পাসপোর্ট অফিসে ঘুষ বাণিজ্য বছরে ৫০ কোটি টাকা!

ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোট: সাতক্ষীরায় পাসপোর্ট খাতে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস, পুলিশের ডিএসবি শাখা ও সোনালী ব্যাংকের বার্ষিক ঘুষ বাণিজ্য গড়ে প্রায় ৫০ কোটি টাকারও বেশী। সাতক্ষীরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস এখন ঘুষের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। আর এখাতে পুলিশ প্রতিবেদনের জন্য নিয়মমাফিক টাকা নেওয়া হয়। এছাড়াও এই খাতের সাথে জড়িয়ে রয়েছে সাতক্ষীরা সোনালী ব্যাংকের প্রধান শাখা। ঘুষ বাণিজ্য বা দুর্নীতির টাকার পরিমান নির্দিষ্ট থাকায় একটি বিশেষ জরিপে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে।
ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, প্রতি সাধারণ পাসপোর্টের জন্য সরকার নির্ধারিত ফি ৩০০০ টাকা এবং ১৫% মূল্য সংযোজন কর ৪৫০ টাকা। মোট ৩৪৫০ টাকা সোনালী ব্যাংকের সাতক্ষীরা শাখায় জমা দিতে হয়। এর সঙ্গে অতিরিক্ত ৫ টাকা দিতে হয়। আর জরুরী পাসপোর্টের নির্ধারিত ফি জন্য ৬০০০ টাকা। ১৫% মূল্য সংযোজন কর সহ মোট ৬৯০০ টাকায় জমা দিতে হয়। ব্যাংকে অতিরিক্ত দিতে হয় ১০ টাকা। এছাড়াও মেয়াদ উত্তীর্ণ পাসপোর্টের ফি‘র ক্ষেত্রে আরো ৫ টাকা নেওয়া হয়। পাশাপাশি সময় বিশেষ তাদের কাছে লটারীর টিকেট বিক্রি করেও কমিশন বের করে নেয় তারা। এটা নাকি ব্যাংকের ভ্যাট। একটি পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, দৈনিক প্রায় গড়ে ২০০ জনের অধিক প্রার্থী পাসপোর্টের ফি জমা দেয়। সেই হিসেবে সোনালী ব্যাংকে দৈনিক ১ হাজার টাকা, মাসে ৩০ হাজার টাকা, বছরে ৩ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা দাঁড়ায়। এ ব্যাপারে ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এটা নিয়ম মেনেই সবাই জমা দিয়ে যাচ্ছে। তবে এটা যদি ভ্যাট হয় তাহলে রশিদ দেওয়া হয়না কেন তার কোন সদুত্তর তারা দিতে পারেননি।
এদিকে, পাসপোর্ট প্রত্যাশীরা সাতক্ষীরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের জমা কাউন্টারে তাদের আবেদনপত্র জমা দিতে গেলে সেখানে ইচ্ছাকৃতভাবে চরম হয়রানি করা হয়। তাদের সকল কাগজপত্রাদি ঠিক থাকলেও বলা হয় ঠিক নেই। ছবি ঠিক নেই, ফটোকপি করা ঠিক নেই, বাস্তবে ফরমের ছবিতে পাসপোর্ট বই তৈরি না হলেও বলা হয় ছবি ল্যাব প্রিন্ট নেই, স্বাক্ষর ঠিক নেই। নামের বানান ঠিক করে লেখা হয়নি। পেশার কাগজপত্র প্রমাণ লাগবে, ফরম পূরণ করা ঠিকঠাক হয়নি ইত্যাদি ভুল ধরা হয়। যদি বলা হয় এই ফরমে কোন ভুল নেই তখন তাদেরকে বলা হয় ভুল আছে কিনা আপনি কিভাবে জানলেন। কে পূরণ করে দিয়েছে ফরম। তাকে কত টাকা দিয়েছেন ইত্যাদি। যদি পাশের কেউ এই ব্যক্তির পক্ষে সুপারিশ করেন তাকে কাউন্টারম্যান বলেন, আপনি এখানে দালালি করছেন কেন? কত টাকা খেয়েছেন? ভাল চান তো চলে যান, নইলে পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দেব। এভাবে অপমান করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে একজন প্রার্থী কয়েকদিন হাঁটাহাঁটি করলে তবে কোন রকমে তার ফাইলটি জমা দিতে সক্ষম হন। আর সেই ফাইলে একটি বিশেষ সংকেত দিয়ে দেওয়া হয়, যাতে তাকে প্রথমে সহকারী পরিচালকের কাছে যেয়ে ইন্টারভিউ দিতে হবে। ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্যও ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। তারপর সহকারী পরিচালক ফরমটি পরিপূর্ণভাবে গ্রহন করে বলে দেন আপনি বাইরে যেয়ে বসেন ফাইল নিচে চলে যাবে। এরপর ফাইল নিচের কম্পিউটার রুমে এসে গায়েব হয়ে যায়। ছবি তোলার জন্য সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় একজন সাধারণ পাসপোর্ট প্রার্থীর। এই প্রক্রিয়া অর্থাৎ ঘুষছাড়া জমা দিতে পারা সৌভাগ্যবানদের সংখ্যা নিতান্তই নগন্য। তবে আজকে অর্থাৎ প্রতিনিয়ত যাদের ফাইল ফ্রিতে জমা হতে দেখা যাচ্ছে তারা গত কয়েকদিন থেকে হয়রানির শিকার হয়েছেন এটাই বাস্তব। তাতেই মনে হবে প্রতিদিন তারা ঘুষ ছাড়াই ফাইল জমা নিচ্ছেন। তবে তা সর্বোচ্চ হলে গোটা কম বেশি ৫০ জনের মতো হবে। তবে, কেহ যদি হয়রানির শিকার হতে না চান, তবে তাকে গুনতে হয় ১১০০ টাকা ঘুষ। ঘুষ নেওয়ার মাধ্যম হিসেবে পাশেই রয়েছে পাসপোর্ট অফিসের লোকজনের নির্ধারিত দালালচক্র আর আনসার সদস্য। তারাই টাকার বিনিময়ে সাথে সাথে ছবি তোলার ব্যবস্থা করে দিয়ে থাকেন। যে ফাইলে এত ভুল দেখানো হয় সেই ফাইল টাকা দিলে সব ঠিক হয়ে যায়। এছাড়া যারা সরাসরি দালালদের মাধ্যমে চুক্তিতে ফাইল জমা দেন তাদের ক্ষেত্রে জামাই বাবুর মতো ছবি তুলে দেওয়া হয়। এব্যাপারে পাসপোর্ট অফিসের লোকজনের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, এইসব ফাইল আগের, তাই আগে আগে হয়ে যাচ্ছে। অথচ বাস্তবে তার উল্টো। ব্যাংকের সিরিয়াল হিসেবে প্রতিদিন ২০০ এর অধিক ব্যক্তি পাসপোট ফি জমা দিয়ে থাকেন। তাতেই সহজে হিসেব করলে দেখা যায়, পাসপোর্ট অফিসের লোকজন দৈনন্দিন প্রায় ২০০ এর অধিক ফাইলের ছবি তোলা ও আঙুলের ছাপ নেওয়া কাজ সম্পন্ন করে থাকেন। যা থেকে প্রতি সাধারণ পাসপোর্ট এর জন্য ১১০০ টাকা হারে এবং জরুরী পাসপোর্টের জন্য ২০০০ টাকা হারে ঘুষ আদায় করে থাকেন। সেই হিসেবে দৈনিক দাঁড়ায় গড়ে ২ লক্ষ ২০ হাজার টাকা, মাসে ৬৬ লক্ষ এবং বছরে ৭৯ কোটি ২ লক্ষ টাকা। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, সারাদিনে যে যার মাধ্যমে যত টাকা আদায় হয়, অফিসের কার্যক্রম শেষে সহকারী পরিচালক আবু সাইদ সহ সকলের মধ্যে তা স্তর অনুযায়ী ভাগ বাটোয়ারা করা হয়। তাছাড়া সাতক্ষীরা পাসপোর্ট অফিসের বর্তমান সহকারী পরিচালক আবু সাইদ এর শ্বশুর বাড়ি দেবহাটা উপজেলার শাখরা-কোমরপুরে হওয়ায় তার আলাদা বাড়তি ইনকামের সুবিধা হয়েছে। এছাড়াও সাতক্ষীরা পাসপোর্ট অফিসে কর্মরত অনেক স্টাফের স্থায়ী বাড়ি সাতক্ষীরায় হওয়ায় তাদেরও পোয়া বারো। প্রত্যেকেই এখন অঢেল সম্পদের মালিক। এখানে ঘুষের সাথে জড়িত আনসার সদস্যরাও। যদি কেহ সরাসরি সহকারী পরিচালকের সাথে দেখা করতে চায়, তবে তাকে সহজে যেতে দেওয়া হয়না। বলা হয় অনুমতি নিয়ে আসেন। ভূক্তভোগীরা জানান, তারা কার কাছ থেকে অনুমতি নিবেন, সেই অনুমতির পর্যায়ে গেলে তো আর সহকারী পরিচালকের সাথে দেখা করার প্রয়োজন হতো না। তবে যদি আনসার সদস্যদের জানানো হয় সমস্যার কথা, তারাও টাকার প্রস্তাব দেয়। না হলে কোনমতে অফিসের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি নেই।
পাসপোর্ট অফিস পেরুলেই নিস্তার নেই। এবার শুরু পুলিশের বিশেষ শাখা ডিএসবি তদন্ত প্রতিবেদন। সেটি না হলে কারো পাসপোর্ট পাবার সুযোগ এখনো পর্যন্ত নেই। তাই তারাও সুযোগ বুঝে জন প্রতি ৫০০ টাকা নেয়। তাদের যুক্তি তদন্ত করতে গেলে যাতায়াত খরচ, মোবাইল খরচ বাবদ সেটা নেওয়া হয়। সুতারাং পূর্বের সংখ্যা অনুপাতে ডিএসবি‘র সদস্যদেরও আয় গড়ে দৈনিক ১ লক্ষ মাসে ৩০ লক্ষ এবং বছরে ৩৬ কোটি টাকা।
এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাসপোর্টের দালালির কাজে নিয়োজিত কয়েকজন জানান, একজনের পাসপোর্ট করতে মোট খরচ হয়ে যাচ্ছে ফি ৩৪৫০ টাকা, সোনালী ব্যাংকে ৫টাকা, পাসপোর্ট অফিসে ১১০০টাকা এবং পুলিশের বিশেষ শাখায় ৫০০ টাকা। আবেদন ফরম ক্রয় বাবদ ২০ টাকা। সর্বমোট ৫১৭৫ টাকা। তাই দালালদের দিনকাল ভাল যাচ্ছে না। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মূল টাকা বাদে সবই তো ঘুষখোরদের দিতে হয়। অথচ তারা থাকেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। অথচ এই কাজ করতে যেয়ে ডিবি পুলিশের সদস্যরা মাঝে মধ্যে পাসপোর্ট অফিসে অভিযান চালিয়ে কয়েকজন লোককে ধরে নিয়ে যায়, তাদেরও টাকা দিতে হয়, খুব বিপদের মধ্যে থাকতে হয়। এই দালালী কাজ চলে সবচেয়ে বেশি পাসপোর্ট অফিসের সামনে চায়ের দোকানে বসে এবং পাশ্ববর্তী বিল্ডিং এর ভেতর থেকে। এমনকি রেজিষ্ট্রি অফিসের আশে পাশেও এদের আস্তানা রয়েছে বলে তারা জানান। তবে দালালদের দাবি তারা পেটের দায়ে পড়ে এই কাজ করেন। কিন্তু যদি কোথাও ঘুষ দিতে না হতো তাহলে তারা সাধারণ মানুষের পাসপোর্টের ফরম পুরণ করে দিয়ে ৫০ বা ১০০ টাকা হালালভাবে উপার্জন করতে পারতো।

Check Also

আশাশুনিতে যথাযোগ্য মর্যাদায় মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস পালিত

এস, এম মোস্তাফিজুর রহমান ॥ আশাশুনিতে মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস’২৪ যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়েছে। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।