লাখ টাকা ঘুষ দাবির অভিযোগ—সাতক্ষীরায় পুলিশি নির্যাতনে মাদ্রাসা সুপারের মৃত্যু

সাতক্ষীরা সংবাদদাতাঃ: : সাতক্ষীরায় পুলিশি নির্যাতনে কলারোয়া হঠাৎগঞ্জ দাখিল মাদ্রাসার সুপার মাওলানা সাইদুর রহমানের মৃত্যা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের কর্তব্যরত ডাঃ ফরহাদ জামিন মৃত্যুর এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি জানান,শুক্রুবার রাত দুইটার দিকে সাতক্ষীরা জেলখানা থেকে এক রোগীকে ভর্তি করানো হয়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। পরিবারের দাবী তাকে নির্যাতনের পর বিনা চিকিৎসায় তাকে হত্যা করা হয়েছে।
নিহত মাদ্রাসা সুপার মাওলানা সাইদুর রহমান (৪৫) সাতক্ষীরা সদরের কাথনডা গ্রামের মৃত্যু জিল্লার রহমানের ছেলে। স্থানীয় কাথনডা ওয়ার্ড জামায়াতের সভাপতি,জামায়াতের রোকনপ্রার্থি ও স্থানীয় মসজিদের ইমাম ছিলেন তিনি। বিশিষ্ট এ আলেম কলারোয়া হঠাৎগঞ্জ দাখিল মাদ্রাসার সুপার ছিলেন।
নিহতের স্ত্রী ময়না বেগম জানান, গত বৃহষ্পতিবার রাত দেড়টার দিকে পুলিশের তিনজন সদস্য তাদের বাড়িতে এসে তার স্বামীকে গ্রেফতারে কথা বলে। কোন কারণে তাকে গ্রেফতার করা হবে জানতে চাইলে পুলিশ জানায় তার বিরুদ্ধে মামলা আছে। এসময় তার স্ত্রী গ্রেফতারি পরওয়ানা চাইলে পুলিশ র্দুব্যবহার করে। মাওলানা সাইদুর রহমান পুলিশকে জানান,তিনি অসুস্থ রোগী। প্রতিদিন তাকে ওষুধ খেতে হয়। তাকে ধরে নিয়ে গেলে সে বাঁচবে না বলে পুলিশের কাছে কান্নাকাটি করেন। দীর্ঘ এক ঘণ্টা ধরে কান্না কাটির পর পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। পরে তাকে নিয়ে স্থানীয় এক ডাক্তারের কাছে যান । ডাক্তার তাকে উন্নত্ত চিকিৎসার পরামর্শ দেন। কিন্তু চিকিৎসা না দিতে তাকে সাতক্ষীরা সদর থানা হাজতে রাখা হয়।
শুক্রুবার সদর থানাতে মাওলানা সাইদুর রহমানের সাথে দেখা করতে আসেন তার স্ত্রী ময়না। এসময় স্ত্রীর কাছে তার স্বামী অভিযোগ করেন, পুলিশ তাকে অনেক মারপিট করেছে। তার গায়ের পাঞ্জাবিটা ছিড়ে গেছে। পুলিশের কাথে ওষুধ চাইলে পুলিশ তা দেয়নি। পরে বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসার জন্য সদর হাসপাতালে তাকে নিয়ে ইসিজি সহ কয়েকটি পরীক্ষা করান পুলিশ। পরে শুক্রুবার সন্ধায় তাকে কোটে হাজিরার মাধ্যমে জেলে পাঠানো হয় বলে নিহতের স্ত্রী জানান।
সাতক্ষীরা সদর থানার ওসি মারুফ আহম্মেদ জানান, সুনিদিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে আটক করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে চারটি নাশকতার মামলা রয়েছে। তাকে কোন নির্যাতন করা হয়নি। নিয়মানুযায়ি তাকে আদালতের পাঠানো হয়। পরে আদালত তাকে কারাগারে প্রেরণের নির্দেশ দেন। শুক্রবার সন্ধায় তাকে সাতক্ষীরা কারাগারে পাঠানো হয়। হার্ডএার্টাকে তিনি মারা গেছেন বলে ওসি জানান।
নিহতের স্ত্রী ময়না জানান,তার স্বামীর বিরুদ্ধে কোন মামলা ছিলো না। আটকের পর পুলিশ দুটি মামলায় অজ্ঞাত আসামী করে কোটে চালান দেয়। পুলিশের তিন অফিসার এসআই আসাদ, দেলওয়ার ও এএসআই সুমন তার স্বামীকে জোর করে আটক করে নির্যাতন করেছে বলে তিনি অভিযোগ করেছেন।।
কারা সূত্র জানায়, রাত দেড়টার দিকে আসামী মাওলানা সাইদুর রহমান অসুস্থবোধ করলে তাকে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত্যু ঘোষণা করেন। লাশ ময়না তদন্ত শেষে তার পরিবারের কাছে দেয়া হবে বলে পুলিশ জানায়।
পারিবার ও স্থানীয় সূত্রের দাবি, গ্রেফতারের পর মওলানা সাঈদুরকে কাথন্ডা বাজারে নিয়ে আসা হয়। এ সময় তাকে বেধড়ক পেটায় পুলিশ। একপর্যায়ে তার অবস্থা খারাপ হতে থাকায় সেখানকার পল্লী চিকিৎসক আবদুল্লাহর চেম্বারে নিয়ে সাঈদুরকে চিকিৎসা দেয়া হয়।
সূত্র জানায়, এ সময় মওলানা সাইদুরের ভাতিজা মুত্তাসিম বিল্লাহ ৫০০ টাকা এনে চাচাকে ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ জানায়। কিন্তু পুলিশ তার কাছে এক লাখ টাকা দাবি করে। এ টাকা দিতে না পারায় মাদ্রাসা শিক্ষককে নিয়ে আসা হয় সাতক্ষীরা থানায়। সেখানেও তার ওপর নির্যাতন করতে থাকে পুলিশ।
নিহতের ভাই রফিকুল ইসলাম জানান, শুক্রবার দিনভর পুলিশ হেফাজতে রেখে তার ওপর দফায় দফায় নির্যাতন করা হলে তিনি নিস্তেজ হয়ে পড়েন। পরে তাকে আদালতে নেয়া হলে কর্তৃপক্ষ তার অসুস্থতা দেখে সাঈদুর রহমানকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। পরে পুলিশ তাকে ফের নিয়ে যায় সাতক্ষীরা হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসা দিয়ে কিছুটা সুস্থ করার পর বিকাল ৫টায় পুলিশ ফের তাকে আদালতে নিয়ে যায়। বিকালে মওলানা সাইদুরকে সাতক্ষীরা কারাগারে পাঠায় আদালত।
সাতক্ষীরা কারাগারের সুপার হাফিজুর রহমান জানান, কারাগারের মধ্যে শুক্রবার রাতে সাঈদুর রহমান আরও অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় কারা হাসপাতালে। পরে সেখান থেকে মধ্যরাতে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
সাতক্ষীরা হাসপাতালের আরএমও ডা. ফরহাদ জামিল বলেন, হাসপাতালে আনার পর তার চিকিৎসা চলছিল। শনিবার ভোরে মারা যান তিনি।ওই চিকিৎসক জানান, নিহত মাদ্রাসা শিক্ষক মওলানা সাঈদুরের দেহে নির্যাতনের চিহ্ন পাওয়া গেছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সদর থানার এসআই মো. আসাদুজ্জামান বলেন, আমি তাকে গ্রেফতার করলেও নির্যাতন করিনি। তার কাছে ঘুষও চাইনি । আগে থেকেই তিনি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হয়ে অসুস্থ ছিলেন। গ্রেফতারের পর তাকে হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। এরপর তার মৃত্যু সম্পর্কে আর কোনো তথ্য আমার কাছে নেই।
অন্যদিকে সদর থানার ওসি মারুফ আহম্মদ জানায় তিনি হার্ডএ্যাটার্কে মারা গেছে। এসআই ও ওসির বক্তব্য বিপরীত মুখি।
কে এই আসাদুজ্জামান
সাতক্ষীরা সদর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আসাদুজ্জামান গ্রামে গ্রামে আসামি ধরার নামে বেপরোয়া আচরণ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রতিরাতে আসামি ধরে মারপিট করে তাদের কাছ থেকে আদায় করছেন ঘুষের টাকা।
গত ২৭ আগস্ট রাতে সদর উপজেলার বাঁশদহা ইউনিয়নের কুলিয়াডাঙ্গা গ্রামের আকতারুল ইসলামকে তার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করেন আসাদুজ্জামান। এ সময় তার কাছে থাকা চারটি ছাগল বিক্রির টাকা ঘুষ হিসাবে দাবি করে। অন্যথায় তাকে জামায়াতের মামলায় ঢুকিয়ে দেয়া হবে বলে হুমকি দেয়া হয়। একপর্যায়ে আকতারুল ইসলামকে নিয়ে আসা হয় সাতক্ষীরা থানায়। নির্যাতন করে তার কাছ থেকে আদায় করেন ৬৫ হাজার টাকা ঘুষ। এরপরও তাকে আদালতে চালান দেয়া হয়।
আকতারুল জানায়, তিনি ঈদ উপলক্ষে চারটি পোষা ছাগল বিক্রি করেছিলেন। পুলিশ সে টাকা নিয়ে নিল। এ নিয়ে মার খেলাম, মামলাও খেলাম।
তবে এসআই আসাদুজ্জামান বলেন, এ অভিযোগ সত্য নয়। আকতারুলকে একটি অভিযোগে গ্রেফতার করেছিলাম। পরে তাকে আদালতে পাঠাই। তার কাছে ঘুষ চাওয়া হয়নি। তাকে মারপিটও করা হয়নি।১৬.৯.১৭

 

Please follow and like us:

Check Also

ইসরায়েলের অনুরোধে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক

ইরান থেকে ইসরাইলের উদ্দেশ্যে শতাধিক ড্রোন ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছে। এসব প্রতিহত করতে ইসরাইলের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।