আওয়ামী লীগে প্রার্থীর ছড়াছড়ি : সক্রিয় জাতীয় পার্টি, উধাও জামায়াত

সুভাষ চৌধুরী, সাতক্ষীরা থেকে:১৯৭৩ থেকে ২০১৪ সাল- দীর্ঘ এ চার দশকে আওয়ামী লীগ মাত্র দু’বার সাতক্ষীরা সদর অর্থাৎ সাতক্ষীরা-২ আসনে জয় পেয়েছে। আসনটি জামায়াতের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত হলেও নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনহীন এ দলের দীর্ঘ অনুপস্থিতির ফলে আগামী নির্বাচনী হাওয়া কোন দিকে ধাবিত হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে। সবশেষ ২০১৪ সালে বিএনপি-জামায়াতের ভোট বর্জনের মুখে আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। নৌকা-হরিণ প্রতীকের মধ্যে লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত জয়ের হাসি হাসেন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী মীর মোস্তাক আহমেদ রবি। এবারও সেই বাস্তবতায় ভোটের হিসাব কষা হচ্ছে। এ আসনে আগাগোড়াই বিএনপির অবস্থান দুর্বল। ১৯৯৬ সালের বিতর্কিত ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ছাড়া কোনোবারই জয় পায়নি বিএনপি। জামায়াতের একটা বড় ভোটব্যাংক থাকলেও নানামুখী চাপে জামায়াত নেতাদের প্রকাশ্যে দেখা যায় কমই। বলতে গেলে তারা এখন বাড়িছাড়া। একাদশ সংসদ নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই কৌতূহল জাগছে জামায়াতের নীরব ভোটব্যাংক নিয়ে। শেষ পর্যন্ত যদি জামায়াত সরাসরি ভোটে অংশ নিতে না পারে তাহলে এ ভোট যাবে কোন বাক্সে? সে প্রশ্নের সুরাহা হয়নি এখনও। নানা চাপে থাকা বিএনপিরও কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। বিদ্যমান এ বাস্তবতার মধ্যে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীরা প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছেন। জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা এলাকায় সক্রিয় রয়েছেন। ১৯৮৮ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি এ আসনে জয়লাভ করে।

স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে এ আসনে প্রথম জয় পায় আওয়ামী লীগ, সবশেষ ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে জয় পায় নৌকা। এ ছাড়া ১৯৭৯ সালে মুসলিম লীগ এবং ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে জামায়াতে ইসলাম এ আসনে জয়লাভ করে। অপরদিকে ১৯৮৮ ও ২০০৮-এ জাতীয় পার্টি জয়লাভ করলেও ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রে“য়ারির নির্বাচনে প্রথম জয়ের স্বাদ পায় বিএনপি।

আওয়ামী লীগের বর্তমান এমপি মুক্তিযোদ্ধা মীর মোস্তাক আহমেদ রবি আগামী নির্বাচনেও মনোনয়ন চাইবেন। এ আসনে আওয়ামী লীগের একাধিক গ্রুপ সক্রিয় থাকলেও মোস্তাক আহমেদের নিজের কোনো গ্রুপ নেই। দশম সংসদ নির্বাচনে তিনি দলীয় মনোনয়ন পেলেও তাকে সহযোগিতা না করার অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে। তাকে বেকায়দায় ফেলতে হরিণ প্রতীক নিয়ে প্রার্থী হন একজন শ্রমিক লীগ নেতা। বিষয়টি মাথায় রেখে এ আসনে তৃতীয়বারের মতো প্রার্থী হতে চাইছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম। ২০০৮ সালে তিনি দলীয় মনোনয়ন পেয়েও ১৪ দলের পক্ষে আসনটি ছেড়ে দেন। এ ছাড়া ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে তিনি জামায়াতের কাছে হেরে যান। আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছার কথা জানিয়ে নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি সব সময় মাঠে রয়েছি। কখনও উপজেলা চেয়ারম্যান, কখনও দলের সাধারণ সম্পাদক আবার কখনও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হিসেবে উন্নয়ন কাজ করে যাচ্ছি। মনোনয়ন পেলে জনগণ আমাকে বিজয়ী করবেন।’ কথা হয় মীর মোস্তাক আহমেদ রবির সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং চার দশক পর আমিই সাতক্ষীরা সদরে আওয়ামী লীগের আসনটি পুনরুদ্ধার করতে পেরেছি। এ জন্য মনোনয়ন আমার চাই।’

আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালিকায় আরও রয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক স্থানীয় দৈনিক কালের চিত্র সম্পাদক অধ্যাপক আবু আহমেদ, সাতক্ষীরা সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মো. আসাদুজ্জামান বাবু, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শেখ সাঈদ উদ্দিনসহ বেশ কয়েকজন। নির্বাচনী ভাবনা নিয়ে আসাদুজ্জামান বাবু যুগান্তরকে বলেন, ‘জনগণ আমাকে উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে বেছে নিয়েছেন। আমি সাংগঠনিক কাজ বিরামহীনভাবে চালিয়ে যাচ্ছি। মানুষের সুখে-দুঃখে তাদের পাশে আছি। মনোনয়ন পাব এবং জয়লাভ করব এ বিশ্বাস আমার রয়েছে।’

আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের ভিড়ে ঢুকে পড়েছেন আবু ইউসুফ নামে আরেক প্রার্থী। তবে তিনি আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি নাকি বিএনপির পক্ষে লড়বেন তা স্পষ্ট নয়। ঢাকার বাসিন্দা ড. আবু ইউসুফ মো. আবদুল্লাহ নর্দান ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির উপাচার্য। এরই মধ্যে তিনি কাজ শুরু করে দিয়েছেন। তবে তার দাবি, ২০০৮ সালে নির্বাচিত মহাজোট প্রার্থী জাতীয় পার্টির এমএ জব্বার তার শ্বশুর। এ বক্তব্য প্রচারের মধ্য দিয়ে তিনি জাতীয় পার্টির ভোটব্যাংক কাজে লাগাতে চাইছেন। তবে এ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীরা বলছেন, কোনো ইমপোর্টেড প্রার্থীকে গ্রহণ করা হবে না। এসব বসন্তের কোকিলকে তারা তাড়িয়ে দেবেন। তবে এলাকায় সরবে ও নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি শেখ আজহার হোসেন। তিনি পেছনে ফেলে আসা কয়েকটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে সব ধরনের সহায়তা দিয়ে তাদের কাছ থেকে সংসদ নির্বাচনে সমর্থন পাওয়ার প্রতিশ্রুতি আদায় করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমাকে মনোনয়ন দেয়া হলে জনগণের ভালোবাসা ও সমর্থন পাব।’ আসনটিতে জেলা বিএনপির বর্তমান সভাপতি রহমতউল্লাহ পলাশ নির্বাচন করবেন এমন আগ্রহ ব্যক্ত করলেও তার কোনো তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি। তিনিও ঢাকার বাসিন্দা। সাতক্ষীরায় তাকে কালেভদ্রে দেখা যায়। এমন অবস্থায় দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সৈয়দ ইফতেখার আলি অথবা আবদুল আলিম প্রার্থী হতে পারেন বলে কানাঘুষা চলছে। বিএনপির সৈয়দ ইফতেখার আলির বলেন, ‘বিএনপিকে মানুষ ভালোবাসে। দল আমাকে মনোনয়ন দিলে আমি জনগণের ভালোবাসার প্রতিদান দিতে প্রস্তুত।’ তবে রাজনৈতিক মাঠে তার কোনো তৎপরতা নেই।

অপরদিকে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা শেখ মাতলুব হোসেন লিয়ন প্রার্থী হতে আগ্রহী। তবে তার দৃশ্যমান কোনো প্রচার নেই। শুধু ব্যানার আর পোস্টারের মধ্যে তিনি সীমাবদ্ধ রেখেছেন তার প্রচার। এদিকে রাজনৈতিক মহল মনে করছে, জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা সৈয়দ দিদার বখতকে সাতক্ষীরা সদর আসনে ১৪ দলের প্রার্থী করা হতে পারে। এর ফলে তালা ও কলারোয়া আসনের জোটগত জট যেমন নিরসন হবে তেমনি সাতক্ষীরা সদরে যে জট বেঁধেছে তারও অবসান হবে। তবে এ বিষয়ে সৈয়দ দিদার বখতের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। এ প্রসঙ্গে বর্তমান সংসদ সদস্য মীর মোস্তাক আহমেদ রবি বলেন, আসনটি আওয়ামী লীগেরই থাকবে এবং তা ১৪ দলীয় জোটগতভাবে হলেও হতে পারে। একই কথা বলেন আওয়ামী লীগের নজরুল ইসলামসহ অন্য প্রার্থীরা। তবে জাতীয় পার্টি বলছে, এখানে তাদের বড় ভোটব্যাংক আছে। তা কাজে লাগালে সুফল আসবে। একটি প্রথম শ্রেণীর পৌরসভা, একটি উপজেলা এবং ১৪টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত আসনটির হালনাগাদ ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ৪২ হাজার ২২২। এর মধ্যে হিন্দু ভোটার সংখ্যা কমবেশি ৪১ হাজার। আগামী নির্বাচনে এ আসনে ১৪ দলীয় জোট জয়লাভ করবে নাকি জামায়াতের ঘাঁটি হিসেবেই রয়ে যাবে, তা শুধু ভবিষ্যৎই বলতে পারে।

Please follow and like us:

Check Also

শ্যামনগর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে কে কোন প্রতীক পেলেন

সুন্দরবনাঞ্চল (শ্যামনগর) প্রতিনিধি: ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রথম ধাপের সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থীদের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।