বাতিল হওয়া ৪ লাখ বই উপজেলায়

নিম্নমানের কাগজে ছাপানো মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রায় ৪ লাখ বইয়ের ছাড়পত্র দেয়নি পরিদর্শন টিম। তারপরও এসব বই উপজেলায় পৌঁছানো হয়েছে। এরমধ্যে পিএ নামে একটি প্রিন্টার্সের তিন লাখ বই রয়েছে। নিম্নমানের কাগজে ছাপা বইগুলো কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েও কাটতে পারেনি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এর আগেই কর্মচারী ইউনিয়নের নেতাদের হস্তক্ষেপে উপজেলায় পৌঁছে যায়। এ ধরনের ঘটনা আরো ঘটেছে। পূর্ণাঙ্গ পরিদর্শন রিপোর্ট পাওয়ার পর তা জানা যাবে। অন্যদিকে নিম্নমানের প্রায় ২০০০ টনের বেশি কাগজ বাতিল করেছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে পরিদর্শনে দায়িত্বে থাকা বালটিক বিডি ও কন্টিনেন্টাল বিডি। বিষয়টি স্বীকার করে এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র সাহা মানবজমিনকে বলেন, নিম্নমানের কাগজে বই ছাপায় আমরা প্রচুর বই বাতিল করেছি। অনেক বই কেটে ফেলেছি। আকস্মিক পরিদর্শনসহ এ ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে। পিএ প্রিন্টার্সের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানতে হবে বলে জানান তিনি। তবে বইয়ের সার্বিক মান ও সরবরাহ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন তিনি।
মাধ্যমিকের পরিদর্শন এজেন্ট বালটিক বিডির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম আর কাইয়ুম বলেন, পিএ প্রিন্টার্সের কাগজের মান সন্তোষজনক না হওয়ায় দুইবার তাদের ছাড়পত্র দেয়া হয়নি। তারপর কী হয়েছে সেটা আমার জানা নেই। তিনি বলেন, নিম্নমানের কাগজ দেয়ায় আমরা প্রায় সাড়ে ৩০০ টনের বেশি কাগজ বাতিল করেছি। সর্বশেষ মাধ্যমিকের সুখপাঠ্যে ১০৮ টন কাগজ বাতিল হয়েছে। মাধ্যমিকে ৮৬ শতাংশ বই ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগামী বছরের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন ছাপাখানায় এই চার লাখ পাঠ্যবই ছাপিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাঠানোর প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছিল। কিন্তু পরিদর্শনে এসব বইয়ের ত্রুটি চিহ্নিত করে এনসিটিবিকে জানানো হয়। এরপর এসব বই কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু এক সপ্তাহে এসব বই না কাটায় সিবিএ নেতাদের হস্তক্ষেপে তা উপজেলায় পৌঁছে যায়।
এনসিটিবির কর্মকর্তারা বলছেন, যেসব বই পৌঁছানো হয়েছে সেগুলো নতুন করে ছাপানো যাবে না। এখন তাদের জরিমানা করা ছাড়া বিকল্প কিছু নেই। এসব প্রিন্টার্সরা চালাকি করেই এ কাজটি করেছে। কারণ নিম্নমানের কাগজে ছাপা হওয়ার পর তা ধরা পড়লে নিজ খরচে এসব বই ছাপাতে হয়।
এদিকে মাধ্যমিকে সুখপাঠ্য বই নিয়ে সুখবর দিয়েছে এনসিটিবি। প্রিন্টার্সদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত রোববার সুখপাঠ্য বই কাজ পাওয়া ৬১টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি শেষ করেছে এনসিটিবি। নানা জটিলতার পর কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো ৫৫ দিন সময় পেলেও দ্রুত সময়ের মধ্যে বইয়ের কাজ শেষ করে দিবে বলে এনসিটিবিকে জানিয়েছেন। প্রিন্টার্সরা জানান, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে অন্যান্য বইয়ের কাজ প্রায় শেষ। এজন্য কাজের ছাপ অনেকটা কমেছে। এছাড়া ১০২টি লটের কাজ পেয়েছে ৬১টি প্রতিষ্ঠান। গড়ে দেড় টনের মতো কাজ তারা এক থেকে দেড় সপ্তাহ শেষ করে দিতে পারবেন। আমরা চাইলে সর্বোচ্চ ১৫ দিনে এই বইয়ের কাজ শেষ করতে পারবো।
এ ব্যাপারে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান মানবজমিনকে বলেন, এবারের বই নিয়ে আমরা খুবই সন্তুষ্ট। বিশেষ করে প্রাইমারির বই আমরা খুবই দ্রুত সময়ে ছাপাতে পেরেছি। আর সুখপাঠ্য বই চুক্তি হয়েছে। খুবই দ্রুত সময়ে এসব বই সরবরাহ করার চেষ্টা করবো।
প্রাথমিকের বইয়ে সন্তোষ: এদিকে প্রাথমিকের বইয়ের মান নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে এনসিটিবি, শিক্ষামন্ত্রণালয় ও সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এছাড়া দ্রুত সময়ে বই সরবরাহ করার পিছনে পরিদর্শন টিম কন্টিনেন্টাল বিডি প্রকল্প বিডির কড়া নজরদারি অন্যতম কারণ বলে জানা গেছে। এ ব্যাপারে এনসিটিবি চেয়ারম্যান বলেন, তাদের কড়া নজরদারির কারণে আমরা এবার ভালো মানের বই পাচ্ছি। পরিদর্শন টিমের লোকজন দিন-রাত প্রেসে প্রেসে মনিটরিং করেছে। আর সংসদীয় কমিটির সর্বশেষ মিটিংয়ে এবার বইয়ের মান নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। এ ব্যাপারে কন্টিনেন্টাল বিডি প্রকল্পের পরিচালক শেখ বেলাল হোসেন বলেন, আমরা শুরু থেকেই জিরো টলারেন্সে ছিলাম। কাউকে কোনো ছাড় দেইনি। প্রথমদিকেই কাগজ ছাড়পত্রে কঠোরতা দেখিয়েছি। এজন্য মানসম্মত বই দেয়া সম্ভব হয়েছে। নিম্নমানের কাগজ দেয়ায় ১৫২০ টন কাগজ ও ১৮৬৩টি বাতিল করা হয়েছে। আর ২০ হাজারের বেশি বিতর্কিত বই বাতিল করেছি।
এনসিটিবি ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ১৯শে নভেম্বর পর্যন্ত প্রাথমিকের ১০ কোটি ৩৬ লাখ বইয়ের মধ্যে ৯ কোটি ২৯ লাখের ৭৪ হাজারের বেশি বই প্রিন্ট হয়েছে। যা মোট বইয়ের প্রায় ৯০ শতাংশ। আর ৮ কোটি ২৮ লাখের বেশি বইয়ের ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে। যা মোট বইয়ের ৮০ শতাংশ। ৫০৮টি উপজেলার মধ্যে ৫০০ উপজেলার বই পৌঁছে গেছে। কাজ পাওয়া ৩২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১২টি প্রিন্টার্স শতভাগ কাজ শেষ করেছে। এরমধ্যে আছে প্রিয়াংকা, জুপিটার, সরকার প্রেস, ভাই ভাই প্রেস, শ্যাডো প্রিন্টার্স, লেটার অ্যান্ড কালার, পেপার প্রসেস, মমতাজ প্রিন্টার্স, বর্ণশোভা, ফাহিম, সাগরিকা, লেখন এবং মানামা প্রিন্টার্স। নভেম্বরের শেষের দিকে প্রাথমিকেই বই ৯৫ ভাগ বই ছাপার কাজ শেষ হয়ে যাবে বলে জানিয়েছে কর্মকর্তারা। এছাড়াও প্রাথমিক পর্যায়ের বই ছাপায় নিম্নমানের কাগজ ব্যবহার করায় বলাকা প্রিন্টার্সের ১১০ টন, লেটার অ্যান্ড কালারে ১৪০ টন, লেখন আর্ট প্রেস ৫০ টন,  এস আর প্রিন্টার্সে ৬০ টন, প্রিয়াংকা ৫০ টন, জুপিটারে ও সীমান্ত দুটি প্রিন্টার্সের আলাদা ১০০ টন, সাগরিকা ১৯০ টন, পিএ প্রিন্টার্স ২০ টন, পেপার প্রেসেস ৪৯০ টন কাগজ বাতিল করা হয়। এছাড়াও আরো ছোট ছোট কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কাগজ বাতিল করা হয়। এসব কাগজের গায়ে কখনো লাল কালি দিয়ে বাতিলের সিল দেয়া হয়।

Please follow and like us:

Check Also

ঈদে স্ত্রীর জন্য মাংস কিনতে না পারায় দিনমজুর স্বামীর আত্মহত্যা

জামালপুরের বকশীগঞ্জে স্ত্রীর জন্য মাংস কিনতে না পেরে চিঠি লিখে আত্মহত্যা করেছেন হাসান আলী (২৬) …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।