৫০ হাজার শিক্ষার্থীর ফল বাতিল হতে পারে

এসএসসি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস

৫০ হাজার শিক্ষার্থীর ফল বাতিল হতে পারে

তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পেশ, ৪ সুপারিশ * ১২ বিষয়ের এমসিকিউ পরীক্ষার ৯ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা আগে ফাঁস হয় * তিন উপায়ে চিহ্নিত করা হবে ফাঁস প্রশ্নের সুযোগ নেয়া শিক্ষার্থীদের * শতভাগ নিশ্চিত হওয়ার পরই ব্যবস্থা : সচিব * এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস রোধে ৮ পদক্ষেপ

 

এসএসসি পরীক্ষায় ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সুবিধাভোগী ৫০ হাজার শিক্ষার্থী নজরদারিতে আছে। তাদের ব্যাপারে নানাভাবে খোঁজখবর নিচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। উত্থাপিত অভিযোগ সঠিক হলে এসব শিক্ষার্থীর ফল বাতিল করা হবে। এ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়ে গঠিত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটির প্রতিবেদন সোমবার মাধ্যমিক ও শিক্ষা বিভাগের সচিবের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। প্রতিবেদনে ফাঁস প্রশ্নের সুযোগ নেয়া শিক্ষার্থীদের ফল বাতিলসহ চারটি সুপারিশ করা হয়েছে।

এদিকে ২ এপ্রিল থেকে অনুষ্ঠেয় এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস রোধে ৮টি পদক্ষেপ নিচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ওই সব পদক্ষেপ যথাযথভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মাঠপ্রশাসনের সহায়তা চেয়ে আজ দুপুরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিবের সঙ্গে বৈঠকে বসছেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব। এছাড়া ১৯ মার্চ ৮ বিভাগীয় কমিশনারের সঙ্গে বৈঠক ডাকা হয়েছে।

জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন সোমবার  বলেন, ‘ফাঁস হওয়া প্রশ্নে যেসব শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিয়েছে তাদের ফল আমরা প্রকাশ করব না। ফল স্থগিত থাকবে। তদন্ত শেষে প্রয়োজনে বাতিল করব।’ তিনি বলেন, ‘প্রাথমিক তদন্তে এখন পর্যন্ত আমরা এমন ৫০ হাজার শিক্ষার্থী পেয়েছি। তবে তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে। শতভাগ নিশ্চিত হওয়ার পরই আমরা চিহ্নিতদের পরীক্ষার ফল বাতিল করব।’

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, তিনটি উপায়ে ফাঁস প্রশ্নের সুবিধাভোগী শিক্ষার্থী চিহ্নিত করার কাজ চলছে। এক, পরীক্ষার দিন ও এর আগের দিন বিকাশ এবং রকেটসহ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে যারা অর্থ লেনদেন করেছে। সর্বোচ্চ ১ হাজার টাকা লেনদেনকারী গ্রাহকের তথ্য নেবে মন্ত্রণালয়। এরপর ওইসব গ্রাহকের পরিবারে কোনো এসএসসি পরীক্ষার্থী আছে কিনা তা চিহ্নিত করা। দুই, ফেসবুকের যেসব ক্লোজ গ্রুপে প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে সেইসব গ্রুপের সদস্য চিহ্নিত করা। তিন, গ্রেফতার ও বহিষ্কৃত ব্যক্তি, শিক্ষক-কর্মচারী এবং শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিব জানান, শিক্ষার্থীদের চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) মূল সহায়তা দিচ্ছে। তারা প্রযুক্তিগত তদন্ত চালাচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনও (বিটিআরসি) সহায়তা করছে।

তদন্ত প্রতিবেদন পেশ : প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়ে গঠিত মন্ত্রণালয়ের কমিটির প্রতিবেদন সোমবার বিকালে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিবের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। কমিটির সদস্য সচিব আবু আলী মো. সাজ্জাদ হোসেন কমিটির পক্ষে প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন।

৮ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনে চারটি সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলো হল- এক, ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে যেসব শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিয়েছে তাদের ফলাফল বাতিল করা। এক্ষেত্রে চূড়ান্ত ফল প্রকাশের পর পাস করা কোনো শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধেও যদি ফাঁস প্রশ্নে পরীক্ষা দেয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে তার ফল বাতিল হবে। পাশাপাশি এসব শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেয়া। দুই, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে প্রশ্নপত্র নেয়ার দায়ে যারা বহিষ্কৃত হয়েছে তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া। তিন, ফাঁসের অভিযোগে গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ এবং তাদের সঙ্গে যেসব পরীক্ষার্থীর লিঙ্ক ছিল তাদের চিহ্নিত করে ফল বাতিলসহ আইনগত ব্যবস্থা নেয়া। চার, কমিটি প্রশ্ন ফাঁসের কারণে কোনো পরীক্ষা বাতিলের পক্ষে নয়। কেননা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উন্মুক্তভাবে প্রশ্ন ফাঁস হয়নি। কাছাকাছি কিছু লোকের মধ্যে (ক্লোজ গ্রুপ) প্রশ্ন শেয়ার হয়। ফলে পরীক্ষার আগ মুহূর্তে অতি নগণ্যসংখ্যক পরীক্ষার্থীর প্রশ্ন পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। ২০ লাখ সাধারণ পরীক্ষার্থীর হাতে প্রশ্ন পৌঁছায়নি। যারা আগ মুহূর্তে সঠিক বা ভুয়া প্রশ্ন পেয়েছে তারা ওই সময় পরীক্ষা কেন্দ্রের পথে বা কেন্দ্রের সামনে ছিল। এ সময় প্রশ্ন পেয়ে থাকলেও তারা তেমন লাভবান হতে পারেনি। এ কারণে পরীক্ষা বাতিল করা সমীচীন হবে না। কেননা, পরীক্ষা বাতিল করা হলে ২০ লাখ শিক্ষার্থী, তাদের পিতামাতা ও অভিভাবক বিপদে পড়বে। তাছাড়া পরীক্ষা বাতিল করে প্রচলিত পদ্ধতিতে পরীক্ষা নিতে গেলে আবারও যে প্রশ্ন ফাঁস হবে না- সে নিশ্চয়তা নেই। বরং এতে নিরপরাধ শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকসহ কোটি মানুষের ভোগান্তি বাড়বে। তাই পরীক্ষা বাতিল না করাই অধিক যুক্তিযুক্ত।

এ প্রসঙ্গে সচিব মো. সোহরাব হোসাইন বলেন, ১৭টি বিষয়ে এবার এসএসসি পরীক্ষা হয়েছে। এর মধ্যে ১২টি বিষয়ের এমসিকিউ অংশের শুধু ‘খ’ সেট প্রশ্ন পরীক্ষার সর্বোচ্চ ১ ঘণ্টা আগে ফাঁস হয়েছে বলে কমিটির তদন্তে উঠে এসেছে। তবে ১ ঘণ্টা আগে মাত্র একটি বিষয়ের প্রশ্ন ফাঁসের কথা এসেছে। বাকি বিষয়গুলোর কোনোটির প্রশ্ন পরীক্ষার ৯ মিনিট থেকে আবার কোনোটির সর্বোচ্চ ৩০ মিনিট আগে ফাঁস হয়েছে। এতে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার শিক্ষার্থী লাভবান হতে পারে। কিন্তু তাদের কারণে বাকি সাড়ে ১৯ লাখ শিক্ষার্থীকে কষ্ট দেয়া ঠিক হবে না। এ কারণে আমরা গোটা পরীক্ষা বাতিল করছি না। শুধু যারা প্রশ্ন ফাঁসের সুবিধাভোগী তাদের পরীক্ষা বাতিল হবে।

কমিটি মনে করছে, ৩০ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা আগে ফাঁস হলেও যারা প্রশ্ন পেয়েছে তারাও খুব বেশি লাভবান হতে পারেনি। কেননা, ৩০ মিনিট আগে কেন্দ্রে প্রবেশ বাধ্যতামূলক ছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছাড়াও মোবাইল ফোনে দেশের দু-এক স্থানে অতি নগণ্যসংখ্যক পরীক্ষার্থী প্রশ্ন পেয়েছে। তবে ওই প্রশ্ন সঠিক কিনা, তা যাচাই করা দুরূহ। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু ভুয়া প্রশ্নও ছড়িয়েছে। সেগুলোর পেছনে ছুটে লেখাপড়া না করা কিছু শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

১ ফেব্রুয়ারি এবারের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়। শুরুর দিন থেকে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ উঠলে কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের সচিব মো. আলমগীরের নেতৃত্বে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। সূত্র জানায়, ১ মার্চ প্রতিবেদন চূড়ান্ত হলেও সদস্যদের স্বাক্ষরে সময় লাগে ৯ দিন। এরপরও দু’জন সদস্যের স্বাক্ষর ছাড়াই সোমবার প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।

এইচএসসির প্রশ্ন ফাঁস রোধে ৮ পদক্ষেপ : ২ এপ্রিল শুরু হচ্ছে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা। ওই পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস রোধে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ৮ পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে আছে- মূল প্রশ্নের খামের বাইরে আরেকটি খাম অর্থাৎ বিশেষ সিকিউরিটি ট্যাপ লাগানো। ছাপানো উভয় সেট প্রশ্নই কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়া। কোন সেটে পরীক্ষা হবে তা জানানো হবে ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষার হলে ঢোকার পর বা ১৫ মিনিট আগে। কোনো অজুহাতেই পরীক্ষা শুরুর ৩০ মিনিটের মধ্যে কাউকে পরীক্ষার হলে ঢুকতে দেয়া হবে না। পরীক্ষা শুরুর ৩০ মিনিট আগে নিজের সিটে বসতে হবে। জেলা এবং উপজেলার ট্রেজারি থেকে নির্ধারিত তিন সদস্যের কমিটি প্রশ্ন সংগ্রহ করবে। তিনজনের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। কোনো কারণে একজন অনুপস্থিত থাকতে হলে আগেই জেলা প্রশাসককে জানাতে হবে। তিনি নতুন সদস্য নিয়োগ দেবেন। ১৪৪ ধারা বলবৎ এলাকায় মোবাইল ফোন নিয়ে যাকে পাওয়া যাবে, তাকেই গ্রেফতার করা হবে। কোনো কারণে কোথাও নির্ধারিত সময়ের ১০-১৫ মিনিট পর পরীক্ষা শুরু হলে তা ঠিক ৩ ঘণ্টা পর শেষ হবে। পরীক্ষার্থীদের ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না।

জানা গেছে, এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সহায়তা চেয়ে আজ দুপুরে কেবিনেট সচিবের সঙ্গে বৈঠকে বসছেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব। এছাড়া ১৯ মার্চ ৮ বিভাগের ৮ সচিবের সঙ্গে আলাদা মতবিনিময় সভা করবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ লক্ষ্যে ৮ জন অতিরিক্ত সচিবকে বিভাগভিত্তিক দায়িত্ব দেয়া হবে।যুগান্তর

Please follow and like us:

Check Also

কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যানকে অব্যাহতি

সনদ বাণিজ্য চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে স্ত্রী গ্রেফতার হওয়ার পর এবার বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।