রোহিঙ্গা সংকট কম্বোডিয়ার সহযোগিতা চাইলেন প্রধানমন্ত্রী

রোহিঙ্গা সংকট
কম্বোডিয়ার সহযোগিতা চাইলেন প্রধানমন্ত্রী
১০টি সমঝোতা স্মারক সই * বিনিয়োগে এগিয়ে আসতে কম্বোডিয়ার ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান * প্রধানমন্ত্রীকে উষ্ণ অভ্যর্থনা

রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধান নিশ্চিত করতে কম্বোডিয়ার সহযোগিতা চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেনে দুই দেশের মধ্যে অনুষ্ঠিত দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে তিনি এ সহযোগিতা চান।

বৈঠক শেষে কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের সঙ্গে এক যৌথ বিবৃতিতে শেখ হাসিনা বলেন, ‘রোহিঙ্গারা যাতে নিরাপদে তাদের ঘরে ফিরতে পারে, সেজন্য মিয়ানমারের সঙ্গে আমরা দ্বিপক্ষীয় আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের কাছেও আমি সহযোগিতা চাইছি, যাতে এ সংকটের একটি টেকসই সমাধানে আমরা পৌঁছতে পারি।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে সাম্প্রতিক কিছু আঞ্চলিক নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের বিষয়ে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। দুই পক্ষই সন্ত্রাস ও উগ্রবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকারের কথা বলেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে কথা বলেছি, যা আমাদের আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও শান্তি বিনষ্টের হুমকি তৈরি করছে।’

প্রধানমন্ত্রী জানান, ‘বাংলাদেশকে এখন ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গার ভার বইতে হচ্ছে, যাদের মধ্যে প্রায় ৭ লাখ মানুষ মিয়ানমারে সাম্প্রতিক সহিংসতার কারণে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে।’

এ সময় কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেন বলেন, ‘আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা হয়ছে। আশা করি, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয়েই এ রোহিঙ্গাদের সুশৃঙ্খলভাবে নিরাপদে স্বদেশে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে একযোগে কাজ করবে।’ তিনি বলেন, ‘দেশে ১৬ কোটি মানুষ থাকার পরও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়ে এবং তাদের বিষয়টি নিজেদের কাঁধে তুলে নেয়ায় আমরা তাদের (বাংলাদেশের) প্রশংসা করছি।’

কম্বোডিয়াকে বাংলাদেশের নিকটতম আঞ্চলিক প্রতিবেশী আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এ দুটি দেশ একই রকম শান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের প্রত্যাশী।

কম্বোডিয়ায় তার সফরকে অত্যন্ত ফলপ্রসূ আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার এবং প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের মধ্যে আলোচনার ফলে দুই দেশের সম্পর্ক এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে।

এ সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে ১০টি দ্বিপাক্ষিক স্মারক ও একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা দুই দেশের বাণিজ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে জয়েন্ট ট্রেড কাউন্সিলের (জেটিসি) প্রথম বৈঠকটিও আগামী বছর ঢাকায় অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

আঞ্চলিক সহযোগিতার বিষয়টি আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে, প্রধানমন্ত্রী হুন সেন আসিয়ান (এএসইএএন) বৈঠকে বাংলাদেশকে ‘সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনারশিপ অ্যাসপিরেশনে’ সহযোগিতা প্রদানের বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছেন।’

দুই মহান জাতিই একই ধরনের নির্যাতন-নিপীড়ন এবং গণহত্যা প্রত্যক্ষ করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা কম্বোডিয়ার সংঘাত-পরবর্তী শান্তি স্থাপনে সর্বাগ্রে কম্বোডিয়ার জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে।’

বৈঠকে বাংলাদেশ পক্ষে অন্যদের মধ্যে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী, আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক মো. আবুল কালাম আজাদ, পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক এবং প্রেস সচিব ইহসানুল করিম উপস্থিত ছিলেন।

কম্বোডিয়ার সঙ্গে ১০টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত : সোমবার সকালে কম্বোডিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের ১০টি সমঝোতা স্মারক এবং একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। বাণিজ্য-বিনিয়োগ, পর্যটন ও তথ্যপ্রযুক্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা এগিয়ে নিতে এ স্মারক ও চুক্তি স্বাক্ষর হয়।

নমপেনে কম্বোডিয়ার প্রথানমন্ত্রী হুন সেনের কার্যালয় পিস প্যালেসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের উপস্থিতিতে এসব স্মারক ও চুক্তিতে স্বাক্ষর হয়।

যেসব ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে সমাঝোতা স্মারক সই হয়েছে তা হল : পর্যটন ক্ষেত্রে সহযোগিতা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে সহযোগিতা, জয়েন্ট ট্রেড কাউন্সিলের অধীনে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে সহযোগিতা, ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য বাস্তবায়নে সহযোগিতা ও অংশীদারিত্ব, বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ এবং রয়্যাল একাডেমি অব কম্বোডিয়ার মধ্যে একাডেমিক পর্যায়ে সহযোগিতা।

বাকি সমঝোতা স্মারকগুলো হল: মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, স্মৃতিস্তম্ভ এবং স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণে সহযোগিতা, মৎস্য ও অ্যাকুয়াকালচার খাতে সহযোগিতা, শ্রম ও কারিগরি প্রশিক্ষণ খাতে সরকারি পর্যায়ে সহযোগিতা এবং বিনিয়োগ প্রসারে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও কাউন্সিল ফর দ্য ডেভেলপমেন্ট অব কম্বোডিয়ার মধ্যে সহযোগিতা। আর চুক্তিটি হয়েছে দুই দেশে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি এবং কম্বোডিয়া চেম্বার অব কমার্সের মধ্যে সহযোগিতা বিষয়ে।

প্রধানমন্ত্রীকে উষ্ণ অভ্যর্থনা : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার সকালে কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রীর দফতর পিস প্যালেসে পৌঁছলে তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হয়। কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেন স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৮টায় পিস প্যালেসের প্রবেশদ্বারে উপস্থিত থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এ অভ্যর্থনা জানান।

এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটি সুসজ্জিত মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হয়। কম্বোডিয়ার সশস্ত্রবাহিনীর একটি চৌকস দল তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। এ সময় দুই দেশের জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হয়। প্রধানমন্ত্রী কুচকাওয়াজ পরিদর্শন ও সালাম গ্রহণ করেন। এর আগে পিস প্যালেসে যাওয়ার পথে শত শত স্কুল শিক্ষার্থী দুই পাশে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের পতাকা নেড়ে এবং ফুল ছিটিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানায়।

বিনিয়োগে এগিয়ে আসতে কম্বোডিয়ার ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দু’দেশের সমৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশে বিনিয়োগে এগিয়ে আসতে কম্বোডিয়ার ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। সোমবার বিকালে হোটেল সোফিটেলে বাংলাদেশ-কম্বোডিয়া বাণিজ্য সংলাপে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি বলেন, ‘আসুন দু’দেশের মানুষের সমৃদ্ধি অন্বেষায় আমরা অংশীদার হই এবং একসঙ্গে দু’দেশের কোটি কোটি মানুষের জীবনের পরিবর্তন আনতে উদ্যোগী হই।’

কম্বোডিয়ার চেম্বার অব কমার্স আয়োজিত এ সংলাপে কম্বোডিয়ার বাণিজ্যমন্ত্রী প্যান সোরাসাক ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী বিশেষ অতিথি ছিলেন। এছাড়া কম্বোডিয়ার চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি কিথ মের এবং ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অ্যান্ড কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।

সংলাপে কম্বোডিয়ার শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীরা উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কম্বোডিয়ার ব্যবসায়ীরা আঞ্চলিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থানগত সুবিধা কাজে লাগাতে পারে। কারণ চীন, মিয়ানমার ও ভারতের অর্থনৈতিক করিডোরের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততা ক্রমশ বেড়েই চলছে।’

এফবিসিসিআই ও কম্বোডিয়ার চেম্বার অব কমার্সের মধ্যকার সহযোগিতা চুক্তির কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এ চুক্তির সুবাদে দু’দেশের পারস্পরিক বিনিয়োগ ও বাণিজ্য বিস্তৃত হবে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী, দুই চেম্বারের মধ্যে স্থাপিত এ সহযোগিতা পারস্পরিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ প্রবাহে উৎসাহ জোগাবে।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে উদার বিনিয়োগ নীতিমালা রয়েছে। বাংলাদেশ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শুল্ক ছাড়, রয়্যালিটিতে রেমিটেন্স, শতভাগ বৈদেশিক ইকুয়িটি, ডিভিডেন্ড ও পুঁজির বাধাহীন প্রবেশ নীতিমালাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘শিল্পায়নে নতুন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আমরা বিভিন্ন এলাকায় ১০০টি বিশেষ ‘অর্থনৈতিক অঞ্চল’ গড়ে তুলছি। আইটি শিল্প ও বিনিয়োগের লক্ষ্যে আমরা বেশ কিছু হাইটেক পার্ক উন্নয়নের কাজ করছি।’
এ সময় প্রধানমন্ত্রী পোশাক, ওষুধ, জাহাজ নির্মাণ শিল্পসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সফলতার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশ ভিশনের মাধ্যমে দেশের ১৬ কোটি ২০ লাখ মানুষের জীবনকে ডিজিটাল জ্ঞানভিত্তিক সমাজে পরিণত করতে চাই।’

কম্বোডিয়ার রাজার সঙ্গে সাক্ষাৎ : সোমবার সকালে রয়েল প্যালেসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কম্বোডিয়ার রাজা নরোদম সিহামনির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় কম্বোডিয়ার রাজা বাংলাদেশ ও তার দেশের মধ্যে বিদ্যমান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রী কম্বোডিয়ার রাজাকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান। পরে শেখ হাসিনা কম্বোডিয়ার সিনেট প্রেসিডেন্ট সাউম এবং জাতীয় পরিষদের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির প্রেসিডেন্ট হেং স্যামরিনের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের আমন্ত্রণে রোববার দুপুরের পর তিন দিনের সরকারি সফরে নমপেন পৌঁছান। আজ বিকালে তার দেশে ফেরার কথা রয়েছে।

Check Also

মালয়েশিয়ার পাম তেলে ইইউ’র নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের শ্রমবাজারে অশনি সংকেত

বন উজাড়, কার্বন নির্গমনের ঝুঁকি এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্টগত কারণ দেখিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়ার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।