পথ হারিয়েছে মানবতা, পথ হারিয়েছেন সুচিও

সঙ্কট যেন ব্যূহ রচনা করেছে, দুর্ভেদ্য ব্যূহ এক। সঙ্কটমুক্তির কোনো পথই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চল থেকে রোহিঙ্গাদের বিপুল বহিঃস্রোত অনর্গল, অবিশ্রাম। কিন্তু যে দিকেই এগোচ্ছে এই জনগোষ্ঠী, সে দিকেই যেন এখন ঠাঁই নাই-ঠাঁই নাই রব। এই রব যে আদ্যন্ত কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট বা সঙ্কীর্ণতাজাত, তাও বলা যাচ্ছে না। পৃথিবীর যে প্রান্তে মানবতা এই গভীর সঙ্কটে আক্রান্ত আজ, সেই প্রান্তকে ঘিরে জনবিন্যাসের ছবিটা এমনই যে, লাগোয়া এলাকায় লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর জন্য পুনর্বাসনের ঠাঁই খুঁজে দেওয়া বেশ কঠিন। কিন্তু বিরাট জনগোষ্ঠীর বাঁচার আর্তির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখার দংশনও কম যন্ত্রণার নয়। সঙ্কটে আজ শুধু রোহিঙ্গারা নন, সঙ্কটে বিশ্ব মানবতা।

মিয়ানমারের সর্বময়ী নেত্রী অং সান সুচি নীরবতা ভেঙেছেন অবশেষে। মিয়ানমারের সরকার দেশের প্রত্যেকটি সম্প্রদায়ের সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজতে চায়, আশ্বাস তাঁর। কিন্তু সে আশ্বাসকে খুব বলিষ্ঠ মনে হয়নি অনেকেরই, রোহিঙ্গা নির্যাতনের আশু পরিসমাপ্তির আভাসও খুঁজে পাননি অনেকেই। বিশ্বশান্তির নোবেল পদক যাঁর কণ্ঠহার, তাঁর রাজত্বে মানবতার এমন ভীষণ অপমান কীভাবে সম্ভব? এ বৈপরীত্যকে বিশ্ব মেনে নেবে কীভাবে? সুচি-ই বা মানছেন কী করে? প্রশ্ন উঠছিল গোটা বিশ্ব থেকে। তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছিল গণতন্ত্রের জন্য সুদীর্ঘ সংগ্রাম করে ইতিহাস গড়ে ফেলা নেত্রীকে। এই বিশ্বজোড়া প্রশ্নচিহ্নের সম্মুখে নীরবতা ভাঙতেই হত সুচিকে। তিনি ভাঙলেনও। কিন্তু বিশ্ব মানবতার বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরকেও সঙ্কটাপন্ন মনে হল যেন। সুচি নিজেই যেন পথ খুঁজে পাচ্ছেন না সঙ্কটমুক্তির, এমনই উপলব্ধি জাগল।

মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের সঙ্কট নতুন নয়, এ সঙ্কট ঐতিহাসিক। সামরিক শাসনে থাকাকালীনও দেশটিতে অত্যাচারের শিকার হয়েছিলেন রোহিঙ্গারা, আজকের গণতান্ত্রিক মিয়ানমারেও হচ্ছেন। নাগরিক অধিকার নেই এই জনগোষ্ঠীর। রয়েছে নিদারুণ দৈনন্দিন সংগ্রাম, অশিক্ষা, কর্মসংস্থানহীনতা। আর রয়েছে মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর অবিশ্বাস, অসহযোগিতা। এমন এক অবহেলিত, কোণঠাসা জনগোষ্ঠীর মধ্যে অসামাজিকতা, সাম্প্রদায়িকতা, গোঁড়ামি চারিয়ে দেওয়া কঠিন নয়, বরং বেশ সহজই। সেই সহজ কাজটা সেরে ফেলেছে কট্টরবাদীরা। রোহিঙ্গারা অতএব সশস্ত্র হামলা চালিয়েছে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর উপরে। অত্যাচারের দরজাটা আরও চওড়া করে খুলে ফেলতে তাই আর কোনো অসুবিধা হয়নি মিয়ানমারের সেনার। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়ার অজুহাত পাওয়া গেছে। লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা অতএব দেশান্তরী হতে শুরু করেছেন।

বিপুল জনসংখ্যা এবং উন্নয়নশীল অর্থনীতির বাংলাদেশের পক্ষে এই বিপুল সংখ্যক শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়া প্রায় অসম্ভব। রোহিঙ্গারা ভারতে ঢুকতে চান। কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে এবং ইতিমধ্যেই বিভিন্ন দেশ থেকে আসা বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর চাপের কথা মাথায় রেখে ভারত সরকার তাঁদের আশ্রয় দিতে নারাজ। একা ভার নিতে চায় না মালয়েশিয়াও। রোহিঙ্গারা সুতরাং কানোরই নন আচমকা, নিজভূমে পরবাসী তো ছিলেনই দীর্ঘ সময়, আজ নিজভূম বলেও কিছু নেই আর, এই পৃথিবীতে যেন কোনো জায়গাই নেই তাঁদের জন্য। রোহিঙ্গারা আচমকা যেন এই পৃথিবীর কেউ নন। পৃথিবী কিন্তু বলছে না, রোহিঙ্গারা পৃথিবীর কেউ নন। রাজনৈতিক এবং সামাজিক বাস্তবতা বলছে কথাটা। ওই বাস্তবতার কারণেই মিয়ানমার ছাড়তে হচ্ছে বা হয় রোহিঙ্গাদের। ওই বাস্তবতার জেরেই গৃহহারা লক্ষ লক্ষ মানুষ কোনো প্রতিবেশীর সহায়তা পান না। ওই বাস্তবতাই অং সান সুচিকে নীরব রাখে।

জঙ্গি কার্যকলাপ রয়েছে রোহিঙ্গাদের মধ্যে, অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু নিরীহ-নিরন্ন রোহিঙ্গার সংখ্যা তো তার চেয়ে অনেক বেশি। ঘর হারিয়ে, আত্মীয়-পরিজনের শব ডিঙিয়ে, অবসন্ন শরীর নিয়ে কোনোক্রমে বাংলাদেশে ঢুকেছেন অন্তঃসত্ত্বা সেবু তারা। মাথার উপরে ছাউনি নেই আজ, পায়ের তলার জমিটা স্থায়ী কি না জানেন না, গতকাল বা পরশু খাবার জোটেনি, আজ এবং আগামীকালও হয়তো জুটবে না। বেঁচে থাকা যাবে কি না, সেটাই আসলে স্পষ্ট নয় সেবু তারার কাছে। এই সেবু তারারাই তো সংখ্যাগরিষ্ঠ ওই দেশান্তরী মিছিলটাতে, জঙ্গিরা তো সংখ্যালঘু। কিন্তু জঙ্গিদের চিহ্নিত করে আলাদা করার উপায় জানা নেই, অতএব সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু কারোরই ঠাঁই নেই।

লক্ষ লক্ষ মানুষের অসহনীয় দুর্দশা দেখে প্রবল উৎকণ্ঠায় বিশ্ব জমনত। কিন্তু মানবতার এই ভয়ঙ্কর লাঞ্ছনার নিরসন কোন পথে, কারও জানা নেই এই মুহূর্ত পর্যন্তও। বিশ্ব মানবতা যেন পথ হারিয়ে ফেলেছে এক জটিল ব্যূহে। সুচিও যেন দিকভ্রান্ত, দিশাহারা। এক রূঢ় বাস্তব আজ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাখ্যান করছে বিভিন্ন দিক থেকে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বাস্তব মানেই কিন্তু সত্য নয়। এ বাস্তব বিভ্রান্তি আর অসত্যের উপরে দাঁড়িয়ে থাকা বাস্তব। মানবতার সত্য এতে নিহিত নেই বিন্দুমাত্র।

সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা

Please follow and like us:

Check Also

নতুন যোগ হচ্ছে ২০ লাখ দরিদ্র

মূল্যস্ফীতির কশাঘাত মোকাবিলায় ২০ লাখ ২৬ হাজার দরিদ্র মানুষকে নতুন করে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।