ফের চাপে জামায়াত, শীর্ষ নেতৃত্বে আসছেন কারা?

ফের চাপের মুখে পড়লো মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী। গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুজাহিদের ধারাবাহিকতায় প্রায় সাত বছর পর একসঙ্গে আটক হলেন দলটির আমির মকবুল আহমাদ, নায়েবে আমির মিয়া গোলাম পরওয়ার ও সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমানসহ ৬ শীর্ষ নেতা। এর আগে ২৯ সেপ্টেম্বর দলটির  আরও আটক নেতাকে আটক করে পুলিশ। এর মধ্য দিয়ে মাত্র ১০ দিনে জামায়াতের প্রথম সারির প্রায় সব নেতাকেই আটক করা হলো। এতে দ্বিতীয় দফায় নেতৃত্বের সংকটের মুখে পড়লো জামায়াত। এই ঘটনায় নতুন চিন্তা যুক্ত হলো দলে। দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে এখন মূল প্রশ্ন—কারা আসছেন দলের এসব গুরুত্বপূর্ণ পদে ভারপ্রাপ্ত হয়ে? সোমবার মধ্যরাতে জামায়াতের বিভিন্ন স্তরের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব বিষয় উঠে এসেছে।

জামায়াতের আমির, নায়েবে আমির, সেক্রেটারি জেনারেলসহ ছয় নেতা আটক হন সোমবার রাতে। এছাড়া দলটির সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমানের সহযোগী নজরুল ইসলাম, তার বাড়ির মালিক ও একজন দারোয়ানকেও আটক করা হয়। রাজধানীর উত্তরার একটি বাড়ি থেকে সরকারের প্রভাবশালী কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা তাদের আটক করে ডিবির হাতে হস্তান্তর করে।

এর আগে ২০১০ সালের ২৯ জুনে একদিনে একসঙ্গে গ্রেফতার হয়েছিলেন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ইতোমধ্যে ফাঁসিতে দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত নায়েবে আমির দেলওয়ার হোসাইন সাঈদী। নিজামী-মুজাহিদের গ্রেফতারের পর ভারপ্রাপ্ত হিসেবে আমিরের দায়িত্ব পান মকবুল আহমাদ। ওই সময় ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি মনোনীত হন (বর্তমানে মাবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে কারাগারে থাকা) এটিএম আজহারুল ইসলাম। ২০১২ সালে ২২ আগস্ট তাকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। এরপর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারির দায়িত্বে আসেন সিলেটের প্রভাবশালী নেতা ডা. শফিকুর রহমান। পরে মকবুল আহমাদ সাড়ে ছয় বছর এবং শফিকুর রহমান ৫ বছর যথাক্রমে আমির ও সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন। গত বছরের ১৭ অক্টোবর  মকবুল আহমাদ আমির নির্বাচিত হন।

সাতকানিয়ার দ্বন্দ্ব মেটাতে গিয়ে আটক হলেন জামায়াতের শীর্ষ নেতারা

জামায়াতের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়,  শীর্ষ নেতাদের একসঙ্গে আটকের পেছনে সরকারের অন্য কোনও উদ্দেশ্য থাকলেও এই পরিকল্পনা সফল হয়েছে ভিন্ন কারণে। সোমবার রাতে উত্তরার একটি বাসায় আগামী নির্বাচনে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থেকে দলীয় মনোনয়ন কে পাবেন, এ নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। পূর্বনির্ধারিত সময় অনুযায়ী কেন্দ্রীয় নেতারা ওই বাসায় একসঙ্গে হলেও বেঁচে গেছেন দুই নেতা। যাদের কেন্দ্র করে বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল।

সূত্র জানায়, সাতকানিয়া আসন থেকে এমপি হয়েছেন শাহজাহান চৌধুরী ও নায়েবে আমির আ ন ম শামসুল ইসলাম দু’জনই। কিন্তু আগামী নির্বাচনে কে প্রার্থী হবেন, এ নিয়ে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ও মহানগর নেতাদের মধ্যে মতবিরোধ ছিল। এই মতবিরোধ মেটাতেই দলের আমির মকবুল আহমাদ ও সেক্রেটারি জেনারেল শফিকুর রহমান ও মিয়া গোলাম পরওয়ার চট্টগ্রামের শীর্ষ নেতাদের ডেকেছিলেন। এই ডাকে সাড়া দিয়ে চট্টগ্রামের তিন নেতা বৈঠকস্থলে পৌঁছলেও শাহজাহান চৌধুরী ও শামসুল ইসলাম দেরি করে ফেলেন। এরই মধ্যে গোয়েন্দারা তাদের অবস্থান চিহ্নিত করেন।

সরকারের প্রভাবশালী দু’টি গোয়েন্দাসংস্থার নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, বিগত এক মাসের বেশি সময় ধরেই জামায়াত নেতাদের গ্রেফতারে তৎপরতা শুরু হয়। কিন্তু একইসঙ্গে এতজন কেন্দ্রীয় নেতাদের পেয়ে যাবেন, এটি তারা ভাবেননি।

গোয়েন্দা সূত্রটি জানায়, চট্টগ্রাম থেকেই গোয়েন্দাসূত্র জানায়, শহরের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা দ্বন্দ্ব মেটাতে ঢাকায় আসছেন। এরই মধ্যে আটক করার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে সংস্থাগুলো। জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতারে সরকারের তিনটি গোয়েন্দা সংস্থা একযোগে কাজ করে।

সূত্রগুলো জানায়, আটককৃতদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই বিভিন্ন সময় মামলা করা হয়েছে। খুব দ্রুতই তাদের সে সব মামলায় গ্রেফতার দেখানো হবে। এরই মধ্যে আমির মকবুল আহমাদের বিরুদ্ধে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে নতুন করেও মামলা হতে পারে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রতিনিধিরা  ইতোমধ্যে তার জেলা ফেনীতে গিয়েছেন দুই দফা।

আটকের বিষয়ে সোমবার রাতে তাৎক্ষণিক বিবৃতিতে দলের সিনিয়র নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান অভিযোগ করেন, ‘আজ সন্ধ্যায় দলের আমিরের নেতৃত্বে ঘরোয়া বৈঠকের সময় পুলিশ অন্যায়ভাবে দলের আমিরসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের আটক করে।’

প্রথম সারির আরও যারা আটক

গত ২৯ সেপ্টেম্বর পুলিশের হাতে আটক হন জামায়াতের প্রথম সারির চার নেতাসহ ৯ জন। তাদের মধ্যে কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা  মহানগর দক্ষিণ শাখার আমির নূরুল ইসলাম বুলবুল, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের নায়েবে আমির মঞ্জুরুল ইসলাম ভূঁইয়া, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ ও কেন্দ্রীয় মসজলিসে শুরার সদস্য আবদুস সবুর ফকির, বাংলাদেশ মসজিদ মিশনের সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা ড. খলিলুর রহমান মাদানী, ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তা মাওলানা ফরিদুল ইসলাম উল্লেখযোগ্য।

গত ২৯ সেপ্টেম্বর ও সোমবার (৯ অক্টোবর) জামায়াতের প্রথম সারির বেশিরভাগ নেতাকে আটকের মধ্য দিয়ে আবারও নেতৃত্বের সংকটে উপনীত হলো। বরাবরই জামায়াত অভিযোগ করে আসছে, সরকার নেতৃত্বের সংকট তৈরি করতেই তাদের গ্রেফতার করে। কেন্দ্রীয় নেতারা ছাড়াও সারাদেশে জামায়াতের প্রায় কয়েকশ আটক হয়েছে। তাদের মধ্যে কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্যসহ বিভিন্ন জেলার আমির ও সেক্রেটারি রয়েছেন।

শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতারে নেতাকর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক

আমির-নায়েবে আমির ও সেক্রেটারি জেনারেলসহ শীর্ষ নেতাদের আটক-গ্রেফতারে জামায়াতের নেতাকর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক বেড়েছে। তৈরি হয়েছে হতাশাও। সূত্র জানায়, গোলাম আযমের মৃত্যু, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির পর জামায়াতে নেতৃত্বের সংকট তৈরি হয়। এরপরও গত ছয় বছরে নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে নতুন কমিটির নেতৃত্বে নীরবে সংগঠিত হচ্ছিলেন নেতাকর্মীরা। এরই মধ্যে চলতি বছরের কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার অঞ্চলভেদে অনুষ্ঠিত বৈঠকগুলোয় আগামী একবছর রাজপথ থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্তও নিয়েছিল দলটি। এই পরিপ্রেক্ষিতে ফের প্রথম সারির নেতাদের গ্রেফতারে নেতাকর্মীদের মন ভেঙে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

চট্টগ্রাম বিভাগের একজন দায়িত্বশীল জানান, ‘প্রভাব তো পড়বেই। নেতাকর্মীরা হতাশ হয়েছে। আমরাও হতাশ হয়েছি। নার্ভাসনেস কাজ করছে।’

যদিও জামায়াতের নেতাদের আটক-গ্রেফতার নতুন কোনও বিষয় নয় বলে মনে করেন, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ডা. রিদওয়ানুল্লাহ শাহেদি। তিনি বলেন, ‘আটক-গ্রেফতার, রিমান্ড তো জামায়াতের জন্য নতুন নয়। অভ্যন্তরীণভাবে দল আগের চেয়ে অনেক বেশি সংগঠিত।’

ফেনী জেলা আমির একে এম শামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘দ্বীনের পথে চলতে গেলে জেল-জুলুম স্বাভাবিক, এতে কষ্ট হলেও মন ভাঙার কিছু নেই। জামায়াতের ওপর এ সরকারের আচরণ বরাবরের মতো ধারাবাহিক। আটক-গ্রেফতার নতুন কিছু নয়।’

কারা আসছেন ভারপ্রাপ্ত হয়ে?

মাত্র এক বছরের ব্যবধানে ফের ভারপ্রাপ্ত নেতৃত্বের মুখে পড়লো জামায়াত। গত বছরের ১৭ অক্টোবর আমির হিসেবে শপথ নেওয়ার পর নতুন কমিটি মনোনয়ন দিয়েছিলেন আমির মকবুল আহমাদ। কিন্তু তার নেতৃত্বে নতুন কমিটি আসার একবছরের মধ্যে তাকে আটক করা হলো।

জামায়াতের কয়েকজন দায়িত্বশীলের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে,  ২০১৩-১৪ সেশনে একটি ক্ষুদ্র উগ্রপন্থী অংশের কারণে জামায়াত ধ্বংসাত্মক আন্দোলনে গেলেও ২০১৫ সাল থেকে নীরবেই দল সংগঠিত করা হয়। চলতি বছরেও মজলিসে শুরার অঞ্চলভেদে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আরও একবছর রাজপথের কর্মসূচি থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। এর রেশ দেখা গেছে সোমবার রাতেও। দলের নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান মঙ্গলবার বিক্ষোভ কর্মসূচি দিয়েছেন এবং নেতাকর্মীদের ধৈর্য ধরার দিয়েছেন।

সূত্র জানায়, নিয়ম অনুযায়ী কেন্দ্রীয় নেতাদের আটকের পর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ জরুরি বৈঠক করবে। সর্বোচ্চ-সংখ্যক সদস্যের অভিমতের ভিত্তিতে খুব দ্রুত ভারপ্রাপ্ত আমির ও ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি ঠিক করবে এই পরিষদ।

দায়িত্বশীলদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ‘ভারপ্রাপ্ত আমির হিসেবে সিনিয়র নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান দায়িত্ব পেতে পারেন। আর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি হিসেবে নির্বাহী পরিষদ সদস্য রফিকুল ইসলাম খান হতে পারেন। বিগত কমিটি তিনি সেক্রেটারি হিসেবে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ডা. শফিকুর রহমানের। এক্ষেত্রে রফিকুল ইসলাম খান ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি হলে নতুন চিন্তায় পড়বে নেতাকর্মীরা।

সোমবার রাতে একাধিক দায়িত্বশীল নেতা জানান, মুজিবুর রহমান ভারপ্রাপ্ত আমির হিসেবে ঠিক থাকলেও রফিকুল ইসলাম খান হলে তৃণমূলের পরিস্থিতি আরও আশঙ্কার মধ্যে পড়বে। ১৩-১৪ সালের সহিংস আন্দোলনে রফিকুল ইসলাম খানের অতি-আগ্রহী ভূমিকার কারণে তৃণমূল জামায়াত তাকে এড়িয়ে চলতেই পছন্দ করে। এক্ষেত্রে নির্বাহী পরিষদের বৈঠকে সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম মাসুম বা আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহেরকে বেছে নেওয়া হতে পারে। এছাড়া হামিদুর রহমান আজাদও আছেন। সিনিয়রিটির দিক থেকে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক থাকলেও তিনি লন্ডনে অবস্থান করছেন দীর্ঘদিন ধরেই। ফলে, ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল নিয়ে জামায়াতের নেতাকর্মীদের মধ্যে চিন্তা রয়ে গেছে।

এ বিষয়ে  দায়িত্বশীল কোনও নেতাই নাম প্রকাশে রাজি হননি।http://m.banglatribune.com

Check Also

এনএসআইয়ের গোপন তথ্যে ১৯৯ বস্তা ভারতীয় চিনি উদ্ধার: জরিমানা সাতক্ষীরা সদরের খবর,

এনএসআইয়ের গোপন তথ্যের ভিত্তিতে ১৯৯ বস্তা ভারতীয় চিনি উদ্ধারের পর জরিমানা করা হয়েছে। বুধবার (২৭ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।