একাত্তরের ৭ ডিসেম্বরের কথা বলছি

সাদেকুর রহমান :ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট:  একের পর এক হানাদারমুক্ত হতে থাকে বিভিন্ন এলাকা। চারদিকে শুধু বিজয়ের ধ্বনি। পত্ পত্ করে উড়ছে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত লাল-সবুজের রক্তস্নাত স্বাধীন পতাকা। হ্যাঁ, একাত্তরের ৭ ডিসেম্বরের কথা বলছি। সময়ের পরিক্রমায় আজ বৃহস্পতিবার হলেও সেদিন ছিল মঙ্গলবার। ভারতের স্বীকৃতির পর এই দিনে রণাঙ্গনে ও রণাঙ্গনের বাইরে প্রতিটি মানুষ অধিকতর সাহস নিয়ে অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার প্রয়াস পায়। আবেগ আর আকাক্সক্ষার সম্মোহনী শক্তি নিয়ে দুরন্ত মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের মনে আশার আলো জ্বলেছে দেশ একদিন স্বাধীন হবেই। শত্রু মোকাবিলা কিংবা পরাভূত করতে স্থানে স্থানে চলছে সম্মুখ সমর। স্বাধীনতা চাই, বিজয় চাই, পরাধীনতার শিকল ভাঙ্গতে চাই।
একাত্তরের এদিনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, নয়াদিল্লীতে স্বাক্ষর করা হয় ভারত-বাংলাদেশ যৌথ সহযোগিতা চুক্তি। চুক্তি অনুযায়ী, মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর যৌথ কমান্ডের অধিনায়ক নিযুক্ত হন ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। তিনি জেনারেল মানেকশ’র মাধ্যমে উভয় সরকার প্রধানকে রিপোর্ট করবেন বলে সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়।  এছাড়া ভারতের পথ ধরে প্রতিবেশী দেশ ভুটানও এদিন বাংলাদেশেকে স্বীকৃতি দেয়। অন্য দিকে ভারত সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান করায় পাকিস্তান সরকার ভারতের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে।
লন্ডনের দ্য সানডে টাইমস’র খবর অনুযায়ী, যুদ্ধের সপ্তম দিনে যশোরে ভারতীয় বাহিনী ও পাকসেনাদের মুখোমুখি যুদ্ধ বাধে। ভারতীয় সৈন্য যশোর ক্যান্টনমেন্ট দখল করার পর যুদ্ধ করতে করতে খুলনা সড়ক দিয়ে সামনে অগ্রসর হতে থাকে। খুলনা বাংলাদেশের একটি অন্যতম  বড় শহর ও সমুদ্র বন্দর। ভারতীয় সৈন্যের সাথে পিলিপ জ্যাকবসন রয়েছে। পাকিস্তানি সৈন্যদের অদুর্ভেদ্য অবস্থা থেকে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পশ্চাদপদ হয়ে, তাড়াহুড়ো করে চলে যাওয়ার চিহ্ন যশোর শহরের কয়েক মাইল বাইরেও দেখা যায়। টারমাক রোডটি মেশিনগান ও রকেটের আঘাতে চুর্ণবিচুর্ণ হয়ে গেছে। ডজনখানেক পুড়ে যাওয়া জিপ ও ট্রাক রাস্তার দু’ পাশে গর্তে পড়ে থাকতে দেখা যায়। তারপরেও পাকিস্তানি নিয়মিত সৈন্যদের লাশ দেখে দুঃখ হয়। কিছুসংখ্যক চিহ্ন ভিন্ন হয়ে কালো হয়ে গেছে।
তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তান ও দৈনিক আজাদ পত্রিকার খবর অনুযায়ী, অবশেষে এদিন সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে নূরুল আমিনকে প্রধানমন্ত্রী করে কেন্দ্রে কোয়ালিশন সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়। সহকারী প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা হয় জুলফিকার আলী ভুট্টোকে। পররাষ্ট্র বিভাগের দায়িত্বও তার ওপর ন্যস্ত করা হয়। গবর্নর ডা. মালিকের আহ্বানে আজ মসজিদে মসজিদে বিশেষ মুনাজাত করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক ভারতীয় হামলার তীব্র নিন্দা করেন। ভারতের ‘বাংলাদেশ’ স্বীকৃতি দানকে পিকিং বেতার ভারতের পূর্ব পাকিস্তান দখলের ষড়যন্ত্র বলে ব্যাখ্যা করে। এছাড়া এদিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে অর্থনৈতিক সাহায্য দান বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়। আর সোভিয়েত নেতা ব্রেজনেভ কোনো প্রকার বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপ ছাড়া পাক-ভারত সংঘর্ষের একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানান।
এই দিনে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে একটি মার্কিনী প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। প্রস্তাবে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) যা ঘটছে তা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়। প্রস্তাবের পক্ষে ১০৪টি এবং বিপক্ষে ১১টি ভোট পড়ে। দশটি দেশ ভোট প্রদান থেকে বিরত থাকে। সাধারণ পরিষদে গৃহিত প্রস্তাবে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি এবং সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য ভারত-পাকিস্তানের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। প্রস্তাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন থাকলেও বাংলাদেশের বিজয়কে তা প্রতিহত করতে পারেনি। এদিন তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘোষণা দেয়, বাংলাশের মুক্তিকামী জনগণের স্বার্থের বিপক্ষে যায় এমন কোনো প্রস্তাব যদি জাতিসংঘ গ্রহণ করে তাহলে ক্রেমলিন মেনে নেবে না।
এদিকে যৌথ বাহিনীর যুদ্ধবিমান বাংলাদেশের আকাশ পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনার পর আজ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছত্রীসেনা নামানো শুরু হয়। পলায়নপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঢাকায় আশ্রয় নেয়ার সব পথ বন্ধ করতে রাজধানীর আশপাশের জেলাগুলোতে মিত্রবাহিনীর ছত্রীসেনারা অবস্থানে নেয়। বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকীর কাদেরিয়া বাহিনী টাঙ্গাইল মুক্ত করে। সন্ধায় কাদেরিয়া বাহিনী ও মিত্রবাহিনী ঢাকা অভিমুখে রওনা হয়। সারাদিন সম্মুখ যুদ্ধের পর নড়াইল, কুড়িগ্রাম, ছাতক ও সুনামগঞ্জ ছেড়ে পালিয়ে যায় দখলদার পাকসেনারা।
একাত্তরের বীর যোদ্ধাদের মুক্তি অর্জনের ধারাবাহিকতায় এদিন মুক্ত হয় শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী, মাগুরা, গোপালগঞ্জ, নোয়াখালী, ঝিনাইদহ, বরিশাল, ময়মনসিংহ, সাতক্ষীরা, কুমিল্লার বরুড়া, সিলেটের বালাগঞ্জ, সুনামগঞ্জের ছাতক, মেহেরপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চল। এদিন সিলেটে হেলিকপ্টারযোগে অবতরণ করেছিল ভারতীয় সৈন্যরা। তাদের সহযোগিতায়ই মুক্তিবাহিনী সিলেট, মৌলবীবাজারকে মুক্ত করে। জামালপুর সীমান্তে চলছিল প্রচন্ড যুদ্ধ। মূলত এদিনই পাকবাহিনী পরাজয়বরণ করে।
প্রামাণ্য দলিল অনুযায়ী, এ সময় যুদ্ধ পরিস্থিতির বিবরণ দিয়ে জেনারেল নিয়াজী গোপন বার্তা পাঠিয়েছিলেন রাওয়ালপিন্ডির হেডকোয়ার্টার্সে। রিপোর্টে তিনি উল্লেখ করেন, “চারটি ট্যাংক রেজিমেন্ট সমর্থিত আট ডিভিশন সৈন্য নিয়ে আক্রমণ শুরু করেছে ভারত। তাদের সাথে আরো আছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৬০ থেকে ৭০ হাজার বিদ্রোহী (মুক্তিযোদ্ধাদের পাকিস্তানীরা তখন বিদ্রোহী বলে উল্লেখ করতো)। তিনি আরো লিখেন, স্থানীয় জনগণও আমাদের বিরুদ্ধে। দিনাজপুর, রংপুর, সিলেট, মৌলবীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লাকসাম, চাঁদপুর ও যশোর প্রবল চাপের মুখে রয়েছে। পরিস্থিতি নাজুক হয়ে উঠতে পারে। গত নয় মাস জুড়ে আমাদের সৈন্যরা কার্যকর অপারেশনে নিয়োজিত ছিল এবং এখন তারা তীব্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। গত ১৭ দিনে যেসব খন্ড যুদ্ধ হয়েছে, তাতে জনবল ও সম্পদের বিচারে আমাদের ক্ষয়ক্ষতি বেড়ে গেছে।”
গোপন এ বার্তা পেয়ে হেডকোয়ার্টার থেকে ৭ ডিসেম্বর সম্মুখসমরের সৈন্যদের পিছিয়ে এনে প্রতিরোধ ঘাঁটিতে সমবেত করার জন্য নিয়াজীর পরিকল্পনা অনুমোদন প্রদান করা হয়। তবে অনুমোদনের অপেক্ষায় বসে থাকেনি যশোর ক্যান্টনমেন্টের পাকিস্তানী বাহিনী। শক্তপোক্ত ঘাঁটি ছেড়ে তারা ৬ ডিসেম্বর রাতের অন্ধকারেই পালিয়ে গিয়েছিল। একদল যায় ফরিদপুর-গোয়ালন্দের দিকে। বড় দলটি যায় খুলনার দিকে। ব্রিগেডিয়ার হায়াত তখন ঢাকার দিকে না গিয়ে বস্তুত খুলনার দিকে একরকম পালিয়েই গিয়েছিলেন।
এদিন বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ ভারতীয় নবম ডিভিশনের প্রথম দলটি উত্তর দিক দিয়ে যশোর ক্যান্টনমেন্টের কাছে এসে পৌঁছায়। মিত্রবাহিনীর জেনারেল রায়নার নেতৃত্বাধীন নবগঠিত সেকেন্ড কোর পানিবেষ্টিত সেই ক্যান্টনমেন্টে আক্রমণ করতে সৈন্যরা ভারী গোলাবর্ষণ ও বিমান হামলা চালিয়ে নিয়ে আক্রমণের উপযোগী করে নিয়েছিল। আক্রমণের সকল আয়োজন শেষ করে মিত্রবাহিনী দেখে পাকবাহিনী আগেই যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে পালিয়েছে। পলায়নের সময় হানাদার বাহিনী বিপুল অস্ত্রশস্ত্র, রেশন এবং কন্ট্রোল রুমের সামরিক মানচিত্রও ফেলে রেখে যায়। হানাদার বাহিনীর পলায়নের মধ্য দিয়ে যশোরের মুক্ত হওয়াটা সারা দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছিল কয়েকগুণ। যশোরের মুক্তি বিশ্ব মিডিয়ারও মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল ব্যাপকভাবে। যশোরের কেশবপুরকে শত্রুমুক্ত করে মুক্তিবাহিনী রাইফেলের আগায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা বেঁধে কেশবপুর থানায় উত্তোলন করার মধ্য দিয়ে বিজয় উদযাপন করে। এ সময় কেশবপুর উপজেলার সর্বস্তরের মানুষ বিজয় উল্লাসে মেতে ওঠেন।
এদিন ভোরে ভারতীয় ছত্রীসেনা সিলেটের নিকটবর্তী বিমান বন্দর শালুটিকরে অবতরণ করে। তারপর চতুর্দিক থেকে পাক ঘাঁটিগুলোর ওপর আক্রমণ চালায়। দুপুর বেলা-ই এখানকার পাকিস্তানি সেনানায়ক আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এদিন যৌথবাহিনী চান্দিনা ও জাফরগঞ্জ অধিকার করে। বিকেলের দিকে বগুড়া-রংপুর সড়কের করতোয়া সেতু দখল নিয়ে পাকিস্তান ও যৌথবাহিনীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সম্মিলিত শক্তি ভোরের সূর্য ওঠার আগেই ঘিরে ফেলে হানাদারদের ঘাঁটি নোয়াখালীর মাইজদী টাউনহল। চরম আক্রমণে হানাদার বাহিনী এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়।
বাংলা একাডেমি প্রকাশিত তৎকালীন একাডেমির পরিচালক, সমকালীন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম উল্লেখযোগ্য কবি আসাদ চৌধুরীর ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক গ্রন্থে একাত্তরের ৭ ডিসেম্বরের ঘটনাবলী উল্লেখ করে বলা হয়, “মিত্রবাহিনী যখন যশোর ক্যান্টনমেন্টে প্রবেশ করলো, দেখলো ফাঁকা। ওরা আগের দিনেই পালিয়েছে। তাই মিত্রবাহিনী আবার ছুটলো ওদের পিছু পিছু খুলনায়। সিলেটেরও পতন হলো ঐদিন। দুপুরের মধ্যেই সিলেটে পাকিস্তানের কমান্ডার আত্মসমর্পণ করলো।”
এদিকে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুহার্তো প্রস্তাব দেন যদি ভারত ও পাকিস্তান অনুরোধ করে তাহলে দুই দেশের মধ্যে তিনি মধ্যস্থতা করতে রাজি আছেন। বিশ্বের বহু দেশ এ প্রস্তাবে সায় দেয়। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্বে যতই উদ্বেগ বাড়তে থাকে, বিজয়ও তত ঘনিয়ে আসতে থাকে।

০৭ ডিসেম্বর ২০১৭,বৃহস্পতিবার:ক্রাইমর্বাতাডটকম/ সংগ্রাম/আসাবি

Please follow and like us:

Check Also

সেই জল্লাদ শাহজাহান এখন চা বিক্রেতা

কেরানীগঞ্জের গোলামবাজার এলাকার বড় মসজিদের মিনারের পাশেই নতুন চায়ের দোকান দিয়েছেন আলোচিত জল্লাদ শাহজাহান ভূঁইয়া। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।