সেচ মওসুমে তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে ভারত

শফিউল আযম বেড়া (পাবনা): সেচ মওসুমে ভারত তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। সেই পানি সেচের জন্য ক্যানেলের মাধ্যমে উত্তরবঙ্গের কুচবিহার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর ও মালদহ জেলায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এর বিরূপ প্রভাবে শীতকালেই তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র নদ মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় প্রমত্তা তিস্তার বুকে জেগে উঠছে অসংখ্য ছোট-বড় ধু-ধু বালুচর। তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রের মিলিত প্রবাহের বিশাল জলরাশি বুকে ধারণ করে বয়ে চলা যমুনা নদীর পেটে জেগে উঠেছে বিশাল বিশাল চর। নদীর মূলধারা সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়েছে। এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ, পানিসম্পদ, কৃষি অর্থনীতি এবং নৌপথে যোগাযোগ হুমকির মুখে পড়েছে।

ভারত থেকে আসা ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তার প্রবাহ একসাথে ধারণ করে যমুনা নদী বিশাল জলরাশি নিয়ে বিস্তীর্ণ জনপদের ভেতর দিয়ে প্রবাহমান ছিল। কিন্তু ভারত তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদে বহুসংখ্যক জলবিদ্যুৎ ও সেচ প্রকল্প নির্মাণ করেছে। ফলে এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে যমুনা নদীতে। এরই মধ্যে যমুনার পানির প্রবাহ কমে গেছে। আর নদী ভরাট হয়ে অসংখ্য ছোট-বড় চর জেগে উঠছে। সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়ছে নদীর মূলধারা। স্থানীয়রা জানান, ১৫ বছর আগে যমুনা ও তিস্তা নদী দিয়ে যেসব কার্গো জাহাজ চলত এখন আর সেই বিশাল কার্গো জাহাজগুলো চলতে পারে না।

আগে যেখানে ১২ ফুট ড্রাফটের জাহাজ চলত এখন সেখানে ৬ ফুট ড্রাফটের জাহাজ চলাচল করতে পারে। ২৫ বছর আগের চেয়ে এখন নৌপথ কমে অর্ধেক হয়েছে। তিস্তা প্রবাহ কমে যাওয়ায় যমুনা হয়ে তিস্তায় আর কোনো নৌযান চলাচল করতে পারে না। এখন যমুনা নদীতে আগের মতো পাঙ্গাস, চিতল, আইড়, গুজো ও রিঠা মাছ পাওয়া যায় না। পাঙ্গাস, আইড়, চিতল মাছের বিচরণত্রে ছিল রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া থেকে কুড়িগ্রামের চিলমারী পর্যন্ত। মাছ আসার জন্য নদীতে পানির যে পরিমাণ প্রবাহ থাকার কথা সেটি না থাকায় এখন আর যমুনায় পাঙ্গাস, চিতল, আইড়সহ সুস্বাদু মাছ আসে না।

হিমালয় পর্বতমালার উৎস থেকে যে ক’টি দেশ পানির বিপুল সম্ভার লাভ করে থাকে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এসব নদীর প্রবাহ সরাসরি বাংলাদেশ পেতে পারে না। ভারতের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ৫৪টি নদীর প্রায় সব ক’টি নদী ও উপনদীতে বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সেচের জন্য বিপুল পানি ভাণ্ডার সরিয়ে নিচ্ছে। তারা গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, দুধকুমার, ধরলা ও মহানন্দাসহ হিমালয় অঞ্চলের অভিন্ন নদী ও উপনদীতে ভারত বাঁধ নির্মাণ করেছে। নেপাল ও ভুটানে ভারত বাঁধ নির্মাণ করেছে। প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে এসব প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির ফলে ভাটির বাংলাদেশে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ভারত গজলডোবায় তিস্তার ওপর যে ব্যারাজ নির্মাণ করেছে তার ফলে তিস্তার ভারতীয় অংশে পানি থই থই করছে। আর ভাটির বাংলাদেশ অংশে তিস্তার পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় জেগে উঠছে অসংখ্য ধু-ধু বালুচর। তিস্তার পানি সরিয়ে নেয়ার জন্য তৈরি ‘তিস্তা-মহানন্দা মূল ক্যানেল’-এর সাহায্যে শুষ্ক মওসুমে তিস্তার প্রবাহ থেকে এক হাজার ৫০০ কিউসেক পানি মহানন্দা নদীতে নিয়ে যাচ্ছে। তিস্তা-মহানন্দা লিংক ক্যানেলের দৈর্ঘ্য প্রায় ২৬ কিলোমিটার।

এই ক্যানেলের মাধ্যমে বছরে প্রায় ৭৩ হাজার হেক্টরে সেচ দেয়া হচ্ছে। এর বিতরণ খালের সংখ্যা ১০টি। এই সংযোগ খাল থেকে জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, পশ্চিম দিনাজপুর, কোচবিহার, মালদাহ জেলার কৃষি জমিতে সেচের পানি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ খালটির মধ্যে করলা, নিম, সাহু, করতোয়া ও জোড়াপানি নদী রয়েছে। এসব নদীর ওপর অ্যাকুইডাক্ট (কৃত্রিম পানিপ্রণালী) তৈরি করা হয়েছে। আধুনিক কারিগরিতে তৈরি অ্যাকুইডাক্টের নিচে বয়ে চলেছে নদী, ওপর দিয়ে খাল। এই খালের সাহায্যে কৃষি জমিতে সেচের পানি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

এ দিকে মহানন্দা প্রধান ক্যানেলের দৈর্ঘ্য ৩২ কিলোমিটারের বেশি। এই ক্যানেলের মাধ্যমে বছরে প্রায় ৭১ হাজার হেক্টরে সেচ দেয়া হচ্ছে। এর বিতরণ খালের সংখ্যা ১৩টি। ডাউক নগর প্রধান ক্যানেলের দৈর্ঘ্য ৮০ কিলোমিটারের বেশি। এই ক্যানেলের মাধ্যমে বছরে প্রায় ৯৫ হাজার হেক্টরে সেচ দেয়া হচ্ছে। এর বিতরণ খালের সংখ্যা ১৮টি। নাগর টাঙ্গন প্রধান খালের দৈর্ঘ্য ৪২ কিলোমিটারের বেশি। এর মাধ্যমে বছরে এক লাখ ১৬ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে সেচ দেয়া হচ্ছে। এর বিতরণ খালের সংখ্যা আটটি। তিস্তা-জলঢাকা প্রধান ক্যানেলের দৈর্ঘ্য ৩০ কিলোমিটারের বেশি। এর মাধ্যমে ৫৮ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে সেচ দেয়া হচ্ছে। এর বিতরণ খালের সংখ্যা ছয়টি।

ভারত ব্রহ্মপুত্রের অন্যতম উৎস ও প্রদায়ক রাঙ্গানদীর ওপর বাঁধ নির্মাণ করেছে। ব্রহ্মপুত্রে পানির প্রবাহ হ্রাস পাওয়া এর অন্যতম কারণ বলে জানা গেছে। আসামে ব্রহ্মপুত্র নদের অন্যতম উৎস পাগলাদিয়ায় একটি বিশাল বাঁধ নির্মাণ করছে ভারত। এই বাঁধের মাধ্যমে ৫০ হাজার হেক্টরে সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ করা যাবে। এ জন্য পাগলাদিয়ার পানি বাঁধের ভেতর প্রত্যাহার করা হচ্ছে। এতে বাংলাদেশের ব্রহ্মপুত্র-যমুনা অংশে পানির সঙ্কট হচ্ছে।

ভারত ব্রহ্মপুত্রের আরেক উৎস লাংপি নদীর ওপর একটি বাঁধ তৈরি করে পানির প্রবাহ আটকে দিয়েছে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনার প্রবাহের গুরুত্বপূর্ণ উৎস রাইডাক নদীতে ভুটান-ভারত যৌথ উদ্যোগে বৃহৎ একটি পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে তোলা হয়েছে। এই প্রকল্পের জন্য যে পরিমাণ পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে তাতে ব্রহ্মপুত্র নদে পানির সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। ব্রহ্মপুত্রের অন্য গুরুত্বপূর্ণ উৎস কপিলি নদীকে কেন্দ্র করে ভারত বেশ ক’টি বাঁধ ও রিজার্ভার নির্মাণ করেছে। সেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণের পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদন এই বাঁধ প্রকল্পের ল্য। এটি নির্মিত হওয়ায় ব্রহ্মপুত্রে পানি প্রবাহে সঙ্কট দেখা দিচ্ছে।

ব্রহ্মপুত্র নদের গুরুত্বপূর্ণ উৎস সুবানসিঁড়ি নদীর পানি প্রত্যাহারসহ বেশ ক’টি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজে হাত দিয়েছে ভারত। এর বিরূপ প্রভাবে ব্রহ্মপুত্র নদ ব্যাপকভাবে পানি সঙ্কটের শিকার হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর মধ্যে লোয়ার সুবানসিঁড়ি প্রকল্প সমাপ্তির পথে রয়েছে। এর ফলে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হয়ে ব্রহ্মপুত্রের ধারা বিপন্ন হবে। ভারতের নাগাল্যান্ডে ডয়াং নদীর ওপর নির্মিত একটি ড্যাম ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহে বাধার সৃষ্টি করছে। ব্রহ্মপুত্রের অন্য উৎস উমিয়াম নদীতে বাঁধ দিয়ে অন্তত চারটি বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করেছে ভারত।

এর প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশে যমুনা নদীতে পানির প্রবাহে টান পড়ছে। এই প্রকল্পের আওতায় ব্রহ্মপুত্রের উপনদী উমিয়ামের পানি সরিয়ে নিয়ে উপক্র নামক নদীতে প্রবাহিত করা হচ্ছে। পানি প্রত্যাহারের ফলে কার্যত এই অন্যতম উপনদীর পানি থেকে ব্রহ্মপুত্র নদ প্রায় সম্পূর্ণ বঞ্চিত হচ্ছে।

০৫জানুয়ারী,২০১৮শুক্রুবার::ক্রাইমর্বাতা.কম/প্রতিনিধি/আসাবি

Please follow and like us:

Check Also

দেশীয় খেলাকে সমান সুযোগ দিন: প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্যান্য খেলার পাশাপাশি দেশীয় খেলাকেও সুযোগ দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কতৃর্পক্ষের প্রতি আহবান …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।