিজের কাছ থেকে রাজনীতিতে উৎসাহ না পেয়ে চলে যান সাকিব

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনীতির বিষয়ে উৎসাহিত হয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।