রাজনীতিতে গুমোট, অন্দরমহলে আলো-আঁধারির খেলা

ঢাকা: ফের এক ধরনের গুমোট পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে। রোহিঙ্গা ইস্যুর পর প্রধান বিচারপতি এসকে সিহার ছুটির ইস্যুটিই এখনই ‘টপ অফ দ্যা কান্ট্রি’। এ নিয়ে সবাই কমবেশি সোচ্চার হয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় নির্বাচন নিয়েও আলাপ-আলোচনা চলছে বিভিন্ন মহলে। এর পরেও কেমন জানি এক ধরনের গুমোট পরিবেশ বিরাজ করছে। কোনো মহলই বলতে পারছেন না রাজনীতির অন্দরমহলে কী ঘটতে যাচ্ছে।

রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে সাধারণ খেটে খাওয়া লোকজনকেও নাড়া দিয়েছে প্রধান বিচারপতির ইস্যুটি। ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের সুস্পষ্ট মেসেজ না থাকলেও সরকারের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে অনেকের ধারণা ভেতরে ভেতরে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে।

এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদেশ সফর শেষে অনেকটাই বিশ্রামে রয়েছেন। সরকারি কিছু কার্যক্রম ছাড়া দলীয় প্রোগামে তেমন অংশ নিচ্ছেন না। সে ধরনের রাজনৈতিক কোনো কড়া বক্তব্যও দিচ্ছেন না। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও দেশে নেই। বুধবার বিকেলে তার দেশে ফেরার কথা রয়েছে। তিনি এবার লন্ডনে গিয়ে আগের মতো তেমন বড় কোনো অনুষ্ঠানেও অংশ নেননি। অনেকটাই চুপচাপ কেটেছে এবারের লন্ডন সফর। সবমিলেই রাজনীতিতে এক ধরনের গুমট পরিস্থিতি বিরাজ করছে বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

এখন মূলত প্রধান বিচারপতি ইস্যুটিই মূখ্য আলোচনায় রয়েছে। নানা নাটকীয় ঘটনার পর প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা মাস খানেকেরও বেশি সময়ের ছুটি নিয়ে বিদেশ চলে যাওয়া মধ্যে কিছু একটা কিন্তু লুকায়িত রয়েছে। সরকার বলছে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা অসুস্থ, কিন্তু দেশ ছাড়ার আগে বলে গেলেন তিনি সম্পূর্ণ অসুস্থ।

ফলে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার ছুটি নিয়ে বিতর্ক যেন কোনোমতেই থামছে না। ক্রমেই এই বিতর্কের ঢালপালা ছড়াচ্ছে। বিচারপতি দেশ ছাড়ার পর তার বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ গুরুতর ১১টি অভিযোগ আনা হয়েছে। এসব অভিযোগ নিয়ে দেশের সাধারণ জনগণই বা কতটা বিশ্বাস করছেন। ভবিষ্যতে বিচার বিভাগের প্রতি জনমনে আস্থার জায়গাটা কতটা বজায় থাকবে। এ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

বিচার বিভাগের সঙ্গে সরকারের দ্বন্দ্ব এতোদিন কিছুটা রাগঢাক থাকলেও তা প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে। প্রধান বিচারপতি দেশ ছাড়ার সময়কার লিখিত বক্তব্য,পরে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ এবং আইনমন্ত্রীর বক্তব্যই প্রমাণ বিচার ও শাসন বিভাগের সম্পর্ক কতটা জটিল আকার ধারণ করেছে।

শুধু তাই নয়, কূটনৈতিক সম্পর্কেও ব্যাপক টানাপোড়েন চলছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলের সঙ্গে। বিশেষ করে এতোদিনে পরম বন্ধু ভারত এখন ইউ টার্ন দিচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরকার যতটা ধারণা করেছিল ভারত, চীন ও রাশিয়া পাশে থাকবে তা মোটেও হয়নি। বরং বাংলাদেশের নীতির সম্পূর্ণ শক্ত অবস্থান নিয়েছে তারা।

তবে যাই ঘটুক না কেন, বাংলাদেশে ইতিবাচক রাজনীতির পরিবেশ ফেরাতে পর্দার অন্তরালে থেকেই দূতিয়ালি করছেন কূটনীতিকরা। নির্বাচনকেন্দ্রিক ‘সহিংসতার চক্র’ থেকে দেশকে মুক্ত হতে সহায়তা করা, একটি বিতর্কমুক্ত এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন নিশ্চিত করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য বলে জানা যাচ্ছে।

এরই মধ্যে নড়েচড়ে বসেছেন বিদেশি কূটনীতিকরা। তাদের তৎরপরতা কিছুটা দৃশ্যমানও হচ্ছে। রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে কূটনীতিকদের আনাগোনা, দফায় দফায় বৈঠক-আলোচনা চলছে। সব আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে জাতীয় নির্বাচন।

এরই ধারাবাহিতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করতে যাচ্ছে ভারত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও নরওয়েসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিকরা। তারা কয়েকদিনের মধ্যেই পর পর বৈঠক করতে পারেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে। এছাড়া বৈদেশিক কূটনৈতিকদের আগাগোনাও বেড়েছে।

এদিকে আগামী জাতীয় নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করার বিষয়ে শাসক মহল থেকে দৃঢ় মনোভাব ব্যক্ত করা হয়েছে। যেসব নেতা ওই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অংশ নিতে আগ্রহী তাদের তৃণমূলে যোগাযোগ বাড়ানোর নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে বর্তমান সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। এমন কী সরকারের নীতি নির্ধারক মহল থেকেও জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে।

বিএনপিসহ বিরোধী শক্তিগুলো এখনো নির্বাচনী মাঠে না নামলে ভেতরে ভেতরে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দিয়েছে। এরই মধ্যে তারা মাঠ পর্যায়ে সে মেসেজ দিয়ে দিয়েছে।

তবে সরকারি মহলের ‘আশা জাগানো ওই বার্তা’ কূটনৈতিক মহলে বেশ প্রশংসা পেয়েছে। এখন কূটনৈতিক পল্লীর পার্টিগুলোতে ইতিবাচকভাবেই সেটি আলোচিত হচ্ছে।

কূটনীতিকদের প্রত্যাশার পারদও বেশ উপরে। এখানে আগামী নির্বাচনটি যেসব দলের অংশগ্রহণে হবে সেটি নিয়ে যেন বিতর্ক না হয়। তবে সেই নির্বাচনের ‘শান্তিপূর্ণ’ আয়োজনের নিশ্চয়তা পাওয়ার চেষ্টাই এখন চলছে।

আর এ জন্যই আগেভাগে সক্রিয় বিদেশি কূটনীতিকরা। সব বিতর্ক পেছনে ঠেলে তারা এখন শুধুই সামনে এগোতে চান। এখানে ‘গঠনমূলক রাজনীতি’ পুনঃপ্রতিষ্ঠায় তারা রীতিমতো দরকষাকষি করছেন। তাদের দূতিয়ালির প্রক্রিয়া বা পন্থা ভিন্ন হলেও লক্ষ্য প্রায় অভিন্ন। রাজনৈতিক অঙ্গনে বিশেষত সরকার এবং প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে মৌলিক এবং জনগুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে ‘সমঝোতা’য় পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন বিদেশি বন্ধু-উন্নয়ন সহযোগীরা।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বা নাক গলানোর চিন্তা নয় বরং দেশে যেকোনো নির্বাচনকে ঘিরে (আগে-পরে) প্রায় প্রতিষ্ঠিত যে সহিংসতার চক্র (সাইকেল অব ভায়োলেন্স) এবং সেই চক্রে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহলের যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা তা নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন তারা। নির্বাচনী সহিংসতার ওই চক্র ভাঙতেই এবার অনেকটা ঘোষণা দিয়েই জোটবদ্ধভাবে লড়ছেন বিদেশি বন্ধুরা বিশেষত পশ্চিমারা। অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং জনগুরুত্বপূর্ণ ওই ইস্যুতে তারা বেশ সরব।

অনেকেই বলছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দেশে ফিরলে রাজনীতির এই গুমোট পরিবেশ কিছুটা স্পষ্ট হতে পারে। রাজনীতির মাঠের দৃশ্যপট অনেকটা পাল্টে যেতে পারে। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আরো সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে রাজনৈতিক দলগুলো।আরটিএনএন

Please follow and like us:

Check Also

অনিশ্চয়তার নতুন যুগে মধ্যপ্রাচ্য

ইউক্রেন-রাশিয়া রেশ কাটতে না কাটতেই ফিলিস্তিনের গাজায় শুরু হয় ইসরাইলি আগ্রাসন। এরপর থেকে অশান্ত হতে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।