৬ বছর বন্ধ জামায়াত কার্যালয়, নিরাপত্তারক্ষীদের বেতন বাকি:প্রহরি দিয়ে চলছে জামায়াত কার্যালয়

টানা ছয় বছর ধরে বন্ধ রয়েছে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগর কার্যালয়। এই সময়ের মধ্যে একদিনও খোলা হয়নি মগবাজার ওয়্যারলেস রেল গেটের পাশে কেন্দ্রীয় কার্যালয়। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন স্থগিত থাকা জামায়াতের গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট হচ্ছে ঢাকা মহানগর কার্যালয়। পুরানা পল্টনে ১ থেকে ৯ তলা পর্যন্ত এই কার্যালয়টিও তালাবদ্ধ। এই কার্যালয়ের ওপরের দিকে দু’টি তলায় নিরাপত্তারক্ষীরা থাকলেও বাকি ফ্লোরগুলো তালা দেওয়া। প্রতিটি তলায় জমেছে ধুলো, মাকড়সার জাল। আসবাবপত্রে ধরেছে জং। সম্প্রতি সরেজমিনে পরিদর্শনকালে কার্যালয় দু’টির এমন চিত্র দেখা গেছে।

জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয়বকেয়া পড়েছে নিরাপত্তারক্ষীদের বেতন

জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও মহানগর কার্যালয়ে নিয়োজিত নিরাপত্তারক্ষীদের মাসিক বেতন বকেয়া পড়েছে বলে জানিয়েছেন নিরাপত্তা রক্ষীরা। মহানগর অফিসের নিরাপত্তায় নিয়োজিতদের জুলাই ও আগস্টের বেতন বকেয়া পড়েছে বলে জানান প্রহরী আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘কার্যালয় বন্ধ থাকা ও সবসময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল থাকায় নিয়মিত কেউই আসেন না। এক্ষেত্রে একেক মাসে একেকজন এসে বেতন দিয়ে যান।
যদিও সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে বুধবার (৩০ আগস্ট) রাতে ফোন করা হলেও আসাদুজ্জামান ফোন রিসিভ করেননি। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের একজন নিরাপত্তারক্ষী বলেন,‘গত মঙ্গলবার (২৯ আগস্ট) জুলাই-১৭-এর বেতন দেওয়া হয়েছে।’ ঈদের কোনও বোনাস দেওয়া হয়নি বলে জানান এই রক্ষী।
জামায়াতের মহানগরী কার্যালয়ের এখানে নিরাপত্তারক্ষীরা বসবাস করেনকেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নিরাপত্তারক্ষী আবুল কালাম আজাদ বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ‘মোট সাতজন প্রহরী। তারা দিনে-রাতে ২৪ ঘণ্টা কার্যালয়টি পাহারা দেন। আর পল্টনে মহানগর কার্যালয়ে ডিউটি করেন ৪ জন গার্ড। তারা হলেন, মুহাম্মদ আমির, আসাদুজ্জামান, শেখ জাকির ও শামসুদ্দিন।’
৩০ আগস্ট রাতে মগবাজার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের একজন নিরাপত্তারক্ষী বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ‘ধারণা করা হচ্ছে, মহানগর কার্যালয়ের পাহারাদারদেরও জুলাই মাসের বেতন দেওয়া হয়েছে।’
এ প্রসঙ্গে জামায়াতের ঢাকা মহানগরের একাধিক দায়িত্বশীলের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তারা নিজ পরিচয়ে কেউই মন্তব্য করতে রাজি হননি। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বাধা রয়েছে বলে জানান।

মাদুরে শুয়ে-বসে সময় কাটছে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নিরাপত্তারক্ষীদের
সময়—২৫ আগস্ট, শুক্রবার বিকাল সাড়ে ৪০ টা। স্থান—৫০৫ এলিফ্যান্ট রোড, বড় মগবাজার। গেটের ভেতরে কার্যালয়ের প্রবেশের পথেই রঙিন মাদুরে দুপুরের ভাতঘুম দিচ্ছিলেন নিরাপত্তারক্ষী আবুল কালাম আজাদ ও ইব্রাহিম।
শুয়ে-বসে সময় কাটান মগবাজার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নিরাপত্তারক্ষীরাগেটের বাইরে থেকে ডাক শুনে গেট খোলেন আবুল কালাম আজাদ। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে ওঠার সিঁড়ির মুখে গেটে তালা। ভেতরে আরও একটি কক্ষ খোলা থাকলেও তিনি বলেন,‘কেউ নেই।’
আলাপে জানা গেল, ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কার্যালয়টিতে তালা দেওয়ার পর থেকে এখান থেকে অদ্যাবধি রাজনৈতিক বা সাংগঠনিক কোনও কার্যক্রম চালাতে পারেনি জামায়াত। এরপর গত ৬ বছরে ডজনখানেক বার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তল্লাশি হয়েছে, কখনও রাতে, কখনও দিনে।
আবুল কালাম আজাদ জানান, মোট সাতজন প্রহরী দিনে-রাতে ২৪ ঘণ্টা কার্যালয়টি পাহারা দেন। নিজেদের বেতন-ভাতা অনিয়মিত পান বলেও জানান আবুল কালাম আজাদ।
বেতন-ভাতা কখন দেয়? এমন প্রশ্নে আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘দেওয়া হয়। মাঝে-মাঝে বিরতি পড়ে।’ বাড়িটির বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস ও পানির বিল কিভাবে পরিশোধ করা হয়, তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা তো দারুল ইসলাম ট্রাস্টের। তাদের পক্ষ থেকেই পরিশোধ করা হয়।’
২০১১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর জামায়াতের কেন্দ্রীয় ও মহানগর কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এই ৬ বছরে দলটির কোনও নেতাকর্মীই অফিসমুখো হতে পারেননি। যদিও কার্যালয়ের আশেপাশে নিজেদের আদর্শের লোকজনের পরিচালিত শিক্ষা, প্রিন্টিং, লাইব্রেরি ব্যবসা ও পত্রিকা সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে দলের কার্যক্রম চালাচ্ছে জামায়াত।
২০১১ সালে কার্যালয় বন্ধ হওয়ার পর জামায়াতের তৎকালীন (বর্তমানে আমির) আমির মকবুল আহমাদ অভিযোগ করেছিলেন, ১৯ সেপ্টেম্বর রাতে ২দফা জামায়াতের কেন্দ্রীয় অফিসে পুলিশের তল্লাশির নামে সংগঠনের কম্পিউটার, ফাইলপত্রসহ অফিসের বিভিন্ন আসবাবপত্র ভাঙচুর, লুটতরাজ করেছে।

ধুলো-বালি-মাকড়সার আবরণে মহানগর কার্যালয়
পুরানা পল্টনে অবস্থিত জামায়াতের মহানগর কার্যালয়। ভবনটির নিচতলার একপাশ পুরোপুরি বন্ধ। অফিসটিতে প্রবেশের প্রধান দরোজাটিও এখন নেই। ছোট্ট একটি গলিপথ দিয়েই প্রবেশ করতে হয় এক সময়ের ব্যস্ততম এই কার্যালয়টিতে। পাশেই নতুন একটি ভবন নির্মিত হওয়ায় কার্যালয়টি আড়ালে পড়ে গেছে।
৯ তলাবিশিষ্ট ভবনটির ৯ম ও ৮ম তলার কয়েকটি কক্ষে রক্ষীরা বসবাস করেন। প্রহরী আসাদুজ্জামান বলেন, ‘যখন যেখানে জায়গা পাই, শুয়ে পড়ি।’
মহানগরী কার্যালয়ের দ্বিতীয় তলার বর্তমান অবস্থাসরেজমিনে প্রত্যেকটি কক্ষেই ধুলো-ময়লাযুক্ত দেখা গেছে। সিঁড়িতে, জানালা, দরজায় বাড়তি ধুলোর আস্তরণ ও ধাতব জিনিসগুলোয় জং পড়েছে। দ্বিতীয় তলার প্রত্যেকটি কক্ষ খোলা থাকলেও ভেতরের জিনিসপত্র ছড়ানো-ছিটানো অবস্থায় রয়েছে। চেয়ার-টেবিলে ভাঙচুরের চিহ্ন। আলমারিগুলো তালাবদ্ধ। একটি কক্ষে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ের ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে মৃত্যুবরণকারী আবদুল কাদের মোল্লার স্মরণিকা দেখা গেছে। এ থেকে ধারণা করা যায়, ২০১১ সালের পরও জামায়াত বা শিবিরের কেউ কার্যালয়ে প্রবেশ করেছেন। যদিও গার্ডরা বলছেন, ২০১১ সালের সেপেটম্বরের পর কেউ-ই কার্যালয়ে প্রবেশ করেননি।
মহানগর কার্যালয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন—এমন একজন নিরাপত্তারক্ষী বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ‘পুলিশ রাতদিন বসে থাকে। তাই এই টহলের মধ্যে কেউ আসেন না।’
মহানগর কার্যালয়ের পাশে ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রীয় কার্যালয়। এ ভবনের চারটি ফ্লোর তাদের ভাড়ায় থাকলেও বর্তমানে মাত্র একটি ফ্লোর রয়েছে। বাকি তিনটির ভাড়া ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সিদ্দিক জানান, ‘ওই ভবনে কেবল ছাত্র শিবির নয়, অনেক আবাসিক ফ্ল্যাট রয়েছে। তাই কিছুটা কোলাহল আছে।’
যদিও জামায়াত মহানগর কার্যালয়ের নিরাপত্তারক্ষী আসাদুজ্জামান জানান, ‘পাশের ভবনে ছাত্র শিবিরের কোনও ফ্লোরই নেই।’ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছাত্রশিবির তাদের প্রেস মেইল ও সাংগঠনিক ওয়েবসাইট-পরিচিতিতে ঠিকানা হিসেবে এই ভবনটির (৪৮/১-এ, পুরানা পল্টন) কথাই উল্লেখ করে।
উল্লেখ্য, ২০১২ সালের আগস্টে কেন জামায়াতের অফিস খুলে দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে সরকারের প্রতি রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্ট। এ বিষয়ে কথা হয়েছিল জামায়াত নেতা ডা. আবদুল্লা মোহাম্মদ তাহেরের সঙ্গে। তিনি দাবি করেছিলেন, ‘কোর্ট থেকে স্থগিত আদেশ দেওয়ার পরও সরকার কোনও জবাব দেয়নি।’
তবে দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্বপূর্ণ কার্যালয় বন্ধ থাকলেও জামায়াতের পাঠানো বিবৃতিগুলোয় এ বিষয়টি অনুল্লেখ থাকে। সর্বশেষ ২৯ আগস্ট দলটির আমির মকবুল আহমাদ তার দলের নেতাদের দেশের রাজনৈতিক বিষয়, বিচার বিভাগের সঙ্গে সরকারের টানাপড়েনসহ বিভিন্ন বিষয়ে বক্তব্য দিলেও কার্যালয় বিষয়ে কোনও কথা বলেননি।বাংলা ট্রিবিউন

Please follow and like us:

Check Also

ঈদে স্ত্রীর জন্য মাংস কিনতে না পারায় দিনমজুর স্বামীর আত্মহত্যা

জামালপুরের বকশীগঞ্জে স্ত্রীর জন্য মাংস কিনতে না পেরে চিঠি লিখে আত্মহত্যা করেছেন হাসান আলী (২৬) …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।